Monday, May 13, 2024
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদকীয়

নেতাজির মুসলিম সঙ্গী-সাথিরা

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। বাঙালির এক অজেয় পৌরুষের নাম। জীবনের নানা সময়ে তিনি এসেছেন মুসলিম সংস্পর্শে। লিখছেন – গোলাম রাশিদ

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম ওড়িশার কটক শহরে হলেও তিনি আদতে বাংলারই ছেলে। ‘নেতাজি’ নামটি বললেই একজন লড়াকু, অকুতোভয়, আদর্শ বাঙালির চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। স্কুলে পড়ার সময় ‘আওয়ার ন্যাশনাল হিরো’ সম্বন্ধে লিখতে বলা হলে আমরা বাঙালিরা অনেকেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে লিখেছি। তিনি যেন চিরসবুজ। ১৯৪৫-এর পর এই সেদিন পর্যন্ত বহু বাঙালি বিশ্বাস ধরে রেখেছে যে, সুভাষ মরে নাই। বাঙালির এতটা বিশ্বাস ও ভালোবাসা আর কোনও রাজনৈতিক নেতা পেয়েছেন কি না সন্দেহ রয়েছে। বাংলা তথা দেশ কোনও মুসিবতে পড়লেই অনেক বাঙালি ভাবেন বা বলেন, সুভাষ ফিরে আসলেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু সুভাষ ফেরে নাই। এ হেন নেতাজি জাতপাতের ঊর্ধ্বে ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ তাঁর মধ্যে ছিল না। তাঁর জীবনে নানা ভাবে মুসলিমরা জড়িয়ে রয়েছে।

নেতাজির আাজাদ হিন্দ ফৌজ ১৯৪৪ সালে ব্রিটিশবাহিনীকে পরাস্ত করে মায়ানমার সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ওই বছরের ১৪ আগস্ট মণিপুরের মৈরাং-এ ভারতের তেরঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন কর্নেল শওকত আলি মালিক। তাঁর সাহসিকতার জন্য তিনি নেতাজির কাছ থেকে ‘সর্দার-ই-জঙ্গ’ উপাধি পান। এত কিছুর পরেও তাঁর নাম স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এমনকি মৈরাং-এর কাংলাতে পরবর্তীতে যে ফলক লাগানো হয়েছে, তাতেও কর্নেল শওকত আলি মালিকের নাম রাখা হয়নি! এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি বা হতে পারে। শুধু তাই নয়, নেতাজির উত্তরসূরি বলে দাবি করা ফরওয়ার্ড ব্লক দলটি সেূানকার একটি মিউজিয়ামের সামনে ফলক লাগিয়েছে, তাতেও মালিকের নাম নেই।

ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লেূার সময় এ ভাবে মুসলিম নামগুলিকে সযত্নে এড়িয়ে যায় সিলেবাস তৈরির বিদগ্ধ ব্যক্তিরা। আসলে নেতাজির সঙ্গে মুসলিম যোগ তাঁর জীবন জুড়েই। সারা জীবনে, বিশেষ করে যুদ্ধের ওই সময়টাতে তিনি তুমুলভাবে মুসলিম সৈনিকদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজের ৪০ শতাংশ সেনাই ছিল মুসলিম। তিনি যখন ১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ছদ্মবেশে ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান তখন তিনি ‘বোবা’ পাঠানের ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। নাম ধারণ করেছিলেন মুহাম্মদ জিয়াউদ্দিন। এরপর আসবে আবিদ হোসেনের কথা।

আবিদ হোসেন ছিলেন ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনির প্রকৃত স্রষ্টা। তিনি ছিলেন হায়দরাবাদের মানুষ। ইঞ্জনিয়ারিং পড়তে জার্মানি যান। সেখানে নেতাজির বক্তব্যে মুগ্ধ হয়ে পড়া ছেড়ে নেতাজির সঙ্গে যোগ দেন। তিনি ছিলেন নেতাজির সর্বক্ষণের সঙ্গী। সাবমেরিনে করে জার্মানি থেকে জাপান যাওয়ার পথেও আবিদ হাসান সঙ্গে ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৮৪তে তিনি মারা যান। ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনিগুচ্ছ পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু পার্লামেন্টে তাঁর সেই বিখ্যাত মধ্যরাতের বক্তব্যে ব্যবহার করেন।

