দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। আজকের দিনেই ঠিক সাতাশ বছর আগে বাবরি মসজিদকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সুদূর অতীত, এবং ভয়ানক বর্তমান।
বাবরি মসজিদ যে দিন ধূলিসাৎ হয়, সে দিন অনেক প্রবীণকে গান্ধী-হত্যার সঙ্গে তার তুলনা করতে শোনা গিয়েছিল।। তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছিল, এই নিয়ে দ্বিতীয় বার মহাত্মাকে, অর্থাৎ ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে, খুন করা হল।
ঘটনার পর গঙ্গা-যমুনা-সরযূ দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, যাতে থিকথিক করেছে সাম্প্রদায়িক আবর্জনা। কালক্রমে যে দল মহাকাব্যের পুরাণপুরুষকে জাতির ‘রাষ্ট্রনায়ক’ বলে ঘোষণা করে তাঁর কাল্পনিক জন্মস্থান ম্লেচ্ছদের অপবিত্র স্পর্শ থেকে উদ্ধারের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে আর্যাবর্তের হিন্দি বলয়কে ঘুলিয়ে তোলে, তারই নির্বাচিত সাংসদের কণ্ঠে গান্ধী-ঘাতক নাথুরাম গডসে ‘দেশভক্ত’ হয়ে ওঠেন।
গডসের দেশভক্তি যদি অরওয়েলীয় ডিসটোপিয়া বা ‘দুষ্কল্প-রাজ্য’র ইঙ্গিতবাহী হয়, তা হলে গডসের গুরু সাভারকরকে সর্বোচ্চ জাতীয় সম্মান ‘ভারতরত্ন’ দেওয়ার আয়োজনও ইতিহাস পুনর্লিখনেরই প্রয়াস। যে প্রাক্তন বিপ্লবী আন্দামান সেলুলার জেল থেকে পর পর পাঁচটি চিঠি লিখে ব্রিটিশ শাসকদের বিরোধিতা না-করার বিনম্র মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পান এবং ‘হিন্দু মহাসভা’ গঠন করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের বর্শামুখ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দিকে ঘুরিয়ে দেন, তাঁকে আজ ভারতরত্নে ভূষিত করতে উন্মুখ তাঁরই মতাদর্শগত অনুগামীরা।
যাদের গুরু গোলওয়ালকর তাঁর বাঞ্চ অব থটস বইতে লিখে গিয়েছিলেন— ‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ব্রিটিশ-বিরোধিতাকে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক মনে করা হচ্ছে। এটা একটা প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি।’ কে জানে, ইহুদি গণহত্যার সমর্থক এই হিটলার-অনুরাগীকেও হয়তো ক্রমশ ভারতরত্নে ভূষিত করা হতে পারে, কেননা দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম থেকে যারা সযত্নে দূরে থেকেছে, এমনকি ব্রিটিশ পুলিশের গুপ্তচরের কাজ করে স্বদেশিদের ধরিয়েও দিয়েছে, তারাই তো আজ ‘দেশভক্তি’র প্রধান প্রবক্তা!
অযোধ্যার বিতর্কিত জমি নিয়ে দেশের শীর্ষ ন্যায়ালয়ের চূড়ান্ত রায়ের পর বাবরি স্মৃতি ক্রমশ আরও ধূসর হতে-হতে এক সময় বিস্মৃতির গর্ভেই হারিয়ে যেতে বাধ্য। শাসকের হাতে ইতিহাসের সেই পুনর্নির্মাণ কী ভাবে নতুন ও অনাগত প্রজন্মের কাছে সত্যের বিকল্প হয়ে ওঠে, তার হাড়-হিম-করা কল্পচিত্র আমরা জর্জ অরওয়েলের নাইন্টিন এইট্টিফোর উপন্যাসে পেয়েছি, যেখানে নিউস্পিক নামক নতুন ভাষা ও ভাষ্যে রাষ্ট্রীয় বিবর্তনের যাবতীয় অস্বস্তিকর তথ্যকে বিস্মরণের ভাগাড়ে পাঠিয়ে শাসকের মতাদর্শের বন্দনা রচিত হয়।
সব খবর পড়তে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত হোন – এখানে ক্লিক করুন