আবদুল ওয়াকিল: জলই জীবন, জল উদ্ভিদ বা প্রাণীর দেহে শক্তির জোগান দেয়না কিন্তু প্রাণের বেঁচে থাকার জন্য জল অপরিহার্য। যেখানে জলের অস্তিত্ব নেই সেখানে জীবন নেই। ভূপৃষ্ঠের তিন ভাগ জুড়ে জল আছে। তারপরও প্রায় একশো কোটি মানুষ দূষিত জল পান করে। গ্লোবাল হেলথের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ জল দূষিত। জল দূষণের অর্থ জলকে ব্যবহারের অযোগ্য করে তোলা বা তার প্রাকৃতিক মানের পরিবর্তন করা। জল দূষণের ফলে শুধু মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে না সেই সাথে পরিবেশ ও দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে।
শহরাঞ্চলে গৃহস্থলীর নর্দমার জল, চাষে ব্যবহার্য রাসায়নিক মিশ্রিত জল ও কল কারখানার ব্যবহার্য জল জলাশয় এর জলকে দূষিত করছে। অপরিকল্পিত ভাবে ভূগর্ভের জল উত্তোলনের ফলেও জল দূষিত হচ্ছে। জল দূষণ বিভিন্ন রোগের প্রধান কারণ। যার প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্ম বজায় থাকে। এর জলন্ত উদাহরণ ভূপাল গ্যাস দূর্ঘটনা। গবেষণায় উঠে এসেছে ভূপাল গ্যাস দূর্ঘটনার ফলে কারখানার ৩.৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ৪০ মিটার গভীর পর্যন্ত জল দূষিত হয়েছে। প্রায় ৪০ হাজার মানুষ এই জল পান করার ফলে অসংখ্য শিশু ফুসফুস, মস্তিষ্ক, কিডনি রোগের আক্রান্ত হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছে। ভারতবর্ষের প্রায় সাত কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ দূষিত জল পান করে। প্রতি বছর ১৫ লক্ষ শিশু ডায়রিয়ায় মারা যায়। ২১ টি রাজ্যে জলে অধিক মাত্রায় আর্সেনিক বর্তমান, পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থানে রয়েছে। প্রায় ১ কোটি ৩ লক্ষ জনগণ এর শিকার। জলবাহিত রোগের চিকিৎসায় প্রতি বছর সারা দেশে খরচ হয় প্রায় ৯০০ কোটি টাকা।
দেশের মোট কৃষি কাজের এক তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হয় সেচের মাধ্যমে। যার সিংহভাগই নির্ভরশীল নদীর জলের ওপর। এছাড়াও বালি উত্তোলন, মাছ ধরার বিভিন্ন ভাবে জীবিকা নির্বাহ করে জনসাধারণ। নদী অববাহিকায় রয়েছে অভয়ারণ্য। পরিসংখ্যান অনুযায়ী শিল্পাঞ্চলের জেলাগুলোতে কৃষি ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৯ শতাংশ আয় কমেছে। দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ গঙ্গা নদীর উপর নির্ভরশীল। আর এই নদী বিশ্বের পঞ্চম দূষিত নদী।
দূষণের মাত্র প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরের নর্দমার জল, কলকারখানা রাসায়নিক মিশ্রিত জল গঙ্গার জলকে দূষিত করছে সেই সাথে প্রতি বছর উৎসবের মরশুমে প্রায় ৭ কোটি মানুষ পাপ মোচনের উদ্যশ্যে ফল, পাতা প্রভৃতি গঙ্গায় নিক্ষেপ করে স্নান করেন। মৃতদেহ দাহ করার ব্যায় বহন করতে না পারায় প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার মৃতদেহ গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। গঙ্গার আঁকাবাঁকা গতিপথ ও ফারাক্কা বাঁধের জন্য প্রতি বছর গড়ে ৮ বর্গ কিলোমিটার নদীর তীরে ভাঙ্গন দেখা দেয়। যার প্রভাবে কৃষিজমি, আম, লিচু বাগান ধ্বংস হয়ে যায়।
মালদা ও মুর্শিদাবাদ জেলার লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। নদীর তীর ভাঙনে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিরা কাজের সন্ধানে গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রে পাড়ি জমান। মুম্বইয়ের বাইকুলায় মালদা অঞ্চলে ক্ষয়প্রাপ্তদের পুরো কলোনি রয়েছে, যেখানে তারা প্রায়শই বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসাবে পরিচিত, কারণ তারা ক্ষয়ক্ষতিতে কেবল তাদের জিনিসপত্রই নয়, তাদের নথিও হারিয়েছিল। তাদের নিজের দেশে নব্য-শরণার্থীতে পরিণত হতে হয়। গঙ্গা দূষনের ফলে সুন্দরবন অভয়ারণ্য ক্রমশ অস্তিত্ব সংকটের দিকে যাচ্ছে। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদীর চিত্র মোটামুটি একই।
শহরাঞ্চলে গৃহস্থলীতে ব্যবহারের জন্য পর্যাপ্ত জলের অভাব রয়েছে। ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী বছরগুলিতে রাজধানী নয়াদিল্লি সহ কমপক্ষে ২১ টি বড় বড় শহরগুলিতে ভূগর্ভস্থ জলের সঙ্কট ক্রমশ চরম আকার ধারণ করবে। এছাড়াও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশুদ্ধ জল সরাবরহের অভাবে প্রতিবছর দুই লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। ‛ট্যাঙ্কার মাফিয়ারা’ কৃত্রিম ভাবে জল সঙ্কট তৈরি করে চড়া দামে বিশুদ্ধ জল বিক্রি করছে। নগরায়নের জন্য অপরিকল্পিত ভাবে জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে ফলে পানীয় জলের সংকট দেখা দিচ্ছে তেমনি বৃষ্টির ফলে জল নিকাশের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং সহজে অপ্রত্যাশিত ভাবে বন্যা দেখা দিচ্ছে।
বিশুদ্ধ জল প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণকে বিশুদ্ধ জল সরাবরহ করা, তেমনি জনগণের কর্তব্য জল দূষিত রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখা। হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কথা মতে নদীর প্রবাহিত জল দিয়ে মুখ ধৌত করা হয় তবুও যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল ব্যবহার না করা হয়। জল দূষণ ও তার ফলে সৃষ্টি সমস্যা সম্পর্কে সমাজে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। সাথে ব্যবস্থা গ্রহণের আকাঙ্ক্ষা থাকলেই জলের জ্বলন্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।