Friday, November 22, 2024
Latest Newsফিচার নিউজরাজ্য

গ্রাউন্ড রিপোর্ট: ঠিক কি ঘটেছিল হুগলির তেলিনি পাড়ায়? কি বলছে সরেজমিন তদন্ত?

দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : ঘটনাস্থল তেলিনি পাড়া। হুগলী জেলার ভদ্রেশ্বর শহরের লাগোয়া এক ছোট্ট জনপদ। সারা পৃথিবী যখন নোভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে নাজেহাল এবং যুদ্ধে ব্যস্ত, কলকাতার থেকে ৪০ কিমি উত্তরে এই মফস্বল শহর তখন লড়াই দেখেছে সাম্প্রদায়িক টানাপোড়েনের। গত ১২ই মে থেকে সেই জনপদ আতঙ্কে কাঁটা হয়ে আছে।

তেলিনিপাড়া, গঙ্গা নদীর পশ্চিমপাড়ে একদা পাট প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের জন্য পরিচিত এক মফস্বল। হুগলী সংসদীয় ক্ষেত্রের অন্তর্গত। গত ১০ই মে, রবিবার, বিকেলে এলাকায় প্রথম কিছু তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি হয় দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজনের, যা পুলিশি মধ্যস্থতায় শেষমেশ মিটেও যায়। ১১ই মে, সোমবার, ছিল নির্ঝঞ্ঝাট। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে গেল ১২ই মে, মঙ্গলবার থেকে। তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে, হঠাৎ এলাকায় দলে দলে ভিড় বাড়াতে দেখা যায় কিছু লোককে, তাদের মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় সুপরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আক্রমণ। একতরফা সেই হামলায় এলাকা নিমেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। পরিস্থিতির বিপদ বুঝে জেলাশাসক সেদিনই এলাকায় জারি করেন ১৪৪ ধারা, তড়িঘড়ি ইন্টারনেট পরিষেবা স্থগিত করা হয় পার্শ্ববর্তী দুই মহকুমা শ্রীরামপুর এবং চন্দননগরের সাথে। এই দুই মহকুমার মাঝবরাবরই ভদ্রেশ্বর এবং তেলিনিপাড়ার অবস্থান।

১৫ই মে বৃহস্পতিবার, ‛দ্য ওয়্যার’-এর সংবাদ প্রতিনিধি সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন আক্রান্ত এলাকা। কলকাতা থেকে গ্র‍্যান্ড টাঙ্ক (জিটি রোড) রোড বরাবর এগিয়ে এলাকায় পৌঁছোনোর পথেই ভদ্রেশ্বরের বাবুবাজার মোড়ে নজরে পড়ে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত দোকান। এরপরেই ডানদিকে বেঁকে রাস্তা গেছে তেলিনিপাড়ার দিকে। আধপোড়া কয়লা হয়ে যাওয়া দোকানের নামফলকে “সাদ” শব্দটি তখনও স্পষ্ট পড়া যায় (অর্থাৎ কোনো মুসলিম দোকানীর বিপনী এটি)। ভদ্রেশ্বর ফায়ার ব্রিগেডের উল্টোদিকেই নজরে আসে ভাঙচুরে লণ্ডভণ্ড একটি মাজার (মুসলিম সমাধিসৌধ এবং প্রার্থনাস্থল), রাস্তা থেকেই দিব্যি নজরে আসে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে থাকা ইঁট, প্লাস্টার, টাইলস আর ছিন্নভিন্ন করে মেঝেতে ছড়িয়ে দেওয়া মুসলিমদের ধর্মীয় পতাকা।

ভদ্রেশ্বরের বাজার পেরোনোর সময় কানে আসে হাওয়ায় ভাসা গুঞ্জন আর আলোচনা। সেসব এই তেলিনিপাড়ার ঘটনা নিয়েই। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতিতে কোনো উত্তেজনা নেই। সেই শান্ত পরিবেশ থমথমে নিষ্প্রাণতায় পাল্টে গেল ডানদিকে বেঁকে দিনেমারডাঙা স্ট্রিট বরাবর তেলিনিপাড়া ঘাটের দিকে এগোতেই। পথ আটকালো পুলিশের ব্যারিকেড। গাড়ি আর যাবে না। এবার পায়ে হেঁটে তাই পৌঁছোনো আক্রান্ত এলাকার অলিগলিতে। রাস্তায় লোকচলাচল প্রায় নেই। যে দু একজন কাজের তাড়নায় বাইরে বেরোতে বাধ্য হয়েছেন, আতঙ্ক আর অসহায়তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে তাঁদের চোখেমুখে।

