আফরিদা খাতুন আঁখি: শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। ইতিহাস সাক্ষী, কোনও জাতি যখন শিক্ষার ক্ষেত্রে নিজেদের শিথিলতা প্রদর্শন করে, তখন তাদের স্থান হয় একদম পশ্চাতে। আর যে জাতি এই ব্যাপারে নিজেদের আগ্রহ অথবা নৈপুণ্য প্রদর্শন করে, কালের স্রোত অতিক্রম করেও সে তার স্থান করে নেয় উন্নতির একদম শিখরে। আবার একটা জনজাতিকে ধ্বংস করার জন্য শিক্ষা ক্ষেত্রে একটা মোক্ষম আঘাতই যথেষ্ট।
২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহান থেকে জন্ম নেওয়া দ্য নোবেল করোনার সাথে সমগ্র বিশ্ব পরিচিত হয়েছে। বিগত তিন বছর ধরে করোনা বারে বারে হানা দিয়ে তছনছ করে দিয়েছে সমগ্র বিশ্বের জনজীবন, বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনের ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন সমস্তটা। করোনা এ পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৫৪ লাখের অধিক প্রাণ। শুধু জীবন কেড়ে নিয়ে করোনা ক্ষান্ত হয়নি, স্তব্ধ করেছে মানুষের স্বাভাবিক ছন্দ, বিধ্বস্ত করেছে সমগ্র বিশ্বের শিক্ষার্থী ও শিক্ষার মধ্যে সুন্দর সম্পর্ককে। শিক্ষা ব্যবস্থায় অনলাইন শিক্ষার আগমন ঘটার ফলে, অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থীই পর্যাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। ফলে তারা শিক্ষা থেকে নিজেকে দূরে সরাতে বাধ্য হয়েছে। আবার কোথাও পারবারিক অভাব অনটন ঘোচাতে, দূর্বল কাঁধে তুলে নিয়েছে রোজগারের ভার।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা কাটিয়ে পরিবেশের স্বাভাবিকতা ফিরে আসার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারে পক্ষ থেকে ২০২১ সালের নভেম্বরের ১৫ তারিখে যখন স্কুল, কলেজ খোলার নির্দেশ দেওয়া হয় তখন কিছুটা কেটেছিল দুশ্চিন্তার ছাপ। কারণ আমরা সকলেই অবগত শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটার কারণে ছাত্রসমাজের সাথে সাথে এই জাতি কতটা অন্ধকারে তলিয়ে গেছে। কিন্তু করোনার তৃতীয় ঢেউ ওমিক্রণের আগমনে পুনরায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের আদেশে অনেকটাই ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঢেলা দেওয়া হল এই জাতির ভবিষ্যত প্রজন্মকে। অনেকে হয়তো বলবেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর এহেন পদক্ষেপের পেছনে রয়েছে ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তার প্রতি তাঁর বিশেষ খেয়াল। কিন্তু শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যের দিকে যদি তাঁর প্রকৃতই খেয়াল থাকে তাহলে ওমিক্রণের তীব্র থাবার আগমনের কথা শুনেও কেন তিনি বড়দিন, বর্ষবরণেরর বিশাল জনসমাগমে কোনো প্রকার বিধি নিষেধ আরোপ করেননি? রাজ্য সরকার শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যের ব্যাপরে আসলেই যদি সচেতন তাহলে ভিত্তিহীন লবণতত্ব রাজ্য সভায় উপস্হাপন করে গঙ্গাসাগরের লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাগমের অনুমতি কোন যুক্তিতে দিলেন? দ্য ওয়াল এর তথ্যানুসারে, কপিলমুনি মন্দিরের মহন্ত সঞ্জয় দাসও এই মুহূর্তে মেলা বন্ধ হলে তাঁদের আপত্তি নেই বলে জানান। গত মঙ্গলবার তিনি দ্য ওয়ালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান যে, ‘করোনা মোকাবিলায় প্রশাসন, আদালত যদি মেলা বন্ধ রাখতে বলেন তাহলে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। মানুষের জীবন আগে। ভগবান প্রত্যেক মানুষের জন্য আছেন।’ চিকিৎসকদের মতেও সরকারের এই সিদ্ধান্ত জনজীবনকে বিপদসঙ্কুল অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে। গঙ্গাসাগরের লাখলাখ লোকের সমাগমের ফলে সংক্রমণ যে অধিক মাত্রাতে ছড়াবে তা একজন স্থূল বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যাক্তির কাছেও বোধগম্য। আর সংক্রমণ বাড়বে আর সংক্রমণ বাড়লে লকডাউন আরও দীর্ঘ হওয়ায় স্বাভাবিক।
করোনা পরিস্থিতির পর থেকে আমরা বারবার দেখছি বিপদ থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার মিটিং মিছিল, দূর্গাপুজা সব ক্ষেত্রেই বিধিনিষেধ সিকেই তুলে দেন। কিন্তু যখনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর প্রসঙ্গ আসে, তখনই আবার নানরকম বিধিনিষেধের অজুহাত দেখিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজাগুলোতে। এক্ষেত্রে আবার অনেক অভিভাবকও সহমত প্রদর্শন করেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে সমস্ত অভিভাবকরা স্কুলে গেলে তাঁদের সন্তানদের সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে ভীত হয়ে স্কুল বন্ধের পক্ষে রায় দেন, তাঁরাই আবার তাঁদের সন্তানদের নিয়ে জনবহুল মণ্ডপ প্রদর্শন করেন অথবা বিবাহ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
একবছর গঙ্গাসাগর মেলা না হলে হিন্দু সমাজের প্রতি ইষ্ঠ দেবীর অভিশাপ পড়ার মত নিষ্ঠুর ধর্ম আমার হিন্দু ধর্মকে কোন কালেই মনে হয়নি, বরং দেবীর আরোধনা করতে গিয়ে সমাজে অনাচার সৃষ্টি হলে তাতে দেবী হয়তো রুষ্ঠ হতে পারেন। শিক্ষার প্রতি এই উদাসীনতা যুবসমাজকে গভীর হতাশার দিকে ঢেলে দিচ্ছে। শাসক শ্রেণীর কেন বোধগম্য হচ্ছে না যে, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড বা লক্ষ্মী ভাণ্ডারের ৫০০ টাকা অথবা স্বাস্থ্যসাথী নামক ভিক্ষা প্রদর্শন এই সমাজকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট না? এই পদক্ষেপের কারণে স্কুলছুটের হার কী বাড়বে না? সরকারের এহেন শিক্ষার প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন কী এক গভীর অন্ধকারে ভাবি প্রজন্মকে ঢেলে দিচ্ছে না? বেকারত্বের সমস্যাকে বারবার ধামাচাপা দিতেই কী রাজ্য সরকার শিক্ষার ক্ষেত্রে এমন কঠোরতা প্রদর্শন করছে না? সমস্ত ক্ষেত্রে পঞ্চাশ শতাংশ উপস্থিতি বৈধ করলে স্কুল কলেজে কেন তা সম্ভব না? করোনাকালীন অবস্থাতে ভোট প্রক্রিয়া সম্পাদনের জন্য শিক্ষক, শিক্ষিকা নিয়োজিত করা হলেও কেন তাহলে কোভিড প্রটোকল মেনে তাদের শিক্ষাদানে অনুমতি দেওয়া যাবে না? উত্তরের আশায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।