দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : সালটা ২০১৫, ২৭ ফেব্রুয়ারি। শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ভাষণের উপর আলোচনার পর জবাবি ভাষণ দিচ্ছিলেন। বক্তব্য দিতে উঠে ইউপিএ সরকারের প্রকল্প মহাত্মা গান্ধী রাষ্ট্রীয় গ্ৰামীণ রোজগার গ্যারান্টি যোজনা (এমএনরেগা) নিয়ে ঠাট্টা-তামাসা করতেও ছাড়েননি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর নাটকীয় ভঙ্গিতে কংগ্রেসকে নিশানা করে বলেছিলেন, আমার রাজনৈতিক জ্ঞানবুদ্ধি বলে, মনরেগা প্রকল্প চালিয়ে যাব… আমি এমন ভুল কখনও করতে পারি না, কেননা মনরেগা আপনাদের (ইউপিএ) ব্যর্থতার জলজ্যান্ত স্মারক… স্বাধীনতার ৬০ বছর পর লোককে গর্ত খোঁড়ার জন্য পাঠাতে হল… এই প্রকল্প আপনাদের ব্যর্থতার স্মারক। আর আমি গান-বাজনার সঙ্গে এই স্মারক নিয়ে ঢোল পিটাতে থাকব… সারা বিশ্বকে বলব, এই গর্ত যা তোমরা খুঁড়ছো, এটা তোমাদের ৬০ বছরের পাপের ফল। প্রধানমন্ত্রী যখন কংগ্রেসকে নিয়ে মশকরা করছিলেন তখন সংসদে বিজেপির সাংসদরা হাসাহাসি করছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কথায় আপ্লুত হয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন।
ভাগ্যের কি পরিহাস মাত্র ৪ বছর পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-র প্রকল্প এমএনরেগার উপর ভরসা রাখতে হচ্ছে। এতদিনে তিনি এমন কোনও প্রকল্প আনতে পারেননি যা আপতকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। করোনার প্রকোপে যখন দেশের বিভিন্ন শহর থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা নিজের নিজের রাজ্যে ফিরে আসছেন, তাঁদের রোজগারের ব্যবস্থা করতে তাঁকে আঁকড়ে ধরতে হল মনমোহন সরকারের প্রকল্প এমএনরেগার। কিন্তু লকডাউনের দু’মাস যখন গোটা দেশে শ্রমিকরা রোজগারহীন হয়ে বিভিন্ন রাজ্য থেকে হেঁটে, সাইকেলে নিজের রাজ্যে ফিরতে বাধ্য হচ্ছিলেন। তখন মনরেগাই একমাত্র প্রকল্প যা পালিয়ে আসা গ্ৰামীণ পরিযায়ী শ্রমিকদের খুব বেশি সমস্যার মুখে পড়তে দেয়নি। লকডাউন শুরুর ২ মাস দেশের গ্ৰামীণ এলাকার ২.৬৩ কোটি পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করেছেন বলে সরকারি সূত্রে খবর।
প্রত্যেক পরিবার লকডাউনের ৬০ দিনের মধ্যে ১৭ দিন করে কাজ পেয়েছে। যা তাদের খাওয়া দাওয়া ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ বাবদ পর্যাপ্ত। ২০২০-২১ সালের মার্চ এবং এপ্রিল মাসে মনরেগা প্রকল্পে রোজগারের তুলনা গত বছরের সঙ্গে করা হলে খুব বেশি তফাৎ দেখতে পাওয়া যাবে না। ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে ৫.৪৮ কোটি পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছিল। ওই বছর প্রায় ৪৮ দিন কাজ পেয়েছিল প্রকল্প আওতাভুক্ত মানুষ। এই বছরে লকডাউনের মাত্র ২ মাসে ২.