দেখা গেল, তেলিনি পাড়া ঘাটের ঠিক আগেই, রাস্তার শেষমাথায় স্পেশালাইজড ইন্ডিয়ান রিজার্ভ ব্যাটেলিয়নের (SIRB) জওয়ানরা পাহারায় রয়েছেন। এক জওয়ান ‘দ্য ওয়্যার’ প্রতিনিধিকে জানান, তাঁরা রয়েছেন সংখ্যায় প্রায় জনা তিরিশ এবং চলছে সারাদিন সারারাত ধরে টহলদারি।

দিনেমারডাঙা রাস্তার মোড় থেকে বাঁদিকে রাস্তা গেছে ইদানীং পরিত্যক্ত গোঁদালপাড়া জুটমিলের দিকে। দুবছর হলো বন্ধ এই চটকল। একটু এগিয়েই বাঁদিকে আবার সরু গলি, ফেরিঘাট স্ট্রিটের দিকে নিয়ে যায় এই পথ। পথ থামে তেলিনিপাড়া ঘাটে এসে। জিটি রোড থেকে টানা দিনেমারডাঙা স্ট্রিটের এই মোড় অবধি পুরোটাই মূলত হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকা। সেখানেই প্রথম পা রাখা।

নাহ্, এখানে আগাগোড়া তেমন কোনো ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগের চিহ্ন নেই। দিনেমারডাঙা স্ট্রিটের শুরুতে শুধু দুটো জ্বালিয়ে দেওয়া গাড়ির দেখা মিলেছিল। সরকারি ওয়েবসাইটে তারই একটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর যাচাই করে ‘দ্য ওয়্যার’ জানতে পেরেছে যে, এর মালিকের নাম গুলাম সারওয়ার আনসারি। বাকী গাড়িটা যেভাবে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, তার দেহে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার প্লেটের কোনো অবশেষ ছিল না এবং তার মালিকের সনাক্তকরণ করা যায় নি।

তবে এই এলাকায় কিছু লোকজনকে ১২ই মে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক ঘটনার প্রসঙ্গে ‛ঠিক কী হয়েছিল’ জিজ্ঞেস করার পরে, সবারই কেমন সিঁটিয়ে থাকা অনীহায় উত্তর এসেছে “আমরা ওসব ব্যাপারে কিছু জানি না”, এমনকী এক স্থানীয় মুদি দোকান সামলানো এক মহিলার গলাতেও সেই তোতাপাখির বুলি। প্রশ্ন করা হয়েছিল – “এই পুড়ে যাওয়া গাড়িগুলোর মালিক কারা জানেন?” উত্তর এসেছে “আমি জানি না”… “১২ ই মে কখন ঘটেছিলো এই হানাহানি?” সে প্রশ্নেও গৎবাঁধা একই উত্তর দিয়েছেন মহিলা।

সব মিলিয়ে একটা পরিকল্পিত নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে নিশানা করার ছবিই উঠে এসেছে বারবার

দিনেমারডাঙা মোড় থেকে গোঁদালপাড়া মিলের দিকে যেতে যেতে পার হতে হয় মুসলিম বসতিপ্রধান এলাকা। এই পথের আশেপাশে একের পর এক চোখে পড়েছে দরজাভাঙা, জানালাভাঙা ঘরবাড়ি, পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া টেলিভিশনের কেবল, তাপে গলে গিয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে পড়া বৈদ্যুতিক তারের জটলা, এবং দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত কিছু ছোটো ছোটো বাড়ি – যাদের ছাদ উড়ে গেছে এবং দেওয়াল ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে। আর বাড়িগুলো এভাবেই তছনছ হয়েছে প্রচন্ড আগুনের আঁচে বিস্ফোরিত গ্যাস সিলিন্ডারের আঘাতে। চোখে পড়েছে দুটি বাড়ির থেকে, ঘটনার তিনদিন পরে, তখনও বেরোচ্ছে কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী।

