নিজস্ব সংবাদদাত, দৈনিক সমাচার, কলকাতা: হিন্দু তোষণ বা মুসলিম তোষণ নয়, সাংবিধানিক রাজনীতি হোক, এমনটাই মন্তব্য করলেন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আব্দুল মাতিন। ‘তোষণের রাজনীতি’ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি জানান, “ওদিকে বলছে মুসলিম তোষণ আর এদিকে চলছে হিন্দু তোষণ। তাই তোষণের কোনও প্রয়োজন নেই, সাংবিধানিক রাজনীতি হোক। সম্মানের রাজনীতি হোক। সুবিচারের রাজনীতি হোক। সম অধিকারের রাজনীতি হোক।”
বাংলায় মুসলিম তোষণ, মুসলিম তোষণ করে চেঁচালেও আসলে সংখ্যালঘুদের তেমন উন্নয়ন হয়নি বলে অভিযোগ মুসলিম নেতাদের। আর এই উন্নয়ন না হওয়ার কারণ সংখ্যালঘুদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। অনেকে বলেন, শুধু রাজনীতি করতেই মুসলিম উন্নয়ন নিয়ে রাজনীতি দলগুলো কথা বলে। আদতে তাদের মুসলিম উন্নয়ন করার মানসিকতা নেই। বামফ্রন্ট জামানার দীর্ঘ বঞ্চনার পর তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিম উন্নয়ন কতটা হয়েছে?
১ জানুয়ারি ২০১৫ আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়,”সংখ্যালঘু উন্নয়নের ফানুস ফুটো নবান্নেরই রিপোর্টে।” ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতেই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দফতরের ভার। এবং মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলেছেন, ক্ষমতায় আসার ছ’মাসের মধ্যেই তাঁর সরকার সংখ্যালঘু উন্নয়নের নব্বই ভাগ কাজ সেরে ফেলেছে! যদিও সে দাবির বাস্তবতা নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন নেতা বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকী, বছর দুয়েক আগে রেড রোডে নমাজপাঠের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এই হেন দাবি শুনে মঞ্চ থেকেই কড়া কথা শোনাতে ছাড়েননি বক্তারা। সম্প্রতি সংখ্যালঘুদের এক অনুষ্ঠানেও মমতার দাবির প্রসঙ্গ তুলে সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে।
এ বার মুখ্যমন্ত্রীর দাবিকে কার্যত নস্যাৎ করে দিয়েছে দিল্লিকে দেওয়া নবান্নেরই তথ্য। কেন্দ্রের দেওয়া সংখ্যালঘু উন্নয়নের টাকায় দেশের পূর্ব ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় গত তিন বছরে কেমন কাজকর্ম হয়েছে, তা যাচাই করতে গত সেপ্টেম্বরে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু উন্নয়ন মন্ত্রক বৈঠক ডেকেছিল। দেখা যাচ্ছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের পেশ করা তথ্যের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দাবির আসমান-জমিন ফারাক। কী রকম?
সরকারি সূত্রের খবর, দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১২-১৩য় শুরু) সংখ্যালঘু উন্নয়নে ‘মাল্টি সেক্টরাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ (এমএসডিপি) খাতে পশ্চিমবঙ্গে আপাতত ৯২৬ কোটি টাকা বরাদ্দ, যার ৪৯৭ কোটি রাজ্য ইতিমধ্যে হাতে পেয়ে গিয়েছে। এই অর্থে সংখ্যালঘুদের জন্য ইন্দিরা আবাস যোজনার বাড়ি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, শৌচালয়, পানীয় জল প্রকল্প, আইটিআই, পলিটেকনিক, হস্টেল, রাস্তা ইত্যাদি হওয়ার কথা।
রাজ্য সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত তিন বছরে কেন্দ্রের পাঠানো টাকার মধ্যে রাজ্য সরকার খরচ করে উঠতে পেরেছে সাকুল্যে ৫৮%! যা মুখ্যমন্ত্রীর দাবির (নব্বই ভাগ) থেকে অনেক কম।”
২০১৬ সালের ১৭ মার্চ আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে লেখা হয়, “উচ্চশিক্ষার দিকে তাকালে দেখব যে রাজ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের মাত্র ২.৭% মানুষ স্নাতক বা স্নাতকোত্তর স্তরের শিক্ষা পেয়েছেন, হিন্দুদের মধ্যে সেই হার ১০.৭%। আরও চিন্তাজনক হল, সর্বভারতীয় গড়ের তুলনায় রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ এই নিরিখে অনেকটাই পিছিয়ে— গোটা দেশে ৪.৬% মুসলমান মানুষ স্নাতক স্তরের শিক্ষা পার করেছেন (সূত্র: কর্মসংস্থান সংক্রান্ত ভারতের জাতীয় নমুনা সমীক্ষা রিপোর্ট, ২০১১-১২)।
