Monday, February 24, 2025
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদকীয়

এ আন্দোলন কি শুধু মুসলিমদের? হিন্দু ভাইদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ চোখে পড়ছে না কেন?

ছবি : সংগৃহিত
জুবায়ের আহসান

ভারতীয় উপহাদেশের বাসিন্দা হিসেবে আমরা এক অনন্য বিশেষত্বের অধিকারী। কোনও দুর্ঘটনায় যদি আমার কিছু ক্ষতি হয়, তাহলে ব্যাথিত হই, আর প্রতিবেশীর যদি দ্বিগুণ ক্ষতি হয় তাহলে নিজের ক্ষতি ভুলে প্রতিবেশীর দ্বিগুণ ক্ষতির জন্য একে নিজের নৈতিক জয় মনে করি এবং সেলিব্রেশন শুরু করি। আরব্য রজনীর সেই দৈত্যের কথা মনে আছে? যে সর্বদায় মালিকের চাইতে প্রতিবেশীকে দ্বিগুণ পুরস্কার দিত! যেমন মালিক যদি এক তলা বাড়ি চাইত তাহলে প্রতিবেশীকে দুতলা বাড়ি দেওয়া হত। শেষে মালিকের চালাকির কাহিনী তো সবার জানা আছে। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস গল্পের লেখক ভারতীয় উপমহাদেশেই এই গল্পের প্লট আবিষ্কার করেছেন। হ্যাঁ আমরা সবাই কিছু কম বেশি এমনই নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়েছি। বাঁশ এখানে অন্য অর্থে বহুল ব্যাবহৃত হয়ে থাকে। তবে সেই বাঁশের ব্যাসের দৈর্ঘ যত্ন সহকারে পরিমাপ করা হয়ে থাকে। প্রত্যেকেই নিজের কতটা ব্যাসের বাঁশ গেল সেটা পরিমাপের আগে অন্যের কতটা বাঁশ গেল সেটা মেপে দেখতে বেশি আগ্রহী।

সিএএ বিরোধী আন্দোলনে অমুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অবস্থান এই বিশেষ মনোভাবেরই ফলাফলস্বরূপ। অর্থাৎ, সংশোধনী নাগরিকত্ব আইনের আওতায় নাগরিকত্ব দাবি করতে হলে কি কি হারাতে হবে, কতটা ব্যাসের বাঁশ যাবে সেই হিসেব কিন্তু নেই, আছে শুধু মোল্লা জব্দ করার বিকৃত বিজয়োল্লাস। তাই প্রাথমিক বাঁশটা যখন মোল্লাদের যাবে তখন শতকষ্টও অতি তুচ্ছ জ্ঞান করতে কার্পণ্য করছেন না। এখানে উল্লেখ্য যে, যেহেতু সংবিধান মোল্লাদের জব্দ করার ব্যাবস্থা করে রাখেনি সেহেতু সংবিধানের আদর্শকে ধুলিস্যাৎ করতেও পিছপা হবেন না। আপনারা যারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সহ জন্মসূত্রে নাগরিক, আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চায়ের কাপে চুুক চুক করতে করতে বুলি আউড়াচ্ছেন ‛দেশটা রসাতলে গেল, বিরাশি দিন ধরে রাস্তা বন্ধ, দে না জল আর খাবার সাপ্লাই বন্ধ করে, হারামজাদারা জব্দ হয়ে যাবে।’ মশাই আপনাদের দেশপ্রেমের জন্য বীর সাভারকর মেডেল নিশ্চিত পাবেন, সেলিব্রেশন এখন থেকেই শুরু করে দিন, মেনুতে গোমূত্র ও গোবরের হালুয়া রাখতে ভুলবেন না।