হাবিবুর রহমান, কর্নেল আশরাফুদ্দিন চৌধুরি, কর্নেল এস আখতার আলি, কর্নেল আহমদউল্লাহ, কর্নেল তাজউদ্দিন প্রমুখ ছিলেন নেতাজির অত্যন্ত কাছের সহকর্মী। রেঙ্গুনে গঠিত আজাদ হিন্দ সরকারের ক্যাবিনেট সদস্যের মধ্যে ছিলেন—লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ আহমেদ ও এহসান কাদির। নেতাজির প্রধানমন্ত্রীত্বে যে সরকার গঠিত হয়েছিল তাতে সচিবদের মধ্যে ছিলেন করিম ঘানি, ডি এম খান। আজাদ হিন্দ ফৌজের চারজন কমান্ডারের মধ্যে তিনজনই ছিলেন মুসলিম মেজর জেনারেল মুহাম্মদ জামান কিয়ানি, শাহনওয়াজ খান ও শওকত আলি মালিক। পরবর্তীতে আজাদ হিন্দ ফৌজ যখন ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন সৈনিকদের বিচার হয়। বিচারে মেজর জেনারেল শাহনওয়াজ খানকে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। দেশের মানুষের তীব্র প্রতিবাদে তা রদ হয়। ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পরে শাহনওয়াজ খান বেশ কয়েকটি দফতরের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব সামলেছেন।

নেতাজিকে সহায়তাকারী আরেকজন বি্যূাত মুসলিম হলেন আবদুল হাবিব ইউসুফ মার্ফানি। তিনি ছিলেন রেঙ্গুনবাসী ধনী মুসলিম ব্যবসায়ী।নেতাজি তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের জন্য অর্থসংগ্রহ করছিলেন। আবদুল হাবিব ইউসুফ এক কোটি টাকা (সেই সময়ে!) ও প্রচুর সোনার গয়না ফৌজের তহবিলে দান করে দেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। নেতাজি তাঁকে ‘সেবক-ই-হিন্দ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর এই ত্যাগের কথা ক’জন ভারতীয় মনে রেখেছে!

সবশেষে আরেকজনের কথা উল্লেখ করব। তিনি হলেন কর্নেল নিজামউদ্দিন। মায়ানমারের (তখন বার্মা) জঙ্গলে নেতাজিকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এই নিজামউদ্দিন। তিনটে বুলেট নিজের বুক পেতে নিয়েছিলেন নেতাজিকে রক্ষা করতে। তাঁর বীরত্ব দেখে নেতাজি তাঁকে ‘কর্নেল’ উপাধি প্রদান করেন।

নিজামউদ্দিনের আসল নাম ছিল সাইফুদ্দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্তমান উত্তরপ্রদেশের আজমগড়ে। ২০ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ আর্মির হয়ে লড়াইয়ের জন্য কলকাতায় আসেন। এরপর এক ইংরেজ অফিসারকে হত্যা (সেই অফিসার ভারত-বিরোধী মন্তব্য করেছিল তাই) করে সিঙ্গাপুর পালিয়ে যান। সেখানে আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে যোগ দেন।

টেলিগ্রাফ পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নিজামউদ্দিন সেই জঙ্গলের ঘটনাটি বর্ণনা করেন, ‘আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। নেতাজি ছিলেন, পাশে আমিও ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ করে ব্যারেলের গর্জন শুনি। তৎক্ষণাৎ নেতাজির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল দেখি নেতাজি আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল আমার শরীর থেকে বুলেট বের করেছিলেন।’

এটা ১৯৪৩ সালের ঘটনা। তিনি সবসময় নেতাজির পাশেই থাকতেন এবং ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন। যুদ্ধ পর্ব সমাপ্ত হলে তিনি রেঙ্গুনেই থেকে যান। তাঁর ছেলে-মেয়েরা সেখানেই জন্মায়। ১৯৬৯-এ তিনি ভারতে ফিরে আসেন। বসবাস শুরু করেন নিজ গ্রামে। বাড়ির নাম রাখেন ‘হিন্দ ভবন’। ছাদে উড়ত জাতীয় পতাকা। কারও সঙ্গে দেখা হলেই ‘জয় হিন্দ’ বলে সম্বোধন করতেন কর্নেল নিজামউদ্দিন। ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ১১৭ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।

Leave a Reply

error: Content is protected !!