তান্ডবে আক্রান্ত এলাকার পথ বেয়ে এগোতে এগোতে চোখ টেনেছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাঙা সামগ্রীর স্তুপ, প্রচুর পাথর, লোহার রড, বাঁশের লাঠি আর অনেক অনেক আস্ত বা গুঁড়িয়ে যাওয়া বোতল, যাদের শরীর এখনো কেরোসিনের তীব্র গন্ধে মাখামাখি।

কী আশ্চর্য! দেখে অবাক লেগেছে, মুসলিম দোকানদারের ফোটোকপি কিংবা মুদিসামগ্রী কিংবা মাংসের দোকান আগুনে জ্বলে পুড়ে আংড়া হয়ে গেছে অথচ তার পাশেই হিন্দু দোকানিদের মুদি বা দর্জির দোকান দিব্যি নিজের চকচকে চেহারা নিয়ে ফিটফাট দাঁড়িয়ে। এদের গায়ে যেন আঁচড়ও পড়েনি। দেখা গেছে রাস্তা জুড়ে ইতিউতি দলা পাকিয়ে থাকা জ্বলে যাওয়া ব্যাটারিচালিত রিকশা, সাইকেল, মোটরবাইক, ছোটো মালবাহী গাড়ির স্তুপ।

তারই মাঝে একটা হিন্দুবাড়ি, দরজায় ‛ওঁ’ লেখা, তারও একদিকের দেয়াল আগুনে কালো হয়ে ধ্বসে গিয়েছে দেখে বিস্ময় জাগে। অথচ অন্যদিক যথাযথ রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় মানুষ জানালেন – ধ্বসে যাওয়া দেয়ালের পাশের বাড়িটিই এক মুসলিম পরিবারের। তাদের বাড়িতে আগুন ধরানোয় এবং গ্যাস সিলিন্ডারে বিস্ফোরণেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ওই প্রতিবেশী হিন্দু বাড়ির একদিক।

অকুস্থলেই তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসারের দেখা মিললো। প্রশ্ন করা হল “এই হিংসাত্মক আক্রমণ কি পরিকল্পিত এবং একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করেই হয়েছে?” নাম না প্রকাশের শর্তে উত্তর এল – “পাশাপাশি হিন্দু মুসলিমের দোকানগুলো দেখুন, বেছে বেছে মুসলিমদের দোকানগুলোকেই ধ্বংস করা হয়েছে। এই কাজে এই এলাকার স্থানীয় লোকজনের কেউ অবশ্যই জড়িত, নাহলে এত নিখুঁতভাবে এলাকার মুসলিম বাসিন্দাদের বাড়ি ও দোকান সনাক্ত করা কোনো বহিরাগতের একার পক্ষে সম্ভব হতো না। মুড়ি মুড়কির মতো যে পরিমান পেট্রল বোমা ব্যবহার হয়েছে এই আক্রমণে তাতে এটাও স্পষ্ট যে হানাদাররা পূর্বপরিকল্পনাসহ পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল।” তবে তিনি এও জানালেন যে ১২ই মে’র পর থেকে আর কোনো আপত্তিজনক ঘটনা ঘটে নি। পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে।

