মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান : বাংলা আমার মায়ের ভাষা প্রাণের ভাষা। বুকের ভাষা এ ভাষায় কথা বলি এ ভাষায় ভাবি এ ভাষায় ভাবও প্রকাশ করি স্বপ্নও দেখি এই ভাষাতেই আর, স্বপ্ন দেখি এ ভাষার উন্নতি সাধনেরও প্রিয় মাতৃভাষা এই বাংলা বারবার বিপর্যস্ত হয়েছে পৃথিবীর আর কোনও ভাষার উপর এত বিপর্যয় নেমে আসেনি সম্ভবত। হিন্দু-মুসলিম-হিন্দু-মুসলিম করতে গিয়ে বাঙালি জাতি যেমন বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, তেমনই বাংলাভাষাও ধাক্কা খেয়েছে বারংবার হয়েছে আঘাতপ্রাপ্ত তবুও হীন্মন্যতার কোনও কারণ দেখি না। বাংলাভাষা আজ বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে তার স্বতন্ত্র মর্যাদা ও স্বকীয় মহিমা অবশ্যই এর পিছনে অন্যতম অবদান আছে বাংলার মুসলিম সমাজের কী সুলতানি আমলে, কী ইংরেজ আমলে, কী হাল আমলে—বাঙালি মুসলিম বরাবরই প্রাধান্য দিয়ে চলেছেন সাবলীল বাংলাকে।
অথচ, একশ্রেণির শিক্ষিত মুসলিমদের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একপ্রকার অনাবশ্যক হীনম্মন্যতা কাজ করে। তাঁদের ধারণা, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিমদের তেমন উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। তাঁদের এ ধারণা সম্পূর্ণ মূলহীন। তাই মূল্যহীনও বাস্তবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এবং বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় মুসলিমদের অবদান অপরিসীম। অবশ্য তাঁদের ওই ভিত্তিহীন ধারণা গড়ে ওঠার মূলে আছে প্রকৃত তথ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ না পাওয়া। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে উল্লেখযোগ্য লেখালেখি ও বইপত্রের ঘাটতি থাকা। তার ওপর একপেশে উপস্থাপন দেখেশুনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। এই একপেশে মানসিকতা নিয়ে বাংলা ভাষাকে ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ বলা হয়ে থাকে। অপরদিকে ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমাণ করে গিয়েছেন বাংলা ভাষা সংস্কৃতের দুহিতা নয় বরং ‘দূর সম্পর্কের আত্মীয়া’ হতে পারে।
আসলে, বাংলার বুকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছিল বৌদ্ধদের হাতে। বিশেষত পাল রাজাদের শাসনামলে। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রণীত চর্যাপদ ও দোহাগুলি রচিত হয়েছিল এখানকার সাধারণ মানুষদের ভাষায়, তখনকার কথ্য বাংলায়। পরবর্তীকালে, ১১ শতকে, দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে হিন্দু সেন রাজারা এসে বাংলা দখল করেন। উৎখাত করেন বৌদ্ধদের। প্রবর্তন করেন হিন্দু ধর্মের। এই সেন রাজবংশের লক্ষণ সেন ও বল্লাল সেন কনৌজ থেকে নিয়ে আসেন উঁচু দরের কতিপয় ব্রাহ্মণকে। তাঁদের দিয়ে কৌলিন্য প্রথা চালু করানো হয় এখানে। এই আগ্রাসনের নিশানায় চলে আসে ভাষাও। সেনরাজাদের আইনবলে আঞ্চলিক তথা বাংলা ভাষায় সাহিত্য ও ধর্মচর্চা নিষিদ্ধ করা হয়।চালানোর আদেশ দেওয়া হয় শুধু সংস্কৃত। যা সাধারণ মানুষদের আয়ত্তের বাইরে। অতএব ভাষা, সাহিত্য ও ধর্মচর্চার ছড়ি ঘোরানোর একচ্ছত্র অধিকার থাকল কুলীন ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের হাতে। (এখনকার হিন্দিভাষীদের আগ্রাসনের কথা স্মর্তব্য)। কিন্তু সবাই তো আর রাজার আদেশ তোয়াক্কা করে না। তাই ধর্মের ভয়ও দেখানো হলো। রাজাদের আনুকূল্যে ব্রাহ্মণরা বানিয়ে ফেললেন নতুন শাস্ত্রীয় বিধান। সংস্কৃত শ্লোক পর্যন্ত। বলা হলো :
“অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য-চরিতনিচ,
ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।”
মানে : অষ্টাদশ পুরাণ, রামচরিত ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্র লোকভাষায় (পড়ুন বাংলায়) আলোচনা করলে, শুনলে ঠাঁই হবে রৌরব নরকে। আর এই রৌরব হলো সবচেয়ে ভয়ংকর নরক। সেই যুগে, শ্রী দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়, “ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে পণ্ডিতমন্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন, বঙ্গভাষা তেমনই সুধীসমাজের অপাংক্তেয় ছিল—তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল।”
বাংলা ভাষার এই দমবন্ধ-করা অবস্থার অবসান ঘটে ১২০৪ সালে, বাংলার মাটিতে তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খলজির আগমন ও শাসনলাভের মধ্য দিয়ে | এ প্রসঙ্গে শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন লিখেছেন : “হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল। গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন। আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভূমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভূমি হইল।
এরপর বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ভাষায় রামায়ণ, মহাভারতসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ অনুদিত হয়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় নতুন প্রাণের সঞ্চার ঘটে।মুসলিম কবি-সাহিত্যিকরাও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে থাকেন। স্বাভাবিক কারণে বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের মিশ্রণ ঘটে। কিন্তু পলাশী-প্রহসনের পর আবার এই বাংলার আকাশে ঘনীভূত হয় দুর্যোগের ঘনঘটা। পরে, ইংরেজদের আনুকূল্যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গ্রন্থমালা প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয় সরল ও সাবলীল আরবি-ফারসি শব্দসম্ভার।কৃতী পন্ডিতদের দ্বারা কৃত হয় বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন।সংস্কৃতের আধিক্যে বঙ্গভাষা রূপান্তরিত হয় জটাজূটধারী সাধুতে। এই সময় মুসলিম কলমধারীরা কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলেও, মীর মশাররফ হোসেন দেখিয়ে দিয়েছেন, বঙ্কিমী বাংলায় তাঁরাও সাহিত্য করার ক্ষমতা রাখেন। ওই আমলে বাংলার বিধানসভায় হিন্দু সদস্যরা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়, “সাহেবি পোশাক পরে এসে বক্তৃতায় ইংরেজির ফুলঝুরি ছোটাতেন, লুঙ্গির ওপর পাঞ্জাবি পরা গ্রামের মুসলমানরা প্রথম বক্তৃতা শুরু করলেন বাংলায়।
(লেখা বড়ো হয়ে যাচ্ছে সংক্ষেপে সারি) এরপরের ঘটনাপ্রবাহ তো সবার জানা।দেশভাগ হয়। ভাগ হয় বাংলাও। পূর্ববাংলায় (পাকিস্তানে) নেমে আসে উর্দুর আগ্রাসন। বাংলা ভাষার জন্য শুরু হয় আবার সংগ্রাম। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ।অসংখ্য শহিদের প্রাণের বিনিময়ে বাংলারই মুখে বিজয়ের হাসি ফোটে শেষপর্যন্ত। বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় বাংলা নামে স্বাধীন একটি দেশও। বর্তমানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের লাগাম মূলত সেদেশের মানুষদের হাতে। আর পণ্ডিতদের সাধু বাংলা তো সাধারণ মানুষ অনেক আগেই বর্জন করেছে।
(পুনঃপ্রকাশিত কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত)