সুরাইয়া খাতুন
কোভিড-১৯-এর আঘাতে সারা বিশ্ব আজ তছনছ। প্রায় ১০ কোটির দেশ ভিয়েতনামে করোনায় আক্রান্ত হয়ে একজনও মারা যায়নি। ৮০ বছরের বৃদ্ধও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনায় মরেনি, খিদের জ্বালায় কেউ মরেনি, করোনার দায় বিশেষ কোনো ধর্মের মানুষের ওপর চাপানো হয়নি।
অথচ ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য পরিষেবা মোটেও উন্নত দেশগুলোর মতো নয়। প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য সেখানে চিকিৎসকের সংখ্যা ৮। ভিয়েতনাম প্রমাণ করেছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা খুব উন্নত না হয়েও করোনা মোকাবিলায় সফল হওয়া যায়।
কীভাবে ভাইরাস মোকাবিলায় ভিয়েতনাম অবিশ্বাস্য সফলতা দেখাল, সেটা সমগ্র বিশ্বের কাছেই এখন এক অনুসন্ধানের বিষয় হয়ে উঠছে।
⏹ রোগ ধরা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি তারা। তার আগেই কাজে নেমে পড়েছিল। শুরুতে যারাই সংক্রমিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের চলাফেরা-মেলামেশার ইতিহাস সংগ্রহ করা হতো।
⏹ গত ১৭ মার্চ থেকে দেশটিতে সর্বত্র মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। মাস্কের দাম বাড়ানোকে বড় আকারে শাস্তির আওতায় আনা হয়। ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য লুকানোকেও শাস্তিযোগ্য করা হয়। রাস্তায় রাস্তায় ‘মাস্কের ফ্রি এটিএম বুথ’ খোলা হয়।
⏹ সে দেশে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ সচল রাখতে মাস্কের এটিএম বুথের মতোই চালেরও বুথ খোলা হয়।
⏹ ভিয়েতনামের নীতিনির্ধারকেরা কেবল ভাইরাসকে থামিয়েই নিজেরা থামেননি; দেশটিতে সংক্রমণ কম থাকা সত্ত্বেও ভাইরাসযুদ্ধে সেখানকার সরকারের আরেকটি বড় উদ্যোগ ছিল ‛টেস্ট কিট’ নিয়ে গবেষণা এবং এটা তৈরিতে নামা। এ ক্ষেত্রে তারা এখন বিশ্বজুড়ে দৃষ্টান্ত। জানুয়ারিতেও তারা কোরিয়া থেকে কিট আমদানি করেছিল। এপ্রিলে এসে দেখা যাচ্ছে, কিটের গবেষণা ও উৎপাদন শেষে তারা সেটা প্রায় ২০টি দেশে রফতানি শুরু করেছে।
⏹ ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে করোনার সংক্রমণ কম রাখতে ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য প্রশাসন হাসপাতালের রুমগুলো পরিষ্কার করে রাখা হয়। এ ছাড়া চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সবার খাবার-দাবার প্রস্তুত রাখার জন্য বড় সংখ্যায় স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়।
দীর্ঘ সময়ে কাজের উপযোগী পোশাক সরবরাহ করা হয় চিকিৎসকদের। প্রতি দফায় ডিউটির জন্য এক সেট পোশাক দেওয়া হতো। টয়লেটে যাওয়া কমাতে এই চিকিৎসাকর্মীদের বিশেষ ধরনের ডায়াপারও দেওয়া হয়।
⏹ বিদেশিদের আসায় সাময়িক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। হোটেল ও সামরিক ছাউনিগুলোর অনেকটিকে অস্থায়ী হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্র বানিয়ে ফেলা হয়।
⏹ বিমানগুলো আসার খবর আগেই ঘোষণা করা হতো এবং সব যাত্রীকে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট করা বাধ্যতামূলক করা হয়। বিমানবন্দরেও বিনা খরচে ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা হয়।
⏹ যে এলাকায় সংক্রমণের খবর মিলত, সেখানে পুরো এলাকাকে কোয়ারেন্টিন করে টেস্ট শুরু হতো। কোয়ারেন্টিন করা জায়গার আশপাশেই খোলা হতো অস্থায়ী আশ্রয় ও চিকিৎসাকেন্দ্র।
⏹ মার্চ থেকেই ভিয়েতনামে আসা সব নাগরিককে বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে নেওয়া হয়।
এই সেই ভিয়েতনাম, যে দেশটাকে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল আমেরিকা! আজ করোনা-চক্রে উল্টো ইতিহাস! নিজেদের স্বল্প ক্ষমতা নিয়েও ভিয়েতনাম চার লাখ পিপিই পাঠিয়েছে আমেরিকাকে। সেই আমেরিকা যে ১৯৭২ সালে রোজ সকালে ন্যাপাম বোমা ছুঁড়ত এই দুর্বল দেশটার ওপর। অ্যাপোক্যালিপস নাও সিনেমায় একটা সংলাপ ছিল, “I love the smell of Napalm every morning.”
ভাবা যায়, সেই ভিয়েতনাম ন্যাপাম বোমার বদলে আমেরিকাকে আজ পিপিই দিচ্ছে! এখান থেকে এটাই প্রমাণিত, ক্ষমতা সব যুদ্ধে জেতায় না।