বিভীষিকায় হতচকিত কিছু ব্যক্তির বয়ান

মহ. মুস্তাক (৫৩), এলাকায় কেবল্ টিভির ব্যবসায়ী এবং একটি ফোটোকপির দোকান আছে তাঁর। ১২ই মে বিকেলে নিজের চোখের সামনে দেখেছেন মুখোশপড়া একদল মানুষ কী ভাবে জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাঁর দোকান, লুঠ করছে ঘরবাড়ি। নিজের কানে শুনেছেন হানাদারদের উল্লাসধ্বনি – “জয় শ্রী রাম”। বললেন – “ওরা এসেছিল অগুন্তি লোহার রড, লাঠি, পেট্রল বোমা নিয়ে। এসেছিল আমাদের ধ্বংস করতে… তাঁর নতুন কেনা ফোটোকপি মেশিন বরবাদ হয়ে গেছে আগুনে। বারবার হাত জোড় করে মিনতি করেছেন হানাদারদের, যাতে এভাবে বাড়িঘর দোকান ভেঙে জ্বালিয়ে ক্ষতি না করে। কেউ শোনে নি। এখন তাঁদের পরিধেয় বস্ত্রটুকু ছাড়া আর কিচ্ছু নেই…” বলতে বলতে কান্নায় গলা ধরে এসেছে মুস্তাকের।

মুস্তাকের ৮৩ বছরের অশক্ত বাবা বসে আছেন, পথের কিনারে। ভেঙেপড়া ভঙ্গিমায় হাত জড়িয়ে ধরেছেন সাংবাদিকের, গলায় কান্না আটকে ছিল দলা পাকিয়ে…. কথা বলতে পারেন নি।

শাবানা খাতুন, মুস্তাকের স্ত্রী। অল্প কথায় শুধু বলেছেন – ফোটোকপি সেন্টারের পাশেই ওনাদেরই আরো দুটো দোকান আছে। ভাড়ায় দিয়েছেন দুই হিন্দু ভাইকে…. সেই দোকানের গায়ে আক্রমণের আঁচ পর্যন্ত লাগেনি। এরপরেও কী কোনো প্রমাণ দরকার যে শুধু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিশানা করেই, পরিকল্পনামাফিক ঘটানো হয়েছে এই হিংসা? সঠিক প্রশ্ন তুলেছেন শাবানা।

স্থানীয় বহু লোকের অভিযোগ, ঘটনার দিন এলাকায় পুলিশ পৌঁছোতে দেরী হয়েছিল অনেক। তার মধ্যেই অনেকখানি ক্ষতি হয়ে গেছে। মহ. আনসারি, যাঁর নিজের বাড়িও পেট্রল বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত, নিজে সহ্য করেছেন দুর্বৃত্তদের ছোঁড়া পাথরের আঘাত, জানালেন – বেলা ১২.৩০ থেকে ১ টা নাগাদই খবর আসে, একদল বাইরের লোক গোঁদালপাড়া মিলের দিক থেকে মুসলিম অধ্যুষিত পাড়ায় ঢুকছে। তাদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে এবং তারা মুসলিমদের বাড়ি লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা ছুঁড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পুলিশের ১০০ নম্বরে ফোন করেন, ভদ্রেশ্বর থানাতেও ফোন করে পরিস্থিতির দুরাবস্থা জানান। তাঁর ভাই ফায়ার ব্রিগেডে ফোন করেন। কিন্তু পুলিশ এসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে বেলা ২.৩০ বেজে যায়। তাও প্রথমে আসে মাত্র ১০-১২ জন পুলিশের একটি দল, দুর্বৃত্তরা পুলিশকেও পাথর ছুঁড়ে আক্রমণ করে। যতক্ষণে পুরো বাহিনী নিয়ে পুলিশ আসে বিকেল চারটে বেজে গেছে, যা ক্ষতি হওয়ার ইতিমধ্যে তা ঘটেই গেছে।

ছোট ঘটনা, বড় ষড়যন্ত্র

এস. কে.শামসুদ্দিন জুটমিলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, জানালেন, ১০ই মে রবিবার সন্ধেবেলা ঘটা সেই ছোট বচসার কথা। তেলিনিপাড়া ঘাটের জনশৌচালয় ব্যবহার করা নিয়ে হয় সেই বচসা। শামসুদ্দিনের প্রতিবেশি রাজকুমার রায় সাংবাদিকদের জানালেন – মুসলিম এলাকায় কারো করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে এমন একটা খবর কানাঘুষো উড়ে বেড়াচ্ছিল এলাকায়। সেই শুনে হিন্দুদের একাংশ ওই জনশৌচালয় ব্যবহার করতে মানা করে মুসলিমদের। দুই সম্প্রদায়ের লোকের মধ্যে এ নিয়ে হাল্কা বচসা, কথা কাটাকাটিও হয়। আরেক স্থানীয় দিনেশ সাউ জানালেন যে সেই সমস্যা স্থানীয় পুলিশের হস্তক্ষেপে মিটেও যায় একটু পরেই। এরপর ১১ই মে নির্বিঘ্নেই কাটে। কিন্তু ১২ই মে এভাবে সেই ছোটো ঘটনার অজুহাতে যে দাঙ্গা লাগানোর ষড়যন্ত্র করা হবে, সেটা সত্যিই বিস্ময়কর। দিনেশ বাবুর ভাষায় – এখন দুই সম্প্রদায়ের মানুষই অশান্তি আর আতঙ্ক নিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। এটা মোটেই কাম্য নয়।

