Thursday, March 13, 2025
ফিচার নিউজসম্পাদক সমীপেষুসম্পাদকীয়

‛আরো উগ্র হোন, আরো’ – মোদীকে তোপ হিন্দুত্ববাদীদের

ভার্গিস কে জর্জ : প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই করোনা আবহে বিচ্ছিন্নতাবাদ বিরোধী বার্তা দেওয়ায় বিশেষজ্ঞ মহলের ধারণা, বিজেপির বহু লালিত হিন্দুত্ব প্রকল্প কি কোনও ভাবে বাধাপ্রাপ্ত হল? কেননা, উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী দক্ষিণ পন্থীদের একটা স্বরচিত ‛ইকোসিস্টেম’ রয়েছে। সেই ‛তন্ত্র’- এ কি আঘাত লাগল প্রধানমন্ত্রীর এমন বর্তায়? না হলে তাঁরই সমর্থক ও ভক্তসম্প্রদায় কেন নেট রাজ্যে তাঁর সমালোচনায় অবতীর্ণ হবে? ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় নরেন্দ্র মোদীর ‛রমযান মুবারক’ ট্যুইটের অব্যবহিত পরেই দলীয় সমর্থকদের তির নিক্ষেপ শুরু হয়। একজন ট্যুইটে লিখেছেন, ‛মোদীজি, আমরা ট্যাক্স দিই, পিএম কেয়ারে অনুদান দিয়েছি, লকডাউন মেনে চলছি, অথচ সরকার তাদেরই তোষণ করছে, যারা কোনও নিয়ম – কানুন মানে না, চিকিৎসকদের নিগ্ৰহ করে। সরকারি ব্যয়ে তাদের চিকিৎসা হচ্ছে ও ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে। এটা কতদিন চলবে?’ প্রধানমন্ত্রীর ট্যুইট যেখানে রিট্যুইট হয়েছে পাঁচ হাজার বার, সেখানে এই সমালোচনামূলক ট্যুইট রিট্যুইট হাজার বার রিট্যুইট করা হয়েছে এবং তা ৩০ মিনিটের মধ্যেই। এই ট্রেণ্ড কয়েকদিন ধরেই অব্যাহত। প্রধানমন্ত্রীর কোন বার্তায় ক্ষুব্ধ হলেন তাঁর অন্ধ সমর্থকরা? তিনি লিখেছিলেন, ‛আমি সবার নিরাপত্তা, সুস্থতা ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করি। এই পবিত্র মাস দয়া, ঐক্য ও সৌহার্দ্য বয়ে আনুক। কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে আমরা যেন জয়লাভ করি এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি।’

প্রথমে রমযানের মুবারকবাদ, তারপর এই বার্তায় ক্ষোভে ফেটে পরে হিন্দুত্ববাদীদের ভার্চুয়াল বিশ্ব। এই বিক্ষোভের আরও একটি কারণ হল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে প্রবাসী ভারতীয়দের মুসলিম-বিরোধী মন্তব্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেন সেদেশের সুধীমহল ও রাজনীতিবিদরা। মোদি আরব-বিশ্বের এই অসন্তোষ প্রশমনে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি স্যোশাল মিডিয়ায় লিখেছিলেন,‌ ‛কোভিড-১৯ জাতি, ধর্ম, বর্ন, গোত্র, ভাষা বা দেশ দেখে আক্রমণ করে না। এই লড়াইয়ে আমরা সবাই এক সাথে আছি।’ তাঁর এই নির্বিরোধী বাক্যের সঙ্গে সহমত নন হিন্দুত্ববাদীরা। এই শিবিরের এক জনপ্রিয় মুখ ট্যুইটারে মোদীকে ট্যাগ করে লিখেছেন, আমরা এক সঙ্গে নেই, আমরা পুলিশের গায়ে থুথু ছিটাই না, বিদেশীদের মসজিদে লুকিয়ে রাখি না, আমরা তারা নই, যারা ডাক্তারদের গায়ে পাথর ছুঁড়ে মারি, যাতায়াতের তথ্য গোপন করে। ওরাই করে এবং তাদের পরিচয় সবাই জানে। হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের নয়নের আরও এক মণি কদর্য ভাষায় মোদিকে আক্রমণ করেছেন। আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতও এই শ্রেণীর বিষ বর্ষনের মুখে পড়েছেন এই অতি মহামারি পরিস্থিতিতে বৈষম্যমূলক আচরণের সমালোচনা করায়। মোদীকে মুসলিম তোষণকারীও বলা ‌হয়েছে, এর আগেও এই তকমা তিনি পেয়েছেন। ২০০৭ সালে বিশ্বহিন্দু পরিষদের প্রবীণ তোগাড়িয়া ও গোধন জাদাফিয়া বিদ্রুপ করে তাঁকে বলেছিলেন, ‛লাল মুহাম্মদ আদবানির নেতৃত্বে নূর মুহাম্মদ মোদী।’

