Friday, November 22, 2024
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদকীয়

দিকে দিকে শাহিনবাগ, গণআন্দোলনে হিজাব যেন নারী শক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে

নিজস্ব চিত্র

আফরিদা খাতুন আঁখি : একজন হিজাব পরিহিতা হিসাবে বেশ ভালো মতোই উপলব্ধি করতে পারি হিজাব দেখলে প্রায় অনেকেরই নাকে আঁশটে গন্ধ আসে, হিজাব ধারণকারী কাউকেই দেখলে দৃষ্টি অভ্যাসের কারণে বাঁকা হয়ে যায় কোন প্রকার চেষ্টা ছাড়াই। তাদের কাছে হিজাব মানেই ভীরুতা, অশিক্ষিত, পিছিয়ে পড়া জাতির চিহ্ন। এই ধারণা কেবল যে অমুসলিম ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যেই বদ্ধমূল তা ভাবা কিন্তু মারাত্মক ভুল, এই ধারণার কঠিন প্রাচীরে বদ্ধ আছে তথাকথিত উদারমনা মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও।

কিন্তু হিজাবকে যতই মনে করা হোক পিছিয়ে পড়া জাতির উপস্থাপক, হিজাবকে যতই প্রগতির অন্তরায়ের প্রতীক মনে করা হোক না কেন, হিজাব কিন্তু একজন নারীর প্রগতির সহায়ক, তা অতীতের মতো আরও একবার প্রমাণ করল। দেশে চলমান সিএএকে কেন্দ্র করে যে আজাদী লড়াই শুরু হয়েছে তা জামিয়ার হিজাব পরিধানকারী ছাত্রীদের গর্জনের ফলেই কিন্তু দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে পরিণত হয়েছে তা গর্বের সাথে জানান দিতে পারি। মারমুখো পুলিশের আক্রমণকে সাহসিকতার সাথে প্রতিহত করা জামিয়ার ছাত্রী দল বিশেষত আয়েশা রেন্না, লাদিদা ফারজানার নেওয়া পদক্ষেপ কেবলই প্রশংসনীয় নয় তা এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আয়েশা রেন্নার হুংকার জিয়ন কাঠির ছোঁয়ার ন্যায়ে ভারতবাসীদের জাগিয়ে তুলেছে এক গভীর ঘুমে হতে, ফিরে পেয়েছে তার আপন স্বত্বা, মেতে উঠেছে আজাদীর উৎসবে। কেবলমাত্র ভারতে অবস্থিত ভারতীয়রা না অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, মেলবোর্ন বিশ্বের প্রতিটি কোণে অবস্থিত ভারতীয়রাও জেগে উঠেছে আজ জামিয়া কন্যাদের হুংকারে। এই লড়াই কে আজাদীর রঙে রাঙিয়েছে প্রবল শৈত্য কে উপেক্ষা করে খোলা আকাশের নিচে অবস্থানরত শাহিনবাগের দাদী সহ হাজার হাজার অবগুণ্ঠিত মুসলিম নারীর দল। আর এই আজাদীর লড়াইকে দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত করেছে কলকাতার পার্ক সার্কাসের বুকে জ্বলতে থাকা নির্ঘুম তারার মতো জ্বলতে থাকা হিজাব পরিহিতা ঝাঁক ঝাঁক মুসলিম রমণীর দল। আজ দেশের কোণায় কোণায় রাতজাগা শাহিনবাগ যাপন করছে বিনিদ্র রজনী দেশ প্রেমকে বুকে আগলে রেখে।

এতদিন সেকুলার, মেকী সেকুলার, আধা সেকুলার সকলের কাছেই হিজাব ধারী মুসলিম নারীরা ছিল কেবল সাংসারিক রমণী অথবা বাচ্চা উৎপাদনের যন্ত্র অথবা অধিক সন্তানের অশিক্ষিত মূর্খ জননী। এতো দিন তাদের কলমে লেখা হত মুসলিম নারীদের রন্ধন প্রণালীর গল্প, অল্প বয়সে কোন পুরুষের জীবন সঙ্গী হয়ে ওঠার গল্প অথবা বোরখা কিংবা হিজাবকে মুসলিম নারীদের প্রগতির অন্তরায় হিসাবে উপস্থাপন করে তাতে সাহিত্যের রস মিশিয়ে লেখা হত বেশ বড় মাপের হৃদয়স্পর্শী গল্প, কিন্তু তাদের গল্পতে কখনো ঠাঁই পেত না হিজাব পরিহিতা কোন সাহসী নারীর কাহিনী অথবা হিজাব কে কখনো উপস্থাপন করা হতো না সাহসিকতার প্রতীক হিসাবে। তাদের কলমে সর্বদাই হিজাব পরিহিতা নারীকে উপস্থাপন করা হত হীন অথবা অসহায়া হিসেবে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী তিনশতর অধিক মুসলিম মহিলার একটিরও গল্প কিন্তু ফুটে ওঠে ওঠেনি ওদের গল্পে বরং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ইতিহাসের পাতা থেকে।

মেনে নিলাম আরএসএস-এর কাছে অস্ত্র সাজে সজ্জিত দুর্গা বাহিনী রয়েছে, কিন্তু এই অবগুণ্ঠিত নারীর দলে সামিল আছে আয়েশা রেন্না যার একটা হুংকারে সমগ্র বিশ্ব আজ তোলপাড় হয়েছে, আন্দোলনের প্রতিকৃতি বামপন্থী ছাত্র পরিষদের সভাপতি ঐশী ঘোষ যা পারিনি। ঐশী ঘোষ সিনেমার তারকা দের রাজপথে নামাতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু প্রবল শৈত্য কে উপেক্ষা করে শাহীন বাগের ‛দাদি’রা বিশ্বের বুকে নারী শক্তির প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছে।

যে হিজাবধারীদের সমাজের শেষ সারির, অশিক্ষিত, গোঁড়া, কুসংস্কারচ্ছন্ন হিসাবে উপস্থাপন করা হত, সেই অবগুণ্ঠিত নারীর বুকে যে মহীয়সী আয়েশা(রাঃ), সুমাইয়া(রাঃ) এর আদর্শ রয়েছে লুক্কায়িত। এরা কেবল হিজাব ধারণা করে গৃহের কোণে আবদ্ধ থাকা স্বত্বা নয়, বরং প্রয়োজনে গর্জে ওঠা ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। এদের ইতিহাসের পাতা থেকে বিলীন করা হলেও কালের স্রোতে এদের পুনর্জন্ম ঘটে চলে। সময় হয়েছে এবার আরো একবার ইতিহাস পুনরাবৃত্তির, এবার আমরা মুসলিম নারীরা বলবো আমাদের গল্প, এবার আমরা লিখব বেগম মহল, রোকেয়া, আয়েশা, লাদিদা, প্রতিটি নগরের বুকে রাতজাগা শাহিনবাগ-এর গল্প কারণ সংবিধানের ১৯(২) ধারা আমাদের দিয়েছে হিজাব পরার স্বাধীনতা। হিজাব হবে আমাদের শক্তির প্রতীক দুর্বলতার নয়, হিজাব যেমন আমাদের ধর্মের প্রতীক তেমনি হবে আমাদের আন্দোলনের প্রতীক। হিজাব হোক আমাদের সম্মানের প্রতীক।

লেখিকা বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির ছাত্রী

Leave a Reply

error: Content is protected !!