দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক: প্রথমে কোটাবিরোধী আন্দোলন, পরে শেখ হাসিনার পদত্যাগ — গত দু’মাস এই দুই দাবিতে দফায় দফায় উত্তপ্ত হয়েছে বাংলাদেশ। রক্ত ঝরেছে প্রচুর। প্রচুর মানুষের মৃত্যু হয়েছে। জনরোষের মুখে পড়ে বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট কোটা সংস্কারের পক্ষে রায় দিয়েছে। সোমবার পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন হাসিনা। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। তবে পরে সরকারকে ‘অগণতান্ত্রিক’ আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের সুর আরও এক ধাপ চড়ে। বিশাল আকার ধারণ করে বাংলাদেশের ছাত্রবিক্ষোভ।
গত দু’মাসে কী ভাবে অশান্ত হয়ে উঠল সোনার বাংলা? কোন পথে চলল আন্দোলন?
স্বাধীনতার আগে এবং পরে— অনেক প্রাণহানির সাক্ষী থেকেছে বাংলাদেশ। আন্দোলনের সূত্রপাত মোটামুটি ভাবে ৫ জুন থেকে। হাসিনার পদত্যাগের ঠিক দু’মাস আগে থেকে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মোট ৫৬ শতাংশ আসন সংরক্ষিত ছিল। ৪৪ শতাংশ আসন সাধারণের জন্য নির্ধারিত ছিল। ১৯৭২ সাল থেকে এই নিয়ম চলে আসছিল। ৫৬ শতাংশের মধ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের জন্য ৩০ শতাংশ, মহিলাদের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জেলার জন্য ১০ শতাংশ, জনজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ সংরক্ষিত পদ ছিল। ২০১৮ সালে সংরক্ষণ সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় প্রধানমন্ত্রী হাসিনা নির্দেশ জারি করে মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ এবং জেলা খাতে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ বাতিল করে দেন। রাখা হয় শুধু জনজাতিদের ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের ১ শতাংশ সংরক্ষণ।
পরে সাত জন মুক্তিযোদ্ধার স্বজন ২০১৮-র সংরক্ষণ বাতিলের নির্দেশনামার বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাইকোর্টে যান। গত ৫ জুন হাইকোর্ট রায় দেয়, হাসিনা সরকারের নির্দেশ অবৈধ। নির্দেশনামা বাতিলের অর্থ ফের আগের মতো সংরক্ষণ ফিরে আসা। তারই প্রতিবাদেই বাংলাদেশের ছ’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা ফের আন্দোলনে নামেন। বিক্ষোভকারীদের দাবি ছিল, হাইকোর্টের রায়ে আখেরে লাভ হবে আওয়ামী লীগের অনুগামী পরিবারগুলির। প্রথমে সেই প্রতিবাদ শান্তিপূর্ণ হলেও পরে তা হিংসাত্মক চেহারা নেয়। তবে ছাত্রবিক্ষোভ শুরুর পরের দিনই, অর্থাৎ, ৬ জুন ঈদ উপলক্ষে আন্দোলনে ভাটা পড়ে। ঈদ উদ্যাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সারা দেশ। তবে পড়ুয়াদের এই বিক্ষোভকে কোনও ভাবেই গুরুত্ব দিতে রাজি ছিলেন না হাসিনা। তাঁর মন্তব্য ছিল, ‘‘ছাত্ররা নিজেদের সময় নষ্ট করছেন।’’
এর পর ৭ জুন থেকে আবার বাংলাদেশের কোটা ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের আগুন ধিক ধিক করে বাড়তে শুরু করে। ৩০ জুনের মধ্যে তা সারা দেশে ছড়িয়ে প়ড়ে। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রদের উপর চড়াও হয় পুলিশ। ১৫ জুলাই হাসিনা বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক সহযোগীদের তুলনা করেন। তাঁর এই মন্তব্যে ছাত্রবিক্ষোভ আরও বড় চেহারা নেয়। এর পর বিক্ষোভকারীদের মারধরের অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। এমনকি, ঢাকা হাসপাতালে ঢুকে আহত আন্দোলনকারীদের মারধরও করেন। ১৬ জুলাই ৬ জনের মৃত্যু হয়। দেশ জুড়ে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশ দেয় হাসিনা সরকার। ১৭ জুলাই মৃত বিক্ষোভকারীদের স্মরণে মিছিল চলাকালীন সেই মিছিলে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে বাংলাদেশি পুলিশের বিরুদ্ধে। এর পর বিক্ষুদ্ধ ছাত্রেরা দেশ জুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেন। ওই একই দিনে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন হাসিনা। কী ভাবে ছ’জনের মৃত্যু হল, তা তদন্ত করে দেখা হবে বলেও আশ্বাস দেন। পাশাপাশি ওই একই দিনে দেশ জুড়ে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয় সরকারের তরফে।
১৮ জুলাই হাসিনার আন্দোলন বন্ধের আর্জিতে সাড়া না দিয়ে পাল্টা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে তাঁর পদত্যাগের দাবিতে সরব হন পড়ুয়ারা। এর মধ্যেই ওই একই দিনে বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেল এবং একাধিক সরকারি ভবনে আগুন ধরিয়ে দেন। সব মিলিয়ে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। এর পর দিন, অর্থাৎ ১৯ জুলাই সরকারের তরফে কার্ফু জারি করা হয়। যদিও সেই কার্ফু মানতে রাজি হননি আন্দোলনকারীরা। কার্ফুর জেরে ২০ জুলাই আন্দোলনের তীব্রতা কিছুটা কমে। হাজার দুয়েক বিক্ষোভকারী গ্রেফতার হন। তাঁদের মধ্যে ছাত্রদের পাশাপাশি বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকেরাও ছিলেন। আন্দোলন ছাত্রদের গণ্ডি পেরিয়ে সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।
২১ জুলাই সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়ে হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট। শীর্ষ আদালত রায় দেয়, দেশের সংরক্ষণ ব্যবস্থার সংস্কার করা হবে। হাইকোর্টের রায় বাতিল করা হলেও সংরক্ষণ ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করা হয়নি। দেশের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে মোট সাত শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়। তার মধ্যে পাঁচ শতাংশ সংরক্ষণ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য। বাকি দুই শতাংশ অন্য শ্রেণির জন্য। ৯৩ শতাংশ নিয়োগই হবে মেধার ভিত্তিতে। আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরার আর্জিও জানায় আদালত। ২৩ জুলাই সরকারের তরফে কোটা সংস্কার সংক্রান্ত অর্ডার পাশ করা হয়। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা তা নাকচ করে দেন। ২৬ জুলাই বাংলাদেশের পুলিশবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রছাত্রী-সহ অনেক আন্দোলনকারীকে গ্রেফতার করে। ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। নিষিদ্ধ করা হয় তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র শিবিরকেও।
২ অগস্ট থেকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের আন্দোলন ঘিরে আবার উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ৩ অগস্ট আন্দোলনকারীদের যৌথমঞ্চ, ‘বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর পূর্বঘোষিত মিছিল কর্মসূচি ঘিরে রক্তাক্ত হয়ে ওঠে কুমিল্লা শহর। শনিবার কুমিল্লা শহরে কোটা সংস্কারপন্থী পড়ুয়াদের মিছিলে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে আওয়ামী লীগের ছাত্র শাখা ছাত্র লীগের সশস্ত্র দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় অন্তত পাঁচ জন আন্দোলনকারী গুরুতর জখম হন। ৪ আগস্ট সেই আন্দোলন তীব্রতর হয়ে ওঠে। হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। আন্দোলনকারীদের যৌথমঞ্চের ডাকে রবিবার থেকে বাংলাদেশে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন। আন্দোলনের নয় দফা দাবি নেমে আসে এক দফায়— হাসিনা সরকারের পদত্যাগে।
৫ অগস্ট পুলিশের গুলিতে আরও পাঁচ বিক্ষোভকারীর মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ জুড়ে উত্তাপ আরও ছড়িয়ে পড়ে। হাসিনাকে পদত্যাগের সময় বেঁধে দেয় বাংলাদেশের সেনাবাহিনী। হাসিনা ইস্তফা দিয়েই দেশ ছাড়েন। সোমবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ ঢাকার বাসভবন ছেড়ে বোনকে নিয়ে কপ্টারে রওনা হন শেখ হাসিনা। কপ্টারে চেপে ভারতে পৌঁছন। হাসিনা ঢাকা ছাড়ার আগেই বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর তরফে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার আগে বাংলাদেশের বিশিষ্টজন এবং রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন ওয়াকার। এর পর ভারতীয় সময় অনুযায়ী, সাড়ে ৩টে নাগাদ দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তৃতা শুরু করেন সেনাপ্রধান। তিনি বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেশ চালাব। প্রতিটি হত্যার বিচার হবে।’’
হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তেই দিকে দিকে ধরা পড়ে বিজয়োল্লাসের ছবি। আন্দোলনকারীদের দীর্ঘ দিনের রাগ-ক্ষোভ বদলে যায় হাসিতে। কেউ কেউ আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়ে নামাজ ও মোনাজাত শুরু করেন। কারও কারও গলায় শোনা যায় আনন্দ মেশানো চিৎকার। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আনন্দে শামিল হতে দেখা যায় সেনাবাহিনীকেও। ট্যাঙ্কের মাথায় চড়ে থাকা বাহিনীকে হাসতে হাসতে হাত মেলাতেও দেখা যায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে। হাসিনা দেশ ছাড়ার পর তাঁর বাসভবন গণভবনেও ঢুকে পড়েন বিক্ষোভকারীরা। সেখানে স্লোগান এবং উল্লাসের মাধ্যমে বিজয় উদ্যাপন করেন তাঁরা। বাংলাদেশের পতাকা হাতে অনেকে গণভবনের মাথায় চড়েন। সেখানে থেকে আনন্দে চিৎকার শুরু করেন সাধারণ মানুষ। ‘গণভবন’ থেকে সংসদ ভবন, দখল নেয় আন্দোলনকারীরা। বাংলাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন থেকে হাসিনার পদত্যাগ। গত দু’মাসে ‘সোনার বাংলা’ নয়, অন্য বাংলাদেশ দেখেছে বিশ্ব। এখন সে দেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিস্থিতি কোন দিকে এগোয়, তার দিকেই তাকিয়ে মানুষ।