আরএসএস ও মোদী মুসলমানদের সহানুভূতি অর্জনের জন্য ইতিপূর্বে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রাক্তন সংঘ-প্রধান এস সুদর্শন গড়েছিলেন মুসলিম রাষ্ট্রিয় মঞ্চ। ২০১১ সালে গুজরাত সদ্ভাবনা অধিবেশনের মাধ্যমে মোদী জাতীয় নেতা হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই অধিবেশনে তিনি মুসলিম গনমাণসের সমন্বয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। ২০১৮ সালে তিন দফা বক্তৃতায় মোহন ভাগবত তাদের চিরাচরিত মুসলিম-বিরোধী অবস্থানের বিপরীত বার্তা দিয়েছিলেন। গোলওয়ালকার প্রদর্শিত পথ থেকে সরে এসে তিনি বলেছিলেন, যেদিন বলা হবে আমরা মুসলিমদের চাই না, সেদিনই হিন্দুত্বের অস্তিত্ব লোপ পাবে।

এই জরুরিকালীন পরিস্থিতিতে খানিক পিছিয়ে এসে মূল এজেন্ডাকে শক্তিশালী করারই কৌশল এটা। এমনটা অনেকে ভাবতে শুরু করেছেন। তার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সংঘ-পরিবারের কথায় ও কাজে বিস্তর ফারাকই এই সন্দেহের মূলে। সম্প্রতি, দীনেশ নারায়ণন একটি বই লিখেছেন: দ্য আরএসএস অ্যাণ্ড দ্য মেকিং অফ দ্য ডিপ নেশন। সেই গ্ৰন্থে তিনি লিখেছেন, মুসলিমদের সম্পর্কে সংঘ-পরিবারের মধ্যে নানা মতবিরোধ রয়েছে, যার আজও সমাধান হয়নি। এটা তারই প্রতিফলন। যদি হিন্দুত্ববাদী আশাবাদী হয়ে উঠে, তাহলে কেমনটা হবে? ‛উইকিলিকস’ প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে অরুন জেটলি এক মার্কিন কুটনীতিবিদকে একদা বলেছিলেন, ‛আমি শীতল রক্তের মানুষ।’ গোরক্ষা বিষয়ে গোলওয়ালকরের বক্তব্যকে তিনি বলেছিলেন যে, এটা একটা কোমল আর্তনাদ।

সংঘ-পরিবারে দীর্ঘদিন কোনও সংস্কার হয়নি এবং তাদের বহু পুরানো যে বিধি-বিধান রয়েছে তাকেই তারা অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলবে অদূর ভবিষ্যতে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে এই যে সিদ্ধান্তহীনতা একে অযৌক্তিক মনে হতে পারে। দলতন্ত্র, মতাদর্শ, এমনকি ধর্মীয় গোঁড়ামিও সময়ের সঙ্গে বদলেছে। ক্যাথোলিক গির্জা ও চিনের কমিউনিষ্ট পার্টি এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। সুবিধাবাদী মনোভাব বা আন্তরিক সদিচ্ছা যেভাবেই হোক সহিষ্ণুতা ও বহুত্ববাদের সমন্বয় সাধনের পথে যদি হাঁটে সংঘ-পরিবার তাহলেই একে অগ্ৰগতি বা প্রগতি বলা যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর আশু সম্ভাবনা লক্ষ করা যাচ্ছেনা। সমন্বয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই পরিবারের মধ্যে থেকেই সমালোচনার তির নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তারা সনাতন পথ ধরে চলতেই স্বচ্ছন্দ। পর পর দু’বার লোকসভা নির্বাচনে হেরে ২০০৯ সালে এলকে আদবানী প্রাক্তন আরএসএস প্রধান দেওরার একটি কথাকে উদ্ধৃত করেছিলেন। দেওরা বলেছিলেন, পরিবারকে গ্ৰহণ ও বর্জনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং হিন্দুত্ব মানে মুসলিম বিরোধীতা এমন ব্যাখ্যা বন্ধ করা প্রয়োজন। জেটলি একে ‛মধ্যপন্থীদের জয়’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন।

