Wednesday, February 5, 2025
Latest Newsদেশফিচার নিউজ

আজ সেই কালো দিন! গোরক্ষপুর মেডিকেল কলেজে অক্সিজেন বিপর্যয়ের তৃতীয় বর্ষপূর্তি

৭০ শিশুর মৃত্যু কিভাবে ভুলবেন কাফিল?

দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : আজ সেই ১০ই আগস্ট। ভয়াবহ এক ট্র্যাজিক রচনার দিন। ২০১৭ সালের এই দিনটি ইতিহাসের পাতায় আরেকটি কালো অধ্যায়। এদিন রাতে গোরক্ষপুর বিআরডি মেডিকেল কলেজে অক্সিজেনের অভাবে প্রাণ গিয়েছিল প্রায় ৭০ সদ্যোজাত শিশুর। সেদিন রাতের ঘটনা ডাঃ কাফিল খানের কাছে যেন এক দুঃসহ স্মৃতি। এক – দু’জন নয়! সেদিন নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে এনে বহু শিশুর প্রাণ বাঁচিয়ে সকলের চোখের মনি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, আজ থেকে ঠিক ৩ বছর আগে প্রথমবারের মতো খবরের শিরোনামে এসেছিলেন গোরক্ষপুর বিআরডি মেডিকেল কলেজের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ কাফিল খান। রোগীদের পরিজন থেকে জাতীয় সংবাদমাধ্যম – তাঁর ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন সকলেই।

সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কাফিল বলেন, ‛সেদিন আমি ছুটিতে ছিলাম। রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে যাচ্ছিলাম। এমন সময় একজন হাসপাতাল কর্মী মেসেজ করে জানান যে, লিকুইড অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছে। তখুনি হাসপাতালে ছুটে যায়। সেখানকার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার পর নিজেই বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থা থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করে নিয়ে আসি। একাজে আমার সহকর্মী জুনিয়র ডাক্তার ও হাসপাতাল কর্মীরাও আমাকে সাহায্য করেছিল। আমরা প্রায় ২৫০ সিলিন্ডার সরবরাহ করেছিলাম।’

কাফিলের সংগ্রহ করে আনা অক্সিজেন  পর্যাপ্ত ছিল না, ফলে ১০-১১ আগস্টের মধ্যে প্রাণ হারায় প্রায় ৭০টি শিশু। হঠাৎ অক্সিজেনে ঘাটতি হল কেন? জবাবে কাফিল বলেন, ‛সরকার ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে হাসপাতালকে ৪৫৪ লক্ষ টাকা দিয়েছিল। কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহকারী সংস্থা পুষ্পা সেলস-এর কাছে ঘুষ দাবি করে ইচ্ছে করে পেমেন্ট না দিয়ে মাত্র ৬৩ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। পুষ্পা সেলস বারবার নোটিস পাঠানো সত্ত্বেও বকেয়া টাকা মেটানো হয়নি। সেইজন্য হঠাৎ করে অক্সিজেন পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল পুষ্পা সেলস।’

অক্সিজেনের অভাবে ৭০ শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় যখন গোটা দেশ তোলপাড় তখন হাসপাতাল পরিদর্শনে আসেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। হাসপাতাল পরিদর্শন করে ‛দোষীদের কঠোরতম সাজার’ আশ্বাস দেন মুখ্যমন্ত্রী। সংবাদমাধ্যমের সামনে ‛দোষীদের কঠোরতম সাজার’ আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল একথা পুরো দেশ দেখেছিল। কিন্তু, দেশবাসীর আড়ালে সেদিন আরওকিছু ঘটে গিয়েছিল। ঠিক কি ঘটেছিল? মুখ্যমন্ত্রীর হাসপাতাল পরিদর্শন সম্পর্কে ডাঃ কাফিল বলেন, ‛হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে মুখ্যমন্ত্রী আমাকে ডেকে পাঠান। তিনি অযথা আমাকে ধমক দিতে শুরু করেন। তিনি আমাকে বলেন, তুমিই কাফিল খান? কি ভেবেছ? অক্সিজেন জোগাড় করে নিয়ে এসে রাতারাতি হিরো হবে? এইবার তুমি দেখো আমি কি করি।’

সত্যিই মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ কড়া পদক্ষেপ নিয়েছিলেন! ‛দোষীদের কঠোরতম সাজার’ আশ্বাস দেওয়ার অল্প পরেই সেই কাফিল খানকে রাতারাতি গোরক্ষপুর বিআরডি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এনসেফ্যালাইটিস ওয়ার্ডের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় যোগী আদিত্যনাথ সরকার। শুধু তাই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে প্রাইভেট প্র্যাকটিসের অভিযোগও আনা হয়। যোগী সরকারের এ সিদ্ধান্তে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা দেশ। বিরোধীরা অভিযোগ করেন, ‛ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই এভাবে হেনস্থা করা হল ওই ডাক্তারকে।’ এই সিদ্ধান্ত যোগী সরকারের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরল বলেও ট্যুইটার-ফেসবুকে ফেটে পড়েন অনেকে।

গোরক্ষপুরে শিশুমৃত্যুর ২০ দিন পরই ছিল পবিত্র ঈদ উল আযহা। ঈদের দিন সকালেই ডাঃ কাফিল খানকে গ্রেফতার করে যোগীর পুলিশ। কাফিল বলেন, ‛সেদিন ঈদ উপলক্ষ্যে বাড়িতে উৎসবের আমেজ ছিল। নানারকম রান্নাবান্নার আয়োজন চলছিল। হঠাৎ বাড়িতে হাজির হয় পুলিশ। আমরা অনুরোধ করি ঈদের দিনটি ছাড় দেওয়ার জন্য। কিন্তু পুলিশ সেই অনুরোধ না শুনেই আমাকে গ্রেফতার করে।’ কাফিল খানের মুক্তির দাবিতে আদালতের দ্বারস্থ হয় তাঁর পরিবার। কাফিলের পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে একটি পিটিশন দায়ের করে তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা এফআইআর তুলে নেওয়ার দাবি করা হয়। কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্ট তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে দায়ের করা এই পিটিশন খারিজ করে দেয়। জামিনের দলিল পর্যন্ত পড়তে রাজি ছিলনা আদালত। বিচারপতি জামিন আবেদনের কপি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলতেন, ‛এ পড়া যাবেনা।’ কাফিলের পরিবার বারবার আদালতের চক্কর কাটছিল। সেসময় কেউ তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি।

জেলে ডাঃ কাফিল খানকে খুনের আসামিদের সঙ্গে রাখা হতো! শুধু খুনের অপরাধী না, বিভিন্ন রকম মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দাগী আসামিদের সঙ্গে একটি নোংরা সেলে তাঁকে রাখা হয়েছিল। খালি মেঝেতে শুতে দেওয়া হত। যে সেলে তিনি থাকতেন সেখানে বড়জোর ৬০ জন থাকতে পারবে। কিন্তু সেখানে তাঁর সঙ্গে ছিল ১৬০ জন অপরাধী। রাতে তিনি জল খেতেন না, বাথরুম যেতে হবে এই চিন্তা করে। কেননা সেলে একটি মাত্র বাথরুম ছিল, আর ১৬০ জন অপরাধীকে ডিঙিয়ে বাথরুমে যেতে হত। এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে প্রায় ৭ থেকে ৮ মাস তিনি জেলে ছিলেন। একদিন জেল থেকে একটি চিঠি লেখেন কাফিল। বাড়ির লোক দেখা করতে গেলে সেই চিঠি লুকিয়ে তাঁর বাচ্চার ডাইপারে ঢুকিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেন তিনি। সেই চিঠি সোশ্যাল সাইটে ভাইরাল হয়ে যায়। এরপর আদালতের টনক নড়ে। এর মাত্র কয়েকদিন পরই আদালত কাফিলের জামিন মঞ্জুর করে। আদালত জানায় ‛কাফিলের বিরুদ্ধে কোনও প্রমান নেই যোগী সরকারের কাছে।’

মুক্তি পেয়েও শান্তি পাননি কাফিল। অনেক ঝক্কি পোয়াতে হয়েছে তাঁর পরিবারকে। কাফিলের ভাই কাসিফ জামিলকে প্রকাশ্যে গুলি মেরে খুন করার চেষ্টা করা হয়। হিন্দি সিনেমার স্টাইলে কাসিফকে রাস্তায় ফেলে গুলি করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে যোগীর পুলিশও অন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। পুলিশ তদন্তের নামে চিকিৎসা আটকে রাখে। সঙ্গে সঙ্গে সোশ্যাল সাইটে ঘটনার লাইভ দেখানো শুরু করে দেয় তাঁর পরিবার। অবস্থা বেগতিক দেখে কেটে পড়ে পুলিশ। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর প্রাণে বাঁচেন কাসিফ জামিল। ঘটনার কয়েকদিন পর লখনউয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে গুরুতর অভিযোগ করেন কাফিল। তিনি বলেন, ‛ভাই কাসিফ জামিলকে খুন করার জন্য শ্যুটার ভাড়া করেছিলেন বিজেপি সাংসদ কমলেশ পাসওয়ান।’ প্রশাসনের তরফে বলা হয়েছিল, কাফিল খানের ভাইকে যারা হত্যার চেষ্টা করেছে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু আজও সেই ৪৮ ঘন্টা সম্পূর্ণ হয়নি। পাল্টা সিবিআই তদন্তের দাবি করেও ফিরতে হয়েছে শূন্য হাতে।

তবে এত কিছুর পরেও গোরক্ষপুর ছেড়ে যেতে চান না ডাঃ কাফিল। নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর তিনি বলেন, ‛আমি কখনওই আমার প্রিয় জন্মভূমি ছাড়ব না। এই দেশের মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে আমার মন, প্রাণ, আত্মা। যদি দেশ ছাড়ারই হতো, তাহলে সেই ২০১৩ সালেই ছেড়ে চলে যেতাম। কেননা, তখন মাসিক ৪ লাখ টাকা বৃত্তিতে অস্ট্রেলিয়ায় ফেলোশিপ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।’ গোরক্ষপুরে শিশুমৃত্যুর ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কাফিল বলেন, ‛দিনটি আমার জীবনের একটি কালো দিন। ৭০ শিশুর মৃত্যু কিভাবে ভুলব আমি? আইনী লড়াইয়ে একদিন জিতে যাবো। কিন্তু সন্তান হারানো বাবা-মা যে হেরে গিয়েছেন, তাঁদের কিভাবে জেতাব? তবে দোষীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত আমি লড়ে যাবো।’ আর কোনও শিশুকে যেন অকালে প্রাণ না হারাতে হয়, সেজন্য বৃহত্তর লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছি – বলেও জানান ডাঃ কাফিল খান।

 

Leave a Reply

error: Content is protected !!