Friday, November 22, 2024
Latest Newsদেশফিচার নিউজ

তদন্তের নামে প্রহসন! প্রথম থেকেই প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করছে দিল্লি পুলিশ

দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক: দিল্লি পুলিশ চার্জশিট দিচ্ছে আরএসএস’র মুখপত্র ‛অর্গানাইজার’ এর ভাষায়, এই অভিযোগ রয়েছে আগেই উঠেছিল। শনিবার সিপিআই (এম) সাধারণ সম্পাদকের নাম চার্জশিটে জুড়ে দেওয়া পরে সেই অভিযোগ আরও জোরালো হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা শুধু নয় , তাদের অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে জিগির ছড়ানোর জন্য। অন্যদিকে যারা সিএএ – এন আর সি বিরোধী আন্দোলনে ছিলেন, মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন তাঁদের ফাঁসানো হচ্ছে। শুরু থেকেই এই তদন্ত একটা প্রহসন। দুটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠন, নিজেদের ‘ অনুসন্ধানকারী দল ‘ হিসাবে পরিচিত দিয়ে দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসা নিয়ে দুটি রিপোর্ট জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে।

প্রথমটি ১১ মার্চ, দ্বিতীয়টি ২৯ মে। দ্বিতীয়টি অমিত শাহের হাতে। প্রথমটি তার প্রতিমন্ত্রী জি কে রেড্ডিকে। দুটি রিপোর্টেই মূল লক্ষ্য সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা। আরএসএস – বিজেপি সিএএ – এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকে দিল্লি হিংসার জন্য দায়ী করে পুরো ষড়যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। সেই চক্রান্তের অংশ হিসাবেই এবার সীতারাম ইয়েচুরির নাম যুক্ত করা হয়েছে। একে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হিংসা বলেও দাবি করা হচ্ছে। যদিও পরিসংখ্যান হল, দিল্লি হিংসায় নিহত ৫৩ জনের মধ্যে ৪০ জন মুসলিম। ১৪ – ১৫টি মুসলিম ধর্মস্থান ভাঙচুর বা আগুন লাগানো। অধিকাংশ ঘর – দোকান , ঠেলা – রিকশা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে মুসলিমদের।

সিপিআই ( এম) অন্য সব ক্ষেত্রের মতোই দিল্লির সাম্প্রদায়িক হিংসার সময়েও উভয় পক্ষের সম্প্রীতি ও ঐক্য রক্ষার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করেছে। সাম্প্রদায়িক হিংসায় ক্ষতিগ্রস্ত গরীব মানুষের পাশে যথাসম্ভব দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। দাঙ্গায় নিহত প্রায় প্রতিটি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছেন সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাতের মতো শীর্ষ নেতারা। যাদের বিশেষভাবে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, সেই সব পরিবারে গিয়ে পার্টির পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যখন কোনও রাজনৈতিক দলের নেতারা যাওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি, সিপিআই ( এম ) সাংসদ এবং নেতৃবৃন্দ উভয় পক্ষের মানুষের কাছে গেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা এবং অভিযোগ তুলে এনেছেন‌। পুলিশ যেসব ক্ষেত্রে দুর্বৃত্তদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিচ্ছে না সেইসব প্রান্তিক মানুষকে আইনি সহায়তার ব্যবস্থাও করেছে পার্টি।

ঠেলায় করে যারা সবজি , ফল বিক্রি করে পরিবার চালাতেন , দাঙ্গায় তাদের উপার্জনের একমাত্র সম্বল সেই ঠেলা গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় দাঙ্গায়। তাদের মধ্যে অনেককে সেই ঠেলাগাড়ি কিনে দিয়েও জীবিকার পথ করে দিয়েছে সি পি আই ( এম) এই কাজ কোনোভাবে মেনে নিতে পারেনি সরকার। সেই কারণেই সীতারাম ইয়েচুরিকে ফাঁসানো হয়েছে। পার্টির অন্য নেতৃবৃন্দের সম্পর্কেও এই ধরনের পদক্ষেপ করা হতে পারে। যে দেবাঙ্গনা কলিতার বিরুদ্ধে এই অতিরিক্ত চার্জশিট যুক্ত করেছে দিল্লি পুলিশ, সেই ছাত্রীকে সম্প্রতি একটি মামলায় জামিন দিয়েছে দিল্লি হাইকোর্ট। বিচারপতি সুরশ কুমার কাইত দিল্লি পুলিশের দাবি উরিয়ে দিয়ে বলেন, সিএএ – এনআরসি নিয়ে বিক্ষোভ চলার সময়ে অজস্র টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা , খবরের কাগজের ক্যামেরা উপস্থিত ছিল। কোথা থেকে পুলিশ এই প্রমাণ উপস্থিত করতে পারেনি যে, তিনি উস্কানিমূলক ভাষা দিয়েছেন। বিচারপতি বলেন, পুলিশের দেওয়া পেনড্রাইভে দেখা যাচ্ছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে দেবাঙ্গনা কলিতা উপস্থিত ছিলেন। যা ভারতের সংবিধানের ১৯ নম্বর ধারায় মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া আছে। তিনটি সাজানো মামলায় জামিন পেয়েছেন ওই ছাত্রী। শুধু একটি মামলায় ইউএপিএ দিয়ে রাখায়। জেল থেকে ছাড়া পাননি। একইভাবে অবস্থান, ধরনা , সড়ক অবরোধ, চাক্কা জ্যাম ইত্যাদি যা নিতান্তই আন্দোলনের অহিংসা ধারা হিসাবে বহুকাল ধরেই আমাদের দেশে পরিচিত। সেগুলিকে এখন শুধু ফৌজদারি অপরাধ নয়, উগ্ৰপন্থা দমনে ব্যবহৃত আইনের আওতায় ফেলে হচ্ছে। জেলে পোরা হচ্ছে আন্দোলকারীদের। এরই উদাহরণ দেখা গেছে দিল্লি দাঙ্গার তদন্তের প্রতি পদে পদে।