শামসুদ্দিন বাবু নিজেও হানাদারদের আটকাতে গিয়ে আহত হন। তবে তিনি দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন – এখানে বসবাসকারী হিন্দু দুগ্ধ-বিক্রেতা সম্প্রদায় এই বহিরাগত দুর্বৃত্তদের রুখে দিতে সদলবলে এগিয়ে না এলে, পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আরো খারাপ হতো।

গোঁদালপাড়া থেকে পরের গন্তব্য ফেরিঘাট স্ট্রিট (ভদ্রেশ্বর পুরনিগমের ৯ নং ওয়ার্ডের অংশ)। পথিমধ্যে সরু কালভার্ট। দিনেমারডাঙা মোড় আর মসজিদ রোডের যোগসূত্র। সাংবাদিকরা দেখতে পেয়েছেন কালভার্টের নীচে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা গ্যাস সিলিন্ডার, মোটরবাইক, আরো কিছু গৃহস্থ সামগ্রী… লুন্ঠনকারীর ছেড়ে যাওয়া পায়ের দাগ।

কালভার্টের পাশেই বসা দুই SRIB জওয়ান। গত ১১ ঘন্টা ধরে ডিউটি করে চলেছেন। সাংবাদিকদের প্রশ্ন শুনে সহজ সত্যিটাই বলে ফেললেন – “আপনারা সাংবাদিক, খবর সংগ্রহে এলাকায় এসেছেন, এবার স্বচক্ষে দেখে নিন, কোন সম্প্রদায়ের সম্পত্তি ধ্বংস করা হয়েছে। এত পেট্রলবোমা ব্যবহার হয়েছে সেদিন যে সারারাস্তার আনাচ কানাচ পর্যন্ত কাচের টুকরোয় ভরে যায়। মনে হয় সেই সাথে অ্যাসিডও ছিল, দেয়ালে দেয়ালে যেখানে পড়েছে, দেখুন রং চটে গেছে।” দ্বিতীয় জওয়ান বললেন – “আমাদের সম্বল বলতে শুধু লাঠি। কোনো প্রতিরক্ষক বা প্রাণঘাতী অস্ত্রও নেই। সেই নিয়ে ওই ৫০০-৬০০ উন্মত্ত হানাদারদের লাঠি রড, ঢাল, পেট্রলবোমার আক্রমণ কি ঠেকানো যায়, না যোঝা যায়?”

এক ওষুধের দোকানে খবরকাগজ পড়ছিলেন বিশ্বনাথ শিকদার, দ্য ওয়্যার’কে জানিয়েছেন – “ছোটোখাটো গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা সাম্প্রদায়িক চাপানউতোর আগেও তেলিনিপাড়ায় হয়েছে, কিন্তু এভাবে, এরকম পরিকল্পিত দাঙ্গার পরিস্থিতি, নৈব নৈব। এখন সব সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষই অকথ্য বিভীষিকার ভোগান্তি পোয়াচ্ছেন।”

এলো ওরা নদীর ওপার থেকে

এম.ডি.সেলিম, পুড়ে ঝলসে যাওয়া বাড়িটাকে দেখিয়ে বলছিলেন – “এখানে পাঁচটা বাড়ি একসাথে একগোছা। একই দেয়ালের এপিঠ-ওপিঠে। ওরা সেদিন এতজন এত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা করেছে যে আমরা রুখতে পারিনি। এই বাড়িগুলো সব পুড়ে শেষ হয়ে গেছে। একটা ঘরে গ্যাস সিলিন্ডারও ছিল। তখন দাউ দাউ আগুন চারিদিকে। কোনোমতে সিলিন্ডারটা বাইরে এনে বালি চাপা দেওয়া গেছে। আর পাঁচ মিনিট দেরী হলেই আরো বড় বিপদ হতো।”

