দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : মাদ্রাসা মানেই নাকি মুসলিমদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসা মানেই নাকি সাম্প্রদায়িকতার বীজ রোপণ করা হয়। মাদ্রাসা নাকি সন্ত্রাসবাদীদের আঁতুরঘর। মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে শিক্ষা সম্পর্কে যাদের মগজে কিচ্ছু নেই তেমন ব্যক্তিদের কাছ থেকে এমন সব ভ্রান্ত ধারণা ব্যক্ত হয়েছে অতীতে। যা নিয়ে রাজ্য রাজনীতিও তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কিছু যায় আসেনি। মাদ্রাসা যে একটি সম্প্রীতির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, তা ফের একবার প্রমাণিত হল।
হাইমাদ্রাসার মেধা তালিকায় জায়গা করে নিল হিন্দু পরিক্ষার্থী। বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের খণ্ডগ্ৰাম ডিএস হাইমাদ্রাসার ছাত্র জগন্নাথ দাস ৭৬০ নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছে। তাই মাদ্রাসা কোনও নির্দিষ্ট ধর্মের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়। মাদ্রাসা হল সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার সঙ্গে স্কুলের কোনো পার্থক্য নেই। সিলেবাসও একইরকম। শুধু মাদ্রাসায় একটি বিষয় বেশি পড়ানো হয়। সমস্ত স্কুলে আরবি ভাষা পড়ানো হয় না। কিন্তু সমস্ত হাইমাদ্রাসায় ১০০ নম্বরের আরবি ভাষা পড়ানো হয়।
তাই, বাংলা, ইংরেজি, হিন্দির সঙ্গে আরবি ভাষা শেখার জন্য বহু অমুসলিম ছেলেমেয়েরাও মাদ্রাসায় ভর্তি হচ্ছে। যার ফলে দিন দিন বেড়েই চলেছে অমুসলিম পড়ুয়ার সংখ্যা। এর মাধ্যমেই মাদ্রাসা মাদ্রাসা সম্পর্কে যে ব্যক্তি মাঝে মধ্যেই কু-কথা ব্যক্ত করে থাকেন, তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিল জগন্নাথদের মতো কৃতি সন্তানরা। জগন্নাথের খণ্ডগ্ৰাম পাড়াতেই অবস্থিত এই মাদ্রাসা। তাঁর ধর্ম হিন্দু। তাদের পাশের পাড়াতেই রয়েছে বিরাট স্কুল। তারপরেও জগন্নাথ কেন মাদ্রাসায় পড়াশোনা করল?
জগন্নাথের কথায়, আমি হিন্দু, মুসলিম বুঝি না। আমি জানি আমি একজন মানুষ। আমার সঙ্গে আমার বন্ধুরাও এক মত। জগন্নাথ জানায়, সে একা নয়, এই মাদ্রাসায় আরও পরিক্ষার্থী ছিল অমুসলিম। আমাদের পড়ার সকলেই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। সকলেই আরবি ভাষা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পড়াশোনা করে। আমাদের আগ্ৰহ রয়েছে, আরবি ভাষায় কথা বলার। আরবি ভাষাকে জানার। বাকি সব বিষয়, স্কুলের সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। তাছাড়া, এই মাদ্রাসায় পড়াশোনার সুনাম রয়েছে। জগন্নাথের বাবা দীনবন্ধু দাস বলেন, ‛আমরাও এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। মাদ্রাসাকে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে আমরা কখনও মনে করি না। আমাদের পাড়ার ছেলেমেয়েরা এই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে বড় হয়েছে। অনেকে ভালো জায়গায় চাকরিও করছে।’
এই মাদ্রাসা থেকেই নাকি ৩০ জন অমুসলিম ছাত্রছাত্রী হাইমাদ্রাসার পরিক্ষা দিয়েছে। যা সম্প্রতির গর্ব বলেই মনে করছেন তারা অনেকে। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক কারিবুল হোসেন বলেন, ‛জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ধর্মের মানুষ আমাদের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। মোট ছাত্রছাত্রীর ৪০ শতাংশই অমুসলিম। এই এলাকায় মাদ্রাসা নিয়ে কোনও ছুত মার্গ নেই। আগ্ৰহের সাথেই ছেলে মেয়েরা মাদ্রাসায় আসে। ভালো রেসাল্টও করে। জগন্নাথ প্রথম থেকেই পড়াশোনায় ভালো। আমাদের আশা ছিল। আজ সেটা বাস্তবায়িত হয়েছে। জগন্নাথের প্রাপ্ত নম্বর ৭৬০ আরবি ভাষায় এ প্লাস গ্ৰেড পেয়েছে। মানে আরবিতে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর ৮০-৮৯ এর মধ্যে। বাকি সব বিষয়ে ৯০ এর উপর নম্বর পেয়েছে সে। ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন রয়েছে তার, জগন্নাথের বাবা একজন ক্ষুদ্রচাষি। মা গৃহবধূ। আর এক ছোটো ভাই রয়েছে তার। তাঁদেরকে আগলে রেখেছেন দাদু। অভাবকে নিত্যসঙ্গী করেই পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে জগন্নাথ। যার ভালো ফল পেয়ে সন্তুষ্ট সে। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাড়ির অভাব দূরে বাবা-মাকে একটু শান্তি দিতে চায় জগন্নাথ।
তবে, একা জগন্নাথ নয়, এবারে হাইমাদ্রাসায় ৫৭৩৮ জন অমুসলিম ছাত্রছাত্রী পরিক্ষায় বসেছিল। এর মধ্যে ছাত্র ১৭১৬ আর ছাত্রী ৪০২২। গত বারের তুলনায় এই সংখ্যাটা অনেকটাই বেশি। এর মধ্যে অর্ধেক এসসি, এসটি ও ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত। অমুসলিম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এবারে পাশ করেছে ৪৬৮১। শতকরা ৮১.৫৬ শতাংশ। এর আগে ২০১৭ সালে রাজ্যে প্রথম হাইমাদ্রাসার পরিক্ষায় মেধাতালিকায় জায়গা করেছিল অমুসলিম পরিক্ষার্থী। প্রশমা শাসমল নামে ওই ছাত্রী নবম স্থান অধিকার করেছিল। এবার সেই জায়গায় উঠে এল জগন্নাথ দাস।
মাদ্রাসা পর্ষদের সভাপতি আবুতাহের কামরুদ্দিন বলেন, ‛অমুসলিম ছাত্রছাত্রীরাও মেধায় তালিকায় স্থান পাচ্ছে। একটা আমাদের কাছে ভালো দিক সেই সঙ্গে প্রতি বছরেই অমুসলিম পরিক্ষার্থীর সংখ্যাও বাড়ছে।এটা আমাদের কাছে গর্বের।’ জগন্নাথের কথায়, ‛আমরা সব ধর্মের মানুষ একই সঙ্গে বসবাস করি। একসঙ্গে পড়াশোনা করে। সব উৎসবও পালন করি। বন্ধুদের সঙ্গে ঈদ পালন করি। আবার মুসলিম বন্ধুরাও আমাদের সঙ্গে সরস্বতী পুজোতেও যোগ দেয়। এর মধ্যে কোনও বিভেদ নেই। কখনও সেই বিভেদ আসবেও না।’