স্ন্যাপের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, যে সমস্ত ব্লকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা ৫০% বা তার বেশি, সেই ব্লকে প্রতি ১০,০০০ মানুষে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৭.৭টি। যে ব্লকে মুসলমানের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৫% বা তার কম, সে সব ব্লকে এই সংখ্যা ১১.৩। মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রেও মুসলমান-প্রধান ব্লকে এদের সংখ্যা গড়ের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ, মুসলমান প্রধান এলাকায় সরকার পর্যাপ্ত শিক্ষার পরিকাঠামো গড়তেই ব্যর্থ। পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানরা যে শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে রয়েছেন, এটা তার একটা বড় কারণ।”
আনন্দবাজার তাদের রিপোর্টে আরও লিখেছে, “জনসংখ্যার অনুপাতে রাজ্যে মুসলমান সম্প্রদায়ের ৩৪.৫% মানুষ কর্মরত, যেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ৩৯.৩%। নারী ও পুরুষ নির্বিশেষে এই অনুপাত মুসলমানদের ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় কম। মুসলমানদের নারীদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত মাত্র ১৪%, হিন্দুদের ক্ষেত্রে যা ১৯%, পুরুষদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত হিন্দুদের ৫৮.৪% এবং মুসলমানদের ৫৪.১%। অর্থাৎ, জনসংখ্যার অনুপাতে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান সম্প্রদায়ের কম সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
যাঁরা কর্মরত, তাঁরা কোন পেশায় নিযুক্ত আছেন? রাজ্যে কর্মরত মুসলমান মানুষের মধ্যে কৃষকের অনুপাত হিন্দুদের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি। কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের কর্মরত মানুষের মধ্যে ক্ষেতমজুরদের অনুপাত যেখানে ৩১.৩%, হিন্দুদের ক্ষেত্রে তা ২৮.২%। মুসলমান সম্প্রদায়ের ১২.৬% মানুষ যেখানে গৃহশিল্পের সঙ্গে যুক্ত, হিন্দুদের ক্ষেত্রে মাত্র ৬.৫% মানুষ এই কাজে নিযুক্ত আছেন।
শুধু তাই নয়, সারণি থেকে এ কথাও স্পষ্ট যে স্বনিযুক্ত ও ঠিকা শ্রমিকের অনুপাত মুসলমান মানুষের ক্ষেত্রে হিন্দুদের তুলনায় অনেকটাই বেশি, এবং নিয়মিত বেতনপ্রাপ্ত শ্রমিকের অনুপাত বেশ কম। অর্থাৎ, বলা যেতে পারে, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা মূলত কায়িক শ্রম ও ঠিকা কাজের সঙ্গে যুক্ত এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে থাকেন। স্ন্যাপের সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, গ্রামীণ বাংলায় ৮০% মুসলমান গৃহস্থ্যের পারিবারিক আয় মাসিক ৫০০০ টাকার কম, শহরাঞ্চলে এই সংখ্যা প্রায় ৬৫%। অর্থাৎ রাজ্যের মুসলমানদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করেন।
রাজ্যের মুসলমানদের মাত্র ৩.৩% মানুষ সরকারি ক্ষেত্রে কাজ করেন, যেখানে হিন্দুদের ক্ষেত্রে এই অনুপাত ১২.৮%। সরকারি কাজে মুসলমানদের উপস্থিতি সর্বভারতীয় গড়ের তুলনাতেও বেশ খারাপ। সরকারি ক্ষেত্রে মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বের এই করুণ ছবি এক দিকে যেমন শিক্ষাগত দিক থেকে মুসলমান সমাজের পিছিয়ে থাকার স্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ, তেমনই সরকারের ঔদাসীন্যের দিকেও আঙুল তোলা প্রয়োজন। সাচার কমিটি নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে অনেক বিতর্ক হওয়ার পরেও সংবাদপত্রে প্রকাশিত, তথ্যের অধিকার আইনে লব্ধ, তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে যে কলকাতা পুলিশে ৯.৪৩%, কলকাতা পুরসভায় ৪.৭৯% মুসলমান কর্মী রয়েছেন। ২০০৭ সালে এই সংখ্যাগুলি ছিল যথাক্রমে ৯.১৩% এবং ৪.৪৭%। অর্থাৎ, যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় থাকুক, বিগত ৮ বছরে প্রায় কোনও পরিবর্তন হয়নি।”
এখন ২০২০ সাল শেষ করে ২০২১ সালে যাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার প্রায় দশ বছর ক্ষমতায় আছে। কংগ্রেস, বামফ্রন্ট জামানার মতো কি তৃণমূল জামানাতেও পিছিয়ে থাকবে মুসলিম সমাজ? নাকি বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি নিয়ে বলতে গিয়ে সংখ্যালঘু উন্নয়ন আড়ালেই থাকবে? মুসলিম বঞ্চনার শেষ কোথায়? উঠছে প্রশ্ন।
আর এই প্রশ্নের জবাব দিতেই অধ্যাপক মতিনের মতো বহু মুসলিম বলছেন, দেশের সংবিধান মেনে সরকার চললেই সবার উন্নয়ন সম্ভব। আর তার জন্য প্রয়োজন ধৰ্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক চরিত্র ও বঞ্চিত সমাজের প্রতি সহ মর্মিতা।