তেলিনিপাড়ার একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গার নিম্নগতি। এখানে গঙ্গার নাম হুগলী নদী। নদীর অপরপারেই ‛জগদ্দল’। জেলা উত্তর ২৪ পরগণা, ব্যারাকপুর সংসদীয় ক্ষেত্র। এই কেন্দ্রের সাংসদ বিজেপির অর্জুন সিং। সেলিমের সোজাসুজি অভিযোগ, অর্জুন সিংএর দলবলই সেদিন ছোটো ছোটো নৌকো বেয়ে অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করে এসেছে নদীর ওপার থেকে। গোঁদলপাড়া জুটমিলের পাশ দিয়েই তারা তেলিনিপাড়ায় ঢুকেছে দাঙ্গা বাধাতে।

 

ফেরিঘাট স্ট্রিটের গায়ে লাগোয়া একটি বাড়ি পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর এম.ডি. নিহাল’এর। ভাঙচুর চলেছে তাতেও। পাশের বাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে এবাড়ির দেয়ালে চিড় ধরেছে জায়গায় জায়গায়। বাড়ি তালাবন্ধ পড়ে আছে। স্থানীয়রা জানালেন – ইন্সপেক্টর নিহাল চাকুরিসূত্রে বদলি হয়ে এখন বসিরহাটে থানায় কর্মরত। সেইজন্যই এই বাড়িতে তালা। সপরিবার বসিরহাটেই রয়েছেন পুলিশবাবু। নিজেরা বেঁচে গেছেন, কিন্তু বাড়িটা ছাড় পায়নি পুলিশেরও।

গলির ঠিক মাথায় মুখোমুখি মহ. আনিসারির সাথে। গোঁদালপাড়া জুটমিলের প্রাক্তন কর্মী। পাশেই বাড়ি ছিল। দোতলার ঘরে ওনার বৃদ্ধ বাবা থাকতেন। আনসারির বাড়িটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনসারির পাশের বাড়িতেই তাঁর প্রতিবেশী এলাকার পুরপ্রতিনিধি চিত্রা চৌধুরী স্বয়ং। হিংসাত্মক হানাদারির সময় কেউ একবার পাশে পর্যন্ত এসে দাঁড়ায়নি, সাহায্য তো দূরস্থ। জানাচ্ছিলেন আনসারি। বলছিলেন ওঁর বয়স্ক বাবাকে কিভাবে বারবার আঘাত করেছে দুষ্কৃতীরা। পায়ে পড়ে হাত জোড় মিনতিতেও শয়তানরা কর্ণপাত করেনি। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ। আনসারির পোষা গোরুটিকে পর্যন্ত নিয়ে গেছে হানাদার বাহিনী। ওটাই তার রোজগারের একমাত্র সহায় ছিল। এখন কীভাবে হবে অর্থাগম? উত্তর নেই আনসারির কাছে।

পুর প্রতিনিধির সাফাই

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতীকে নির্বাচিত ওয়ার্ড কাউন্সেলার এবং আনসারির প্রতিবেশী শ্রীমতী চিত্রা দেবীর স্বামীও কংগ্রেস নেতা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে পরপর এই এলাকার কাউন্সিলর পদে আছেন বিগত ২৫ বছর ধরে। আনসারির বিপদে তাকে বাঁচাতে গেলেন না কেন?….চিত্রা চৌধুরীর পাল্টা প্রশ্ন – ঘরে এখন আমার পুত্র এসে রয়েছে, আমি তাকে বাঁচাবো, নিজে বাঁচবো, নিজের পরিবার আগে বাঁচাবো না প্রতিবেশীকে রক্ষা করতে যাবো?…আর ওই মারাত্মক বোমাবাজিতে দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি কীই বা করতে পারতাম?…বেশ, এলাকাবাসীর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া যদি কাউন্সিলরের প্রথম নৈতিক দায়িত্ব নাও মনে করেন, ক্ষতিগ্রস্ত এবং আক্রান্তদের পাশে এই ঘটনার পরেও একবার গিয়ে দাঁড়ান নি কেন?…চিত্রা দেবীর নির্লিপ্ত, নিরুৎসাহিত, দায়সারা উত্তর ছিল – “আমার কি কিছু করার ক্ষমতা আছে! তাহলে আমি গিয়েই বা কী করতাম আর যাবোই বা কেন?”

