দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : কলকাতা হাইকোর্টে নজিরবিহীন লজ্জার মুখোমুখি হতে হল মমতা সরকারকে। আদালতে ভরা এজলাসে বুধবার মুচলেকা দিতে হল রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবনারায়ণ স্বরূপ নিগমকে। এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালের প্রাক্তন ডিরেক্টর শ্যামাপদ গড়াইয়ের বকেয়া অর্থ না মেটানোয় বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চে মুচলেকা দিতে হয় রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিবকে।
বুধবার মামলার শুনানিতে বিচারপতি সৌমেন সেন সাস্থ্য সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমকে বলেন, ডাক্তার শ্যামাপদ গড়াইয়ের বকেয়া টাকা মিটিয়ে দিয়েছেন কিনা! উত্তরে সাস্থ্যসচিব জানান হ্যাঁ মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে সমস্ত বকেয়া। কিন্তু আইনজীবী শামিম আহমেদ, অর্ক মাইতি আদালতকে জানান সাস্থ্য সচিব সঠিক বলছেন না। মামলার বয়ান অনুযায়ী আইনজীবী শামিম আহমেদ জানা, রাজ্যে পরিবর্তনের পর থেকেই হাসপাতালে-হাসপাতালে আচমকা পরিদর্শন শুরু করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণার মাসেই ২৬ মে স্নায়ু-চিকিৎসার সেরা সরকারি হাসপাতাল বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন) পরিদর্শনে যান মুখ্যমন্ত্রী।
আউটডোরের ভরা সময়ে সংবাদমাধ্যমের অসংখ্য প্রতিনিধি-সহ মুখ্যমন্ত্রীর সদলবলে হাসপাতালে ঢুকে পড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন বিআইএন-এর তদনীন্তন ডিরেক্টর শ্যামাপদ গড়াই। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে প্রশ্ন করেন, তাঁর অসুবিধা কোথায়? ডাক্তার গড়াই বলেন, মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হাসপাতালে আসায় সমস্যা নেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গে প্রচুর মানুষ হাসপাতালে ঢুকে পড়লে রোগী পরিষেবায় সমস্যা হয়। মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার গড়াইকে পর দিন সচিবালয়ে দেখা করতে বলেন। ডাক্তার গড়াই জানান, তাঁর কয়েকটি অস্ত্রোপচার আছে। ২৬ মে সন্ধ্যাতেই আবার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের প্রধানদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেখানেও হাজির হতে পারেননি ডাক্তার গড়াই।
সে রাতেই সাসপেনশনের চিঠি পাঠানো হয় ডাক্তার গড়াইকে। তার পর বিভাগীয় তদন্ত শুরুরও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়। ডাক্তার পার্থজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জানানো হয় তদন্তকারী অফিসার হিসাবে। কিন্তু তদন্ত একচুলও এগোয়নি। এমনকী ডাক্তার পার্থজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় অবসর নিয়ে নেন ২০১৩-র ৩১ মার্চ। তাঁর চাকরির মেয়াদ বেড়ে ৩১ মার্চ ২০১৪ করা হলেও তদন্ত এগোয়নি।
ডাক্তার গড়াই অপেক্ষায় থাকেন দীর্ঘ দিন। দেখতে দেখতে ২০১৮-য় তাঁরও অবসরের বয়স পেরিয়ে যায়। তদন্ত শেষ হয়নি। ২০১১ থেকে ‘১৮ পর্যন্ত চাকরিকালীন সময়ে তিনি পূর্ণ বেতনও পাননি। অবসরের পর নিয়মমতো পেনশনও চালু হয়নি। ডাক্তার গড়াই প্রথমে স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইব্যুনালের (স্যাট) দ্বারস্থ হন। কিন্তু সুরাহা মেলেনি।
তখন হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তাঁর হয়ে আদালতে সওয়াল করেন বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী শামিম আহমেদ। রাজ্যের তরফে অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত স্যাট-এ চূড়ান্ত নিষ্পত্তির আগে হাইকোর্টে মামলা নিয়ে আপত্তি জানান। মামলা গ্রাহ্য করার বিরোধিতা করেন। রাজ্য সময় চাওয়ায় শুনানি ও রায়দানও পিছোতে থাকে।
শেষমেশ ২৪ এপ্রিল ২০১৯ সালে ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, যে অভিযোগে তদন্ত, কারও অবসরের পর আর সেই তদন্ত চালানোর অধিকার সরকারের থাকে না। অবিলম্বে পূর্ণ পেনশন চালু করা এবং সমস্ত বকেয়া ৮ শতাংশ সুদ-সহ মিটিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্যকে নির্দেশ দেয় আদালত।
ডাক্তার গড়াইয়ের আইনজীবীরা আদালতে প্রশ্ন তুলেছিলেন, তদন্তের নামে সে নিয়ে এতটুকু না-এগিয়ে এক জন অত্যন্ত দক্ষ স্নায়ু-শল্য চিকিৎসকের পরিষেবা থেকে রাজ্যবাসীকে কেন বঞ্চিত করা হল? কেন সুনামের সঙ্গে বরাবর কাজ করে যাওয়া চিকিৎসককে সাড়ে আট বছর কর্মচ্যুত করে রাখা হল? বকেয়া এবং পেনশনের মৌলিক অধিকার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করার কোনও অধিকার সরকারের নেই বলে সওয়াল করেন বিকাশরঞ্জনরা। হাইকোর্ট সেই যুক্তিকেই মান্যতা দিয়েছিলেন।