দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক: আইনি লড়াইতে কেউ হারবে, কেউ জিতবে। কিন্তু করোনা আবহে সিবিআই-র এ হেন অতি-সক্রিয়তাকে বঙ্গ-সমাজ যে বাঁকা চোখে দেখছে, তা বিলক্ষণ আন্দাজ করতে পেরেছেন রাজ্য বিজেপি নেতারা। করোনার ভয়াবহতাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিবিআই আদাজল খেয়ে ঝাঁপিয়েছে নারদ-মামলার ‘হেস্তনেস্ত’ করতে। সমাজের বিভিন্ন মহলে সিবিআই-র অতি-সক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সমালোচনার ঝড় বইছে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকা নিয়ে। নাগরিক সমাজের ক্ষোভে সিঁদুরে মেঘ দেখছে বঙ্গ বিজেপি। রাজনীতির ময়দানে এর খেসারত গেরুয়া শিবিরকে ভালো ভাবেই চোকাতে হবে বলে ঘনিষ্ঠ মহলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন রাজ্য বিজেপির অনেক শীর্ষ নেতাই।
একদিকে করোনার দাপট, অন্য দিকে ফের ঘূর্ণিঝড় আছডে পড়ার আশঙ্কা। এই অবস্থায় ছ’বছরের পুরোনো একটি মামলার ফয়সালার থেকেও সাধারণ মানুষের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজেদের জীবন-জীবিকা সুনিশ্চিত করা। রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা আম-আদমির এই মনোভাবের কথা দিল্লির শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছেন বলে দলীয় সূত্রে খবর। রাজ্য বিজেপির এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘করোনার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ জেরবার। তার মধ্যে আবার এক বছর আগের ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহ স্মৃতি ফিরে আসার আশঙ্কা। এই অবস্থায় মানুষ দেখছে, রাজ্যের যে মন্ত্রীরা করোনা মোকাবিলা করবেন, তাঁদেরই সিবিআই জেলে আটকে রাখছে। যতই আমরা বলি, এর সঙ্গে বিজেপির কোনও সম্পর্ক নেই, কিন্তু মানুষ বোকা নয়। সব বোঝে।’
দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্য ‘পাবলিক পারসেপশন’ নিয়ে এখন মাথা ঘামাতে চাইছেন না। পার্টির অন্দরে তাঁদের যুক্তি, সামনে কোনও ভোট নেই। তাই আম-জনতা কী ভাবল, তার থেকে অনেক জরুরি পার্টি কর্মীদের চাঙ্গা করে তোলা। বিজেপির অনেক কেন্দ্রীয় নেতারই ধারণা, তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের জেলে যেতে দেখলে জেলায় জেলায় আক্রান্ত কর্মীদের মনোবল বাড়বে। রাজ্য বিজেপির সিংহভাগ নেতাই অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের অভিমত, জনগণকে বাদ দিয়ে রাজনীতি হয় না। তাই সাধারণ মানুষ কোন ঘটনায় কী ভাবে ‘রি-অ্যাক্ট’ করছে, সেটা মাথায় রেখেই পদক্ষেপ করতে হয়। যে ঘটনা সাধারণ মানুষের বিরক্তি তৈরি করে, সেই ঘটনা কোনও দিনই দলীয় কর্মীদের মনোবল বাড়াতে পারে না।
শুধু জনমানসে দলের ভাবমূর্তি খারাপ হওয়াই নয়, সিবিআই-র তৎপরতার দৌলতে বিজেপি বিরোধী শক্তিগুলির মধ্যে দূরত্ব কমতে শুরু করেছে বলেও অভিমত বাংলার গেরুয়া শিবিরের। কৌশলগত কারণে রাজ্য বিজেপি চায়, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বিরোধী দলগুলির সঙ্গে শাসক তৃণমূলের বিরোধ লেগেই থাক। যাতে বিজেপি বিরোধী শিবিরের ছত্রভঙ্গ দশা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই মনোবাসনা রাজ্য বিজেপির বিধানসভা ভোটের আগে পূরণ হয়নি। ভোটের পরেও হচ্ছে না। এর জন্য অবশ্য অমিত শাহদের রণনীতিকেই দায়ী করছে তারা। নারদ-মামলায় সিবিআই-র তৎপরতা শুরু হওয়ার পর রাজ্য বিজেপিকে সব থেকে বেশি চিন্তায় ফেলেছে বাম-কংগ্রেস, নকশালদের রাজনৈতিক অবস্থান। তারা সকলেই করোনা আবহের মধ্যে কেন তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেফতার করা হল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী কোনও রাখঢাক না করেই সিবিআই-র তৎপরতাকে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। সিপিআইএমও প্রেস বিবৃতি দিয়ে ফিরহাদ হাকিমদের গ্রেফতার করার সময়কাল নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় তুলেছে।
এই ইস্যুতে নকশালপন্থী বেশ কয়েকটি সংগঠন রাস্তায় নেমে মিছিলও করেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতার উদ্বেগ, ‘এই দলগুলি আমাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এরা তৃণমূলেরও বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি পদক্ষেপের সুবাদে এরা সবাই তৃণমূলের কাছাকাছি চলে এসেছে। নারদ-মামলার তদন্ত জনমানসে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল তো করলই না, উল্টে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের শক্তি আরও বাড়িয়ে দিল।’
হাওয়া অনুকূলে নয় বুঝে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা এ ক’দিন মুখে কুলুপ এঁটেই ছিলেন। দিলীপ ঘোষ, শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়রা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। তবে বিজেপি যে সর্বভারতীয় দল, দিল্লি চাইলে চুপ করে থাকার জো নেই। বুধবার বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এক ভিডিয়ো বার্তায় তৃণমূলের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থায় বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তবে বিধানসভা ভোটের আগে যে ঝাঁঝ দিলীপের গলায় শোনা যেত, তার ছিটেফোঁটাও এদিন দিলীপের ভিডিয়ো বার্তায় খুঁজে পাননি রাজ্য বিজেপি নেতারাও।