শুধু কাউন্সিলর নন। স্থানীয় মানুষ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, বিপদে তাঁদের পাশে এসে কোনো রাজনৈতিক নেতাই দাঁড়াননি। এমনকি তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় বিধায়ক, রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী ইন্দ্রনীল সেন, তিনিও না। অবশ্য জনতা এও জানিয়েছে যে ভোটের আগেই একমাত্র বিধায়কমশাই এই কেন্দ্রে বারবার পায়ের ধুলো ছড়াতে আসেন। দ্য ওয়্যারের তরফেও মন্ত্রী মশাইকে বহুবার ফোনে ও টেক্সট মেসেজে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় (১৬ ই মে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা অবধি)। সাড়া মেলেনি।

চন্দননগর পুলিশ কমিশনারেটের অধীনে পড়ে তেলিনিপাড়া। পুলিশ কমিশনার হুমায়ুন কবির দ্য ওয়্যার কে জানিয়েছেন – রবিবারের (১০ই মে) বচসা বিরোধ খানিক স্বতঃস্ফূর্ত হলেও, মঙ্গলবারের (১২ই মে) ঘটনাটি সুপরিকল্পিত, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং যথিরীতি সংগঠিত। পুলিশ এ পর্যন্ত এই হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৯১ জনকে গ্রেপ্তার করে কোর্টে পেশ করেছে এবং কোর্ট তাদের ১৪ দিনের জেল হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। ঘটনার পরেপরেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ৩৫ জনকে।

তথ্য রোপণ ও সাজানো সাম্প্রদায়িক আবেগ সঞ্চারের চেষ্টা এবং ভুয়ো খবরের ভাঁওতাবাজি

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে হগলী সংসদীয় আসনের বর্তমান সাংসদ লকেট চ্যাটার্জির সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে দ্য ওয়্যার। তাঁর কাছ থেকেও এখনো কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় নি।

বরং বিজেপি নেতা কৈলাস ভিজয়বর্গীয় ১২ই মে বিকেলের দিকে যে ট্যুইট বার্তাটি প্রকাশ করেছেন তাতে লকেট মহাশয়াকে একটি ভিডিওয় বলতে শোনা যাচ্ছে – হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি প্রচুর বিপন্ন স্থানীয় মানুষের ফোন পাচ্ছেন। এটা একতরফা যুদ্ধের সমতূল।
তিনি রাজ্যসরকারী প্রশাসনকে দোষারোপ করেও ক্ষিপ্ত হয়ে জানাচ্ছেন – রাজ্য সরকারী শাসনযন্ত্র এই পরিস্থিতিতে নীরব দর্শক। তেলিনি পাড়া আগুনে জ্বলছে।

একই ভাঁওতাভাষ্য রোপণ করে সমাজমাধ্যমেও প্রচুর মিথ্যে সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে দেওয়া হয় মানুষের মধ্যে। উগ্র হিন্দুদের পক্ষে সহানুভূতি সঞ্চয় করতে এই মিথ্যাচারে বলা হয় – তেলিনি পাড়ায় হিন্দুরা বিপন্ন। উইকিনিউজ পেজে ১২ই মে, ২০২০ এই ভুয়ো সংবাদটির শীর্ষক হয় – ‛2020 Telinipara Anti-Hindu Pogrom’

