আফরিদা খাতুন আঁখি : ভারতের শাসন ক্ষমতায় যে দিন থেকে পদ্মফুলের আগমন ঘটেছে অর্থাৎ ২০১৪–এর পর থেকেই সময় সাক্ষী ভারত তার তিরঙ্গার ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের ঐতিহ্য খুইয়ে গেরুয়া রঙ ধারণ করা শুরু করেছে খুবই ভয়ঙ্কর গতিতে, যা একজন ভারতবাসী হিসেবে খুবই অপ্রত্যাশিত এবং লজ্জাজনক বটে। গেরুয়া বাহিনী তাদের এই প্রকল্পকে বাস্তবায়ন করতে কখনও লাভ জিহাদের নামে দহন করে আকলাখের শরীর থেকে প্রাণটা বার করে নিয়েছে, কখনও বা তাদের প্রয়োজন পড়েছে রোজা পালনকারী অভুক্ত জুনায়েদের মত তাজা প্রাণের। তাদের এই প্রকল্পের কারণে হারিয়ে গেছে নাজিব, কৃষ্ণাণ, রোহিত, পায়েলের মত নাম না জানা আরও কত দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যত অথবা গৌরী লঙ্কেশের মত প্রবীণ শক্তি। তাদের এই রক্তাক্ত প্রকল্পে রিক্ত হয়েছে ভূস্বর্গের শুভ্র হৃদয়। তাদের বাহিনী ধীরে ধীরে হরণ করেছে বিচার ব্যবস্থার সতীত্ব, আজ বিচার ব্যবস্থা উলঙ্গ হয়ে প্রকাশ্যে দাঁড়িয়ে আছে। জনগণ যখন সংবিধানে উল্লেখ থাকা তার অধিকারের কথা স্মরণ করে প্রশ্ন করেছে, নোটবন্দীকে নিয়ে প্রশ্ন করেছে উত্তরে তখন সে পেয়েছে রাফেল কেলেঙ্কারি, যতবার জনগণ ধর্ষিতার জন্য আওয়াজ তুলেছে ততবার ধর্ষকের গায়ে লেগে থাকা গেরুয়া রঙ দেখে তাকে রাষ্ট্র শক্তি দিয়েছে তাকে তিরঙ্গার নীচে আশ্রয়। পদ্মবাহিনী তাদের জঘন্য এই স্বপ্নকে পরিপূর্ণ করতে এই ছয় বছরে আরো কী কী ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ গ্রহণ যে করছে তার ইয়ত্তা নেই।
কিন্তু গত বছর ‛এনআরসি’ নামক দ্বিচারী শব্দ যখন প্রথম মোদী-শাহর মুখে উচ্চারিত হয়েছিল সেদিন মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছিল, ১১ই ডিসেম্বরের যখন তাদের উচ্চারিত কথাটি সিএএ নামক আইন হিসেবে পার্লামেন্ট পাশ হয়েছিল সে দিন জ্বালামুখীর মত ফেটেছিল কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর সর্বত্র। কারণ এই কালো কানুন দিয়ে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ভারতের আর্দশ, যা মেনে নেওয়া প্রকৃত দেশবাসীর পক্ষে সম্ভব ছিল না।
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে বিশ্ব দেখেছিল ভারতের অতীত ঐতিহ্যের ছবি, দেখেছিল সেই বিদ্রোহী ভারতকে যার বিদ্রোহের রঙটা বেশ মনোরম। ডিসেম্বরের শৈত্য সেদিন হার মেনেছিল রাজপথের অন্যায়ের বিরুদ্ধে হুংকারের উত্তাপে। আয়শা, লাদিদার সাহস থেকে জন্ম নেওয়া আন্দোলনকে খুব সযত্নে লালন করেছিল দাবাং দাদির দল। তিলোত্তমার মত নগরে নগরে অবগুণ্ঠিত নারীর দল জ্বেলেছিল রাতজাগা শাহীনবাগ। গুঞ্জা কাপুর, বিরিয়ানি, পাকিস্তান, ‛গোলী মারো …. কো’ সহ সব ষড়যন্ত্র সেদিন ফিকে হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনের সৌন্দর্যের কাছে। কারণ এই আন্দোলনে মুসলিম আন্দোলনকারী পাতে যে খাবর থাকতো তা আসতো শিখদের হাঁড়ি থেকে।
হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খৃষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৈরী করে ছিল এমন এক কঠিন ব্যুহ যা ভেদ করার শক্তি ছিল না মোদী-শাহের। তাই তারা কখনো হাতে তুলেছিল বন্দুক, কখনো বা লেলিয়ে দিয়েছিল অর্ণব গোস্বামীর মতো বেশ কিছু পা চাঁটা সারমেয়র দল। বাতাসে গুঞ্জরিত ‛আজাদী’ স্লোগানে, ধর্ণা মঞ্চে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের বৃদ্ধ কণ্ঠে ভেসে ওঠা ‛আমি বাংলায় গান গায়’, কবির সুমনের গিটারের ঝঙ্কারে মুখরিত দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল চারপাশে যেন সৃষ্টি হয়েছে বসন্তের আবেশ।
প্রায় সত্তরটি প্রাণের বিনিময়ে এই আন্দোলন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তার লাভ করেছিল বিদেশের মাটিতে। ভারতের জনতা সমস্তরকম জড়তা, নীরবতা দূর করে এরকমভাবে যে জাগতে পারে তা ছিল স্বপ্নাতীত। সংবিধান রক্ষার এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে সামিল হয়েছিল সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ এবং তা দেখে ভিমরী খেয়েছিলা শাসক গোষ্ঠি। এই আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে শাসক শ্রেণী লেঠেল বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছাত্রীদের উপর, শুরু হয়েছিল গণ গ্রেফতার এমনকি এই আন্দোলনকে শেষ করতে বিজেপি সরকার ঘটিয়ে ছিল দিল্লির গণহত্যা এবং খুব কৌশলের সাথে গণহত্যাকে দাঙ্গা বলে চলানোর প্রয়াস করেছিল।
সমগ্র বিশ্বের সাথে সাথে ভারতের মাটিতে কোভিডের প্রকোপ যদি শুরু না হত কোনভাবেই এই আন্দোলন থামতো না। এই অ্যান্টি সিএএএ আন্দোলন মানুষের অধিকারের আন্দোলন তাই কোভিড প্রকোপ শুরু হতে আন্দোলনকারী স্বেচ্ছায় এই আন্দোলন স্তিমিত করেন। কিন্তু শাসক গোষ্ঠী করোনার আবহাওয়াতেও বজায় রেখেছিল জুলুম অত্যাচার। মানবিকতার সমস্তরকম গণ্ডি পেরিয়ে অন্তঃসত্বা সাফুরা জারগরকে জেলের অন্ধকার কুটুরিতে বন্ধ করে রেখেছিল। নতুন ইউএপিএ আইন করে অব্যাহত রেখেছে তাদের গণ গ্রেফতার। আজও জেলের ওপারে থাকা আসিফ তানহা, উমর খালিদের নেই কোনও খবর।
নতুন কৃষি বিল যাকে কৃষি বিল কম আদানি বিল বেশি বলা যেতে পারে তাকে কেন্দ্র করে ডিসেম্বর আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আবার জণগণ জেগেছে। কৃষকদের সাথে বেইমানি সকলের সাথে বেইমানি। কৃষকদের সাথে ধীরে ধীরে সকল মানুষ সামিল হচ্ছে এই আন্দোলনে। সম্প্রীতির বাতাবরণে ফিকে হয়ে যাচ্ছে তীব্র শীতে জল কামানের আঘাত। তবে এই আন্দোলনে তারা সামিল হবে না যারা দিনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাদের প্লেটে দেওয়া খাবারটা গোবর মনে করে ভক্ষণ করে থাকে। ধীরে ধীরে যে হারে এই আন্দোলনের পারদ চড়ছে আমার দৃঢ় বিশ্বাস দেশবাসী তাদের সাথে ঘটা প্রতিটি অন্যায়ের মোক্ষম জবাব এবার দিয়েই ছাড়বে। দাবাং দাদী বিলকীস বাণু, কৃষি আন্দোলনে সামিল মাহিন্দ্রা কৌর এবার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে সমস্তরকম অবিচারকে চৌচির করে ভারতে আনবে এক নতুন প্রভাত, যে প্রভাতে হেসে উঠবে ভারতের প্রতিটি শিশু, যেই প্রভাতের শীতল সমীরণে ভিন্নতার মধ্যে ঐক্যের আদর্শ নিয়ে পতপত করবে তিরঙ্গা, যে প্রভাতের আলোর তীব্রতাই ভেঙে যাবে অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পের বদ্ধ কুঠির। অত্যাচারী রথী মহারথীদের ‛চাক্কা জাম’ হবেই এই আন্দোলনের তীব্রতাই।
লেখিকা: রিসার্চার, সোসিও এডুকেশনাল রিসার্চ সেন্টার (সার্ক)