দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক: কৃষক আন্দোলনে টলমল কেন্দ্রীয় সরকার। ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে দেশ দেখেছে দিল্লির পথে কৃষকদের ট্র্যাক্টর প্যারেড পরে তা ব্যাপক রূপ নেয়। লালকেল্লা দখল করে নেয় কৃষকরা। ১৯০ বছর আগের এক কৃষক নেতার আন্দোলন কাঁপিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন ইংরেজ সরকারকে। আন্দোলনে গর্জে উঠেছিল এক কৃষক নেতা। তাঁর সঙ্গ দিয়েছিলেন লাখ খানেক হিন্দু মুসলমান। একযোগে রুখে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে। নেতৃত্বে তিতুমীর। ২৭ জানুয়ারি , আজ তাঁর জন্মদিন। কৃষক আন্দোলনের সময়ে আরও একবার স্মরণ করা বাংলার এই কৃষক নেতার বিখ্যাত লড়াইকে।
এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তাঁর হজ যাত্রা থেকে ফিরে আসার পরেই। ১৮২১ সালে তিতুমীর মক্কায় হজ করতে যান, সৈয়দ আহমেদ-এর সঙ্গে দেখা হয়। পরে সৈয়দ আহমেদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি, ওয়াহাবি মতবাদে অনুপ্রাণিত হন। যদিও সৈয়দ আহমেদ তৎকালীন ভারতে অখণ্ড ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁর অনুগামী হয়েও উলটোপথেই হাঁটেন তিতুমীর, মক্কায় থেকে ফিরে এসে তিতুমীর তাঁর গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সাথে নিয়ে জমিদার ও ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায় সেখান সমানভাবে অংশ নিয়েছিল। এইসময়ে জমিদার ও নীলকর সাহেবরা আতঙ্কিত হয়ে পরে। বলা হয়েছিল যারা তিতুমীর ও তাঁর সঙ্গীদের বাড়িতে স্থান দেবে তাদের বাড়ি ঘর থেকে উচ্ছেদ করা হবে। দমে যাননি তিতুমীর। উলটে তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ও নীলকর সাহেবদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হয়ে ওঠে।
তিতুমীর আগে জমিদারদের লেঠেল হিসাবে কাজ করতেন। তাই তাঁর অনুগামীদের নিজেই প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন। তিতুমীরের প্রাথমিক অনুগামীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০০০ মত। যত সময় যায় তাঁর অনুগামীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। চব্বিশ পরগণা, নদীয়া, এবং ফরিদপুর (বাংলাদেশ) বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে বিভিন্ন জমিদার ও ব্রিটিশ শাসণের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষনা করেন তিতুমীর। বিখ্যাত বারাসাত বিদ্রোহ” সময় সেই সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছিল। উইলিয়াম হান্টার নামে এক ইংরেজ সাহেবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ‘এই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষক সেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করে। স্থানীয় জনিদার ও ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের কাছে বেশ কয়েকবার পরাজয় হয়।’
১৮৩১ সালে ২৩ অক্টোবর উত্তর চব্বিশ পরগণার বারাসতের নারিকেলবেড়িয়া গ্রামে তিনি বাঁশের কেল্লা তৈরী করেন। ততদিনে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ছিলেন তিতুমীর। কেল্লা তৈরী হয় বাঁশ ও মাটি দিয়ে। এই কেল্লাই ছিল বারাসত বিদ্রোহের সদর দফতর। বিদ্রোহ দমন করতে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। প্রথমে ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারিদিকে ঘিরে ফেলেছিল। সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র, বল্লম, বর্শা, ও লাঠি এইসব নিয়ে তিতুমীর ও তাঁর অনুগামীরা সৈন্যদলেরা ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু তিতুমীরতো এই যুদ্ধের আগেই বলেছিলেন, ‘ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে, লড়াইয়ে হার জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে হবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যাদা অনেক, তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়, আমাদের কাছে থেকে প্রেরণা পেয়েই এদেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে, আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এইপথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।’
তাই শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন তিতুমীরের অনুগামীরা। কামানের আঘাতে বাঁশের কেল্লা ধংস হয়। এরফলে তিতুমীর ও তাঁর অনেক অনুগামীরা বীরের মত যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। তিতুমীরের বাহিনী প্রধান মাসুম খাঁ কে ফাঁসি দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলা বিহার উড়িষ্যা কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ভারতের এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আদিপত্য প্রতিষ্ঠার স্থাপনের ফলে মধ্যবিত্ত, কৃষক, তাঁতি কারিগর ও শিল্পী প্রভৃতি সাধারণ মানুষজন সমস্যায় সম্মুখীন হয়। কোম্পানির সরকার প্রবর্তিত নতুন রাজস্বনীতি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ভারতবাসীর মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একদিকে শিল্পবিপ্লবের ফলে ব্রিটেনেরর কলকারখানায় ব্যপক হারে ভোগ্যপণ্য উৎপাদিত হতে থাকে। কিন্তু ভারতীয় পণ্য উপর উচ্চ হারে কর ভার চাপিয়ে সরকার বিভিন্নভাবে ভারতীয় শিল্পের ধংসের মুখে ঠেলে দেয়। ফলে প্রচুর কুটীরশিল্প ধংস হয়ে যায়। এইসময়ে বিভিন্ন ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনেরর সূত্রপাত ঘটে। অন্যতম তিতুমীরের নেতৃত্বে ‘বারাসত বিদ্রোহ’।