আফরিদা খাতুন আঁখি : ইসলাম কোনও তথাকথিত ধর্ম নয় বরং মহান আল্লাহ প্রেরিত জীবন্ত এক জীবন বিধান। ইসলাম ধর্মে প্রণিত সমস্ত আচার ব্যবহার গভীর অনুধাবন করলে বোঝা যায় যে, ইসলামের এমন কোন ক্রিয়াকলাপ নেই যা মানবতা বিরোধী। এমনকি প্রতিটি উৎসব কেবল আনন্দের জন্য উপস্থাপন করা হয়নি বরং এর সাথে মানবতার এক গভীর মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে। নামাজ, রোজা, ঈদ, যাকাত সব কিছুর মধ্যেই রয়েছে মানব কল্যাণ।
এই ঘোর দুর্দিনে মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদে গমন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি। ইসলামে মসজিদকে কেবল প্রার্থনা গৃহ হিসেবেই উপস্থাপন করা হয়নি বরং মসজিদকে সামাজিক যোগাযোগের একটি কেন্দ্র হিসাবেই উন্মুক্ত করা হয়েছে। করোনা নামক সংক্রমণ মারণ রোগ বর্তমানে মহামারী থেকে অতিমারী আকার ধারণ করেছে। এই রোগ নির্মূল করার জন্য ঘরে নিজেকে আবদ্ধ রাখা সর্বত্ম পন্থা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন ইসলামীক চিন্তাবিদ গণ নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করে নামাজ আদায়ের পরামর্শ দিয়েছেন আর এটা ইসলাম বহির্ভূত কোন কাজ ও না। বরং খোদ নবী মুহাম্মদ (ﷺ) বিশেষ অবস্থায় সলাত ঘরে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রসঙ্গঃ জুম্মার দিনে বাড়িতে নামাজ ঘরে আদায়ের অনুমতি দেন। ‘আবদুল্লাহ্ ইব্নু হারিস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, “তিনি বলেন, একবার বর্ষণ মুখর দিনে ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে খুতবাহ দিচ্ছিলেন। এদিকে মুয়াজ্জিন আযান দিতে গিয়ে যখন এই স্থানে পোঁছল ‘এসো নামাজের দিকে’, তখন তিনি তাকে ঘোষণা দেয়ার নির্দেশ দিলেন যে, ‘লোকেরা যেন আবাসে সালাত আদায় করে নেয়।’ এতে লোকেরা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগল। তখন ইব্নু ‘আব্বাস (রাঃ) বললেন, তাঁর চেয়ে যিনি অধিক উত্তম ছিলেন (রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনিই এরূপ করেছেন। অবশ্য জুমু’আর সালাত ওয়াজিব। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং ৬১৬)।
কিন্তু বর্তমানে মুসলিম যুব সমাজ সমস্ত বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে গায়ের জোরে মসজিদে সালাত আদায় করে চলেছে। বেশ অবাক হতে হয় এরা সেই যুব, যাদের জুম্মা আর দুই ঈদ ছাড়া মসজিদে পায়ের ধুলো পড়তো না, মুয়াজ্জিনের নামাজের জন্য আহ্বান ধ্বনি যাদের এক কান দিয়ে প্রবেশ করে অন্য কান দিয়ে তরঙ্গ রুপে বাহির হয়ে যেত। তাদের এই গোয়ার্তুমি দেখে বেশ ভীমরি খেতে হয়। যখন তাদের মসজিদের কাতারে দাঁড়ানোর উচিত ছিল তখন তারা মসজিদের পথ ভুলে নিজেদের ব্যাস্ত রাখত মুঠোফোনের রঙবেরঙের রোশনাই। আর যখন এই কঠিন রোগকে দমন করার জন্য গৃহে অবস্থান প্রয়োজন তখন তারা সব নিষেধ উপেক্ষা করে মসজিদে গমন করেই চলেছে।
মেনে নিলাম আপনারা সরকারের প্রতি ক্ষুদ্ধ, মেনে নিলাম লকডাউনের মত স্পর্শকাতর বিষয়ের অন্তরালে সরকার মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে কম রাজনীতি করার চেষ্টা করেনি, মেনে নিলাম বছরের পর বছর ধরে এই সম্প্রদায়কে নিয়ে কেবল সেকুলার নাম নিয়ে খেলা হয়েছে, কিন্তু ভুললে চলবে না আপনি এমন এক ধর্মের অনুসারী যার প্রতিটি পদে পদে রয়েছে মানবতার কল্যাণ, সেই ধর্ম যে তার তার দূদর্শিতার সময়ের মহাসমুদ্র পেরিয়ে আজও জীবন্ত। নবী মুহাম্মদ (ﷺ) যেখানে চোদ্দোশ বছর পূর্বে বর্তমানে চলমান জল সংকট সহ বেশ কিছু ব্যাপারে তাঁর অনুসারীদের প্রতি রেখে গেছেন উপদেশ, সেখানে এই কঠিন পরিস্থিতির ব্যাপারে কোন উপদেশ থাকবে না, তা যে কোনওভাবেই সম্ভব না।
এতদ সত্ত্বেও যারা এখনো মসজিদে গমনের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর, তারা কিন্তু নিজের গোয়ার্তুমি দিয়ে ইসলাম ধর্মের অবমাননা করছেন, ইসলামকে বিশ্ববাসীর কাছে অবৈজ্ঞানিক কয়েকটা প্রথার মধ্যে আবদ্ধ প্রথাগত ভাবে উপস্থাপন করে চলেছেন। এতদ সত্ত্বেও যারা এখনও মসজিদের কাতারে ভীড় জমাতে প্রতিঙ্গাবদ্ধ তারা টুপি দাড়ির বেশে মুখে নবী মুহাম্মদ (ﷺ)র প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার ঘোষণা দিলেও আদতে নবী মুহাম্মদের (ﷺ) উপদেশ লঙ্ঘন করে চলেছেন। তাদের কোন অধিকার নেই আল্লাহর দেওয়া বিধান এবং নবী মুহাম্মদ এর (ﷺ) দেওয়া উপদেশ কে লঙ্ঘন করার? একটু ভেবে দেখুন এই কঠিন রোগের সংক্রমণে সাহায্য করে আপনি কী আপনার প্রভুর প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পারবেন?
যেমন ভাবে আপনি যখন সফরে থাকেন তখন শারীরিক সুস্থতা থাকা সত্ত্বেও আপনি কসরের নামাজ পড়তে বাধ্য, ঠিক তেমনিভাবেই এই মহামারী রুখতে মসজিদের পরিবর্তে নিজ গৃহে সালাত আদায়ে কিন্তু আপনি একপ্রকার বাধ্য। এই কঠিন পরিস্থিতিতে গৃহে অবস্থান করুন এবং ভারতীয় শরীয়াহ কমিটির নির্দেশ মেনে গৃহে নামায আদায় করে এই মহামারীর ঘোর সংকটের মোকাবিলা করুন, যেমনি ভাবে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেন হিক্-মতের সাথে। ইসলাম হলো মানবতার ধর্ম। সংক্রমণকে ছড়িয়ে না বরং সংক্রমণ কে দমন করার মধ্যে দিয়ে একজন ইসলাম ধর্মের অনুসারী হয়ে নিজের ধর্মকে মানবতার ধর্ম হিসাবে উপস্থাপন করুন।
লেখিকা: রিসার্চার সসিয় এডুকেশানাল রিসার্চ সেন্টার (সার্ক)