দেশপ্রেমিক হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশের মৌনতা দেখে কেন জানি মনে হয় সিএএ ও এনআরসি বিষয় সম্বন্ধে অজ্ঞাত। নাকি অজ্ঞতার ভান করে গোপনে গোপনে মুসলিমদের ভিটামাটি উচ্ছেদের অপেক্ষায় দিন গোনা শুরু করেছে। মল্লিক বাড়ির বাগান কারো বেশ পছন্দ, ওরা উচ্ছেদ হলে ভোগ দখলের স্বপ্নে বিভোর। কারো আবার শফিক মিঞার সাত বিঘা কাঁচের মত স্বচ্ছ জলের পুকুরের প্রতি বড়ো লোভ, চৌধুরী সাহেবের বিশাল দালানকোঠার আশায় আশায় দিন কাটছে কারুর। কমরেড, জানি এসব শুনে তীব্র ঘৃণায় ফেটে পড়বেন। এখনি আমাকে মৌলবাদী, গোঁড়া, সাম্প্রদায়িক, কাঠমোল্লা ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করবেন। কিন্তু বন্ধু, যান না একটু কষ্ট করে, সাধারণের বুকে কান পেতে শুনুন, সত্য মিথ্যা যাচাই হয়ে যাবে। গালি দেওয়ার কাজটা এখন বাকি থাক, ফিরে এসে যত ইচ্ছে গালি পাড়ুন , কিজানি উদ্দীষ্ট ব্যাক্তি হয়ত বা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। নইলে, দেশের কোণায় কোণায় যত শাহীনবাগ আছে, সেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ সেভাবে দেখা যাচ্ছে কই? অংশগ্রহণের সংখ্যার শতকরা হিসেবটা জানিয়ে দেবেন কেউ। খাস কলকাতার হিসেবটা তো আরও করুণ। সোনার বাংলায় তো এমনও প্রশ্ন উঠে আসছে যে মুসলিমরা কোণঠাসা হয়ে সম্প্রীতির বুলি আওড়াচ্ছে। আপনিও তাই ভাবেন নাকি? নিশ্চয় ভাবেন না। তাহলে নিন্দা করুন, জোরালো কণ্ঠে আপনিও বলুন না হিজাব আর শাড়ি, ধুতি আর পাজামা, পৈতা আর ফেজ টুপি একসাথেই পথ চলতে চায় স্বতস্ফূর্তভাবে। বলুন, এখানে কোন সংকীর্ণ স্বার্থ নেই। বলুন, দেশ বাঁচানোর লড়াইয়ে পাশাপাশি আছি। নইলে বুঝব আপনারও মনের একান্ত গোপন সিন্দুকে নিকট মুসলিম বন্ধুটিকে দেশ ছাড়া করে পছন্দের জিনিসটি হাতানোর বিকৃত স্বপ্ন লুকিয়ে রেখেছেন অথবা মেরুদন্ড হারিয়ে নিতান্তই জৈবিক চাহিদা পূরণেই নিজ জীবন ধন্য বিবেচনা করে শুঁয়োপোকা সুলভ মহত্ব রচনা করে চলেছেন।

তবে আশার কথা এখনো এই দুর্যোগপূর্ণ ঘোর অমানিশার মাঝেও কিছু উজ্জ্বল প্রদীপ তার সহজাত আলো বিকিরণ করে চলেছে। দিল্লি গণহত্যা চলাকালীন উভয় সম্প্রদায়ের কিছু মানবীয় মুখ আশা করছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাতে সাহায্য করবে। সম্প্রীতি রক্ষায় শিখ সম্প্রদায়ের ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হবে। মহেন্দ্র সিং, ইন্দ্রজিৎ সিং, প্রেমকান্ত ভাগল ইত্যাদি নামগুলো একশো ত্রিশ কোটি নাহলেও নব্বই কোটি মানুষের মনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। তবে এই সংখ্যাগুলো এখনো সহস্রাংশ শতাংশের কাছাকাছিও আসেনি। বাতাসে মিশে থাকা এই বিষ বাষ্প নিঃশেষ করে প্রেমের সৌরভে সুরভিত করতে চাইলে সংখ্যার অঙ্কটা আরো বিশাল হওয়া জরুরি।

মুসলিম বন্ধুটির এখন আপনাকে সবচাইতে বেশি প্রয়োজন। বন্ধুত্বের শপথ রক্ষা করতে হলে এটাই সঠিক সময়। পাশে দাঁড়াতে হলে, কাঁধে কাঁধ ঠেকাতে হলে, আপনাকে অনেক পথ চলার শপথ নিয়ে এখনই বেরোতে হবে। নাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। তখন শুধু বন্ধুর ফেলে যাওয়া খেলনা গুলো থেকে যাবে, যা অবলম্বন করে আপনি সমৃদ্ধ হতে পারবেন বটে, কিন্তু বন্ধুত্বের শপথ রক্ষা করা আর হয়ে উঠবেনা।

Leave a Reply

error: Content is protected !!