২৭ বছরের গবেষক সন্তানসম্ভবা সাফুরা জারগর থেকে সমাজ কর্মী হর্ষ মান্দার , সকলকেই দিল্লি হিংসা ষড়যন্ত্রকারী বানানোর চেষ্টা হয়েছে। শাহিনবাগে লঙ্গর খুলে খাবার খাওয়ানো ডি আর বিন্দ্রাকে পুলিশকর্মী রতনলাল হত্যা মামলায় জড়িয়ে দিয়েছে। ডঃ এম এ আনোয়ারের নাম দাঙ্গাকারী হিসাবে চার্জশিটে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির হিংসায় জখম ৫০০ – র বেশি মানুষের তিনি চিকিৎসা করেছেন। সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বহু ছাত্র – যুবদের ডেকে পুলিশ ভয় দেখাচ্ছে। বিশিষ্ট সমাজকর্মীদের নাম বলানোর জন্য ‘ডিল ‘করতে চাইছে। ‛হাম ভারতকে লোগ’, ‛পিঞ্জরা তোড়’ প্রমুখ সংগঠনের নাম বলানোর জন্য চাপ দিচ্ছে।

সিএএ বিরোধী আন্দোলনে থাকা সমাজকর্মী হর্ষ মান্দার , যোগেন্দ্র যাদবদের নাম বলানোর জন্যেও চাপ দেওয়া হয়েছে বলে অনেকেই জিঙ্গাসাবাদের পর সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়েছেন। বিপরীতে মোদি – শাহ – অনুরাগ – পরবেশ কপিল শর্মাদের বক্তব্যগুলি কী ছিল? চার্জশিট এই বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব। একটা এফআইআর পর্যন্ত হয়নি। শুরু করেছিলেন অমিত শাহ দিল্লি ভোটের আগে। শাহিনবাগে ‘ বৈদ্যুতিক শক ‘ লাগে এমন ভোট দেওয়ার আবেদন ছিল। পরপর অনুরাগ ঠাকুরের ‘ দেশ কে গদ্দারো কো গলি মারো সালো কো ‘ পরবেশ বর্মার ‘ শাহিনবাগে লক্ষ লোক জমায়েত হয়েছে , ওরা আপনার মা – বোনকে ধর্ষণ করবে’ । এই রকম আরও অজস্র। বড়োদের কথা মিডিয়ায় এসেছে। পাড়ায়, গলি – মহল্লায় ছোটদের আরও আরও কুৎসিততর বিদ্বেষ প্রচারের কথা সামনে আসেনি। এদের কারও বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এমনকি আদালতের সমালোচনার পরেও অমিত শাহের মন্ত্রক নির্বিকার।

মোদি – শাহরা নিজেদের অ্যাজেন্ডা কার্যকরী করে চলেছে। উস্কানিমূলক ভাষণ দেওয়া বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলায় দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলীধর কে রাতারাতি বদলি করা হয়। এই রকম নিন্দনীয় ঘটনারও সাক্ষী হয়েছে এই সময়। সিএএ – এনআরসি নিয়ে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে লাগাতার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রচার বিজেপির শীর্ষস্তর থেকে করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজে ঝাড়খণ্ডের সভায় ‘ পোশাক দেখে ‘ আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করার উস্কানি দিয়েছিলেন। এতকিছুর পরেও যেমন ঝাড়খণ্ড , তেমনই দিল্লিতেও বিপর্যয় হয় বিজেপির। জরুরী অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরে দেশ জুড়ে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মতো এমন সর্বাত্মক, স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন হয়নি‌। সেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিহিংসামূলক পদক্ষেপ করা হচ্ছে সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে। পুলিশের এই দলদাস আচারণ এবং সাজানো তদন্তের প্রতিবাদ জানিয়ে ৭২ জন বিশিষ্ট নাগরিক ১৭ জুলাই চিঠিতে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতিকে। এর আগে মে মাসেই বামপন্থী দলগুলি একই অভিযোগ জানিয়েছিল রাষ্ট্রপতিকে। দিল্লি পুলিশের হাত থেকে পক্ষপাতদুষ্ট তদন্ত সরিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবিও উঠেছে।

 

Leave a Reply

error: Content is protected !!