সাম্প্রতিক নানা ঘটনাবলী থেকে অনুমেয় যে, সংঘ-পরিবারের হাতে আর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত নেই। তাই তাদের এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে পরিবারের নীচুতলার কর্মী ও সমর্থকদের মতামতকে। বজ্র আঁটুনি শিথিল হচ্ছে ক্রমশ। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, কেরালার শবরীমালা কান্ডে সংঘ শুরুতে আঁচ করেছিল যে, জনমত মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশের পক্ষে। তাই তারা ২০১৮ সালের সুপ্রিমকোর্টের রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল। কিন্তু অচিরেই অবস্থান বদলায় যখন উপলব্ধি করে যে জনমানসে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির দিল্লি দাঙ্গার ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। মার্কিন রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে এমন ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত হয়। ভিডিওতে দেখা যায় স্থানীয় বিজেপি নেতা উন্মত্ত জনতাকে দাঙ্গায় প্ররোচনা দিচ্ছেন। দিল্লি পুলিশও তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ, ‛টাস্কমাস্টার হিসাবে মোদী যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, বিশ্ব রাজনীতি মঞ্চে তা প্রশ্ন চিহ্নের মুখে পড়ে। বিস্ফোরক উক্তি করায় ভোপালের সাংসদ প্রজ্ঞা ঠাকুরের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেয় বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী এই মন্তব্যকে নস্যাৎ করে দেন। এরকম পূর্বে কখনও ঘটেনি। কিন্তু আইনের শাসনের সপক্ষে কেউ মতামত পেশ করলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দক্ষিণপন্থী নেকড়েরা তাকে সম্মিলিতভাবে আক্রমন করে স্তব্ধ করে দেয়। প্রাক্তন ক্রিকেটার গৌতম গম্ভীর যিনি এখন দিল্লির বিজেপি সাংসদ ট্রোলের শিকার হন। দিল্লি শহরতলীতে গত বছর এক মুসলিমকে জোর করে ‛জয় শ্রীরাম’ উচ্চারণ করতে বাধ্য করেছিল কয়েকজন হিন্দুত্ববাদী। গম্ভীর তাদের গ্ৰেফতারের দাবি জানিয়েছিলেন। বিজেপির সদস্য হয়েও তিনি উগ্ৰ জাতীয়তাবাদীদের নিশানা হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীকে যে ব্যক্তি ট্রোল করেছেন, তিনিই গম্ভীরকে আক্রমণ করেছিলেন সেদিন। এমনকি অভিনেতা অনুপম খেরও এই সমস্ত বিষয় থেকে প্রাক্তন ক্রিকেটারকে দূরে থাকতে অনুরোধ করেন।

উচ্চাকাঙ্খী নেতারা এতদিনে উপলব্ধি করেছেন যে, প্রগতিশীল মন্তব্য করলে নেতা হিসাবে গ্ৰহণ যোগ্যতা বৃদ্ধি পায় ও অন্যান্য উচ্চতা মেলে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‛একতা’ বার্তার কয়েকদিনের মধ্যেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুখতার আব্বাস নকভি সহ উত্তরপ্রদেশের অন্তত দুজন বিজেপি বিধায়ক বিভিন্ন শ্রেণী ও সম্প্রদায় সম্পর্কে অপমানকর মন্তব্য করেছেন। মোদী-বিরোধী ডিজিটাল জনতা এখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের মধ্যে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। কারণ ‛ধর্মনিরপেক্ষতা’র বাণী তাদের কাছে অশনিসংকেত। সংজ্ঞা অনুযায়ী জনতা কখনও নেতার নির্দেশ ও শর্ত মেনে চলেনা। বরং নেতা হতে গেলে জনতার নির্দেশ ও শর্তকে মেনে চলতে হয়। জনতার মন যিনি জয় করতে পারেন, তিনিই নেতা। দিল্লির দাঙ্গায় যে বিজেপি নেতা প্ররোচনা দিয়েছেন, আগামী দিনে তাঁর পদন্নোতির সমূহ সম্ভাবনা। গণমনের পাঠকই জনঅধিনায়ক। এটাই সারসত্য।

Leave a Reply

error: Content is protected !!