এখানেই শেষ নয়। দ্য ওয়্যার লক্ষ্য করেছে – পাশাপাশি ‛আনন্দবাজার পত্রিকা’ নামের আড়ালে একটি ভুয়ো অনলাইন নিউজ পোর্টাল খুলে সেখানেও একইভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষমূলক মুসলিম বিরোধী উগ্র হিন্দু মন্তব্য প্রকাশ করা হচ্ছে। তেলিনি পাড়ায় হিন্দুদের বিপন্ন আক্রান্ত বলে মিথ্যে প্রচার চালানো হচ্ছে। লক্ষ্যনীয় যে পশ্চিমবঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিকের নাম করে এই ভুয়ো সংবাদ সূত্রটি ৭ই এপ্রিল অ্যাক্টিভেট করা হয় এবং ঘটনার কদিন কাটিয়ে ধরা পড়ার পরে তা বন্ধও করে দেওয়া হয়। [প্রসঙ্গত : বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ এ বিষয়ে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মূখ্যসম্পাদককে অবগত করে এবং তাঁরা জানিয়েছেন ইতিমধ্যেই তাঁরা এই ভুয়ো পোর্টালের প্রচারকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন এ নিয়ে বা.স.ম ফেসবুক পেজে ইতিমধ্যেই আমরা বিস্তারিত জানিয়েছি দুদিন আগেই – বা.স.ম ]।

এই ভাঁওতাবাজির মুখোশ খুলে দিয়ে “ইন্ডিয়া ট্যুডে – ফ্যাক্ট চেক” থেকে স্পষ্ট জানানো হয়েছে যে, তেলিনি পাড়া নিয়ে এই ভুয়ো তথ্য আর বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ যা একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং অন্যান্য সমাজমাধ্যমে ছড়াতে চাইছে, তার ব্যবহার করা ছবিগুলিও পাকিস্তানের কোনো হিন্দু বিরোধী ঘটনার থেকে আমদানি করা। যার সাথে তেলিনিপাড়ার দূরদূরান্তেরও সম্পর্ক নেই।

শেষকথা

দ্য ওয়্যারের পক্ষ থেকে তিনঘন্টারও কিছু বেশি তেলিনিপাড়ার আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় যে ফিল্ড সার্ভে করা হয়েছে, তাতে স্থানীয় বাসিন্দা, পুরপ্রতিনিধি, পুলিশকর্মী প্রমুখের সাথে কথা বলে এবং ঘটনাস্থলের আসল অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে, নিশ্চিতভাবে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় –

১. মুসলিমপ্রধান বসতি এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি ও মারাত্মক ক্ষতি করা হয়েছে

২. একটি হিন্দু এলাকাতেও (রাজা বাজার) কিছু গৃহসামগ্রীর অংশত ক্ষতি দেখা যাচ্ছে

৩. যে হিংসাত্মক ধ্বংসাত্মক আক্রমণ ১২ই মে তেলিনিপাড়ায় ঘটেছে, প্রাথমিক মূল্যায়নে তা অবশ্যই পূর্বপরিকল্পিত এবং সুকৌশলে সংঘটিত।

৪. ঘটনাস্থলের প্রামাণ্য পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী মুসলিমদের বাড়িঘর এবং দোকানপাট বেছে বেছে আক্রমণ করা হয়েছে। যা সুনির্দিষ্টভাবে ছক কষেই করা সম্ভব।

৫. স্থানীয় মানুষদের অভিযোগ এই আক্রমণের কাজ করেছে বহিরাগত একদল দুর্বৃত্ত, কিন্তু তাদের আক্রমণের আগে নিশানার খুঁটিনাটি তথ্য তাদের সরবরাহ করেছে এই এলাকাবাসী কিছু সহযোগী।

অনুবাদ : প্রান্তিক ঘোষ

[এই ফিল্ড রিপোর্টটি, ১৬ই মে ২০২০ তারিখে ‛দ্য ওয়্যার’ অনলাইন নিউজ পোর্টালে সাংবাদিক হিমাদ্রি ঘোষের কলমে ইংরেজিভাষায় লিখিত এবং প্রকাশিত সংবাদের বাংলা অনুবাদ। বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ এই অনুবাদটি প্রকাশ করছে।]

 

আরও খবরাখবর পেতে যোগ দিন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপে

Leave a Reply

error: Content is protected !!