Monday, February 24, 2025
Latest Newsফিচার নিউজরাজ্য

হারিয়ে যাচ্ছে মুর্শিদাবাদের ঐতিহ্য, ইতিহাসের ভরে ভারাক্রান্ত নিমতিতার রাজবাড়ি

নিজস্ব সংবাদদাতা, দৈনিক সমাচার, মুর্শিদাবাদ : ১৮৫৫ সালে গৌরসুন্দর চৌধুরী ও দ্বারকানাথ চৌধুরী দুই ভাই মিলে তৈরি করেন নিমতিতার রাজবাড়ি। শুরু হয় জমিদারি। আলো, উৎসবের কমতি ছিল না কোনও। তবে বলা যায় ভারত উপমহাদেশে মুঘলদের আমল থেকে ব্রিটিশদের শাসন আমল পর্যন্ত জমিদারি প্রথা চালু ছিল। ওই জমিদারদের বাড়িকেই জমিদার বাড়ি বলা হত। জমিদাররা প্রজাদের উপর তাদের শাসনকার্য চালাতেন এই বাড়ি থেকেই। তাই জমিদারদের এই বাড়িগুলো প্রজাদের কাছে অর্থাৎ সাধারণ মানুষের কাছে জমিদার বাড়ি নামেই পরিচিতি লাভ করেছে। তখনকার সময় জমিদাররা ছিলেন অনেক টাকার মালিক। তাই তারা তাদের বাড়িগুলো বানাতেন দালানের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের সুন্দর সুন্দর নকশা করে। যা বিভিন্ন জমিদার বাড়ি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়। ইতালিয়ান ধাচে তৈরি এই বাড়িটিতে রয়েছে পাঁচটি উঠোন এবং দেড়শো কক্ষ। তৎকালীন সময়ে এই রাজবাড়িতে বিভিন্ন সময়ে বিখ্যাত মানুষের আগমন ঘটেছে।

দ্বারকানাথের ছেলে জ্ঞানেন্দ্র নারায়ণের বিয়ের সময় কলকাতার স্টার থিয়েটার গ্রুপকে নাট্য অভিনয় করার জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। বিখ্যাত অভিনেতা ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যা বিনয় তাঁর নাট্যগোষ্ঠী নিয়ে নিমতিতার রাজবাড়িতে এলে দ্বারকানারায়ণের পুত্র মহেন্দ্র নারায়ণ রাজবাড়িতে নিমতিতা রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতি বছর হোলির সময় নাটক মঞ্চস্থ হত। বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব শিশির ভাদুড়ি এই রাজবাড়ির মঞ্চে অভিনয় করে গেছেন। বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে মহেন্দ্রনারায়ণের প্রচেষ্টায় নিমতিতা খ্যাতি অর্জন করেছিল সেই সময়। সেসব আজ শুধুই স্মৃতি। গঙ্গা খেয়েছে সব। ১৯৪৪-এর বন্যার সময়, ভেঙে পড়ে রঙ্গমঞ্চটি। ভাঙনের সেই শুরুর দশক শতক পেরিয়ে, আজ হারাতে বসেছে রাজবাড়িই।

এছাড়াও রাজবাড়িতে পদার্পণ ঘটেছিল (কালাজ্বরের ঔষুধ আবিষ্কারক) বাঙালি বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী, মুর্শিদাবাদ জেলার তৎকালীন জেলাশাসক তথা শিশু সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, সাহিত্যিক লীলা মজুমদার, কবি কাজি নজরুল ইসলাম, দাদাঠাকুর প্রমুখ বরেণ্য ব্যক্তিদের। আবার সত্যজিৎ রায় ১৯৫৭ ‘জলসাঘর’ ছবির শ্যুট করেছিলেন এই নিমতিতা রাজবাড়িতেই। শুধু ‘জলসাঘর’ই নয়, ১৯৫৯ সালে ‘দেবী’ এবং ১৯৬০ সালে ‘সমাপ্তি’। সত্যজিতের রায়ের এই তিনটি সিনেমার ফ্রেমে ফ্রেমে বেঁচে রয়েছে নিমতিতা রাজবাড়ির জৌলুস। আজও এই রাজ বাড়ির পাশে দিয়ে বয়ে চলেছে গঙ্গা নদী।

ভাদ্র মাসে বন্যার সময়ে জল উঁকি দিয়ে যায় রাজবাড়ির উঠোনে। তাছাড়া এই রাজ বাড়ির চার পাশে রয়েছে মনোরম দৃশ্যও। তবে ইতিমধ্যেই হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার চেষ্টা চলছে পুরোদমে। স্বীকৃতি এলে পর্যটকদের অন্যতম গন্তব্য হয়ে উঠবে এই ঐতিহ্যের রাজবাড়ি। প্রত্যয়ী এই এলাকাবাসি। চাইলে সংস্কারের মাধ্যমে একটি ভ্রমণকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যেতেই পারে রাজবাড়িটিকে। এখন এই ঐতিহ্যবাহী রাজবাড়িটি তার মাথার উপরের ছাদ ভেঙে যাওয়ায় আকাশ উকি দিচ্ছে ঘরে। কড়িকাঠের বর্গাগুলো দখল নিয়েছে ঘুণপোকায়। দেওয়াল থেকে খসে পড়েছে চুনসুরকি বালি। লতা ও আগাছা বংশ বিস্তার শুরু করে দিয়েছে ইটের ফাকে ফাকে। বৃষ্টির জল ও সূর্যের রোদ সঙ্গ দিয়েছে রাজবাড়ির দেওয়াল ও মেঝেতে। পিঁপড়ে ও কীটপতঙ্গ বাসা বেঁধেছে দেওয়ালের ফাঁকে। বর্তমানে কঙ্কালসার জীর্ণদশা নিয়ে গঙ্গানদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ধ্বংসের প্রহর গুনছে রাজবাড়িটি।

 

Leave a Reply

error: Content is protected !!