৬৩ কোটি পরিবার এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। মনরেগা প্রকল্পে সব থেকে সুবিধা পেয়েছে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশ। বিজেপি শাসিত রাজ্য হোক, বা অবিজেপি শাসিত রাজ্য। লকডাউনে সময় এই প্রকল্প লক্ষ লক্ষ গরিব পরিবারের দুঃসময়ের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। উত্তরপ্রদেশ এই প্রকল্পের সব থেকে ফায়দা তুলেছে। লকডাউন চলাকালীন গত দু’মাসে ৪০ কোটি পরিবারকে মনরেগা প্রকল্পে কাজ দিয়েছে যোগী সরকার। রাজ্যে ১,০৯১ কোটি টাকা শুধুমাত্র শ্রমিকদের মজুরি হিসেবে খরচ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। যদি কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারের এই প্রকল্পটি ব্যর্থতার স্মারক হয়, তাহলে কেন কেন্দ্র মাত্র ২০ দিন আগে এই প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করল।
২০২০-২১ আর্থিক বর্ষের বাজেটে মোদী সরকার মনরেগা প্রকল্পে ৬১,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। কিন্তু ১৭ মে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন মনরেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ৪০ হাজার কোটি অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করেন। অর্থাৎ মনরেগার বাজেট বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। এই অতিরিক্ত বরাদ্দের কারণ হচ্ছে লকডাউন চলাকালীন এটাই একমাত্র প্রকল্প যা সাধারণ মানুষকে রোজগারের পথ দেখাচ্ছিল গ্ৰামীণ এলাকায়। করোনা ত্রাসে যখন দেশের শ্রমিকদের যে যার রাজ্যে ফিরে আসতে বাধ্য করছিল, রোজগারহীন হয়ে পড়েছিল পরিযায়ীরা, তাদের হাতে কোনও টাকা-পয়সাও ছিল না। রোজগারের অন্য কোনও রাস্তাও ছিল না। এরকম পরিস্থিতিতে মনরেগা প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়ানো ছাড়া মোদী সরকারের হাতে অন্য কোনও বিকল্পও ছিল না। গত বছর জুলাইয়ে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমার লোকসভায় বলেছিলেন মোদী সরকার মনরেগা প্রকল্পকে আর বেশি দিন চালানোর বিপক্ষে। তোমার বলেন, এই প্রকল্প গরিবের পক্ষে, কিন্তু মোদী সরকারের একমাত্র লক্ষ্য গরিবিকে শেষ করা। দেশে গরিবি শেষ করে সরকার মনরেগা প্রকল্পকে তুলে নেবে। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমার যখন এইরকম বক্তব্য রাখছেন, উল্টোদিকে মোদী সরকারের গত চার বছরের বাজেটে দেখা যাচ্ছে লাগাতার মনরেখা প্রকল্পে তাঁরা অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। ২০১৭-১৮ বর্ষে ৪৮ হাজার কোটি ছিল, ২০১৮-১৯ বর্ষে তা এসে দাঁড়ায় ৫৫ হাজার কোটি। ২০১৯-২০ আর্থিক বর্ষে বরাদ্দ বেড়ে হয় ৬০ হাজার কোটি, ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে তা বেড়ে হয় ৬১ হাজার ৫০০ কোটি। লকডাউন চলাকালীন ১৭ মে একলাফে মনরেগা প্রকল্পে বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়।
মনরেগা প্রকল্প ইউপিএ সরকারের তৈরি একটি যোজনা, ২৩ আগস্ট ২০০৫ সালে এই যোজনা সংক্রান্ত বিল পাস হয় এবং ২০০৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি এই প্রকল্পে ২০০ পিছিয়ে পড়া জেলায় চালু করা হয়েছিল। এখন দেশের ৬৪৪টি জেলার গ্ৰামীণ এলাকায় এই প্রকল্প চালু আছে। এই প্রকল্প চালু করার মূল উদ্দেশ্য হল গ্ৰামীণ ভারতে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১০০ দিন যাতে গরিব, পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক মানুষ কাজ পায়।