ভারত নামক গণতান্ত্রিক দেশটি যে কতটা তার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারের ব্যাপারে সরব তা বলার অন্ত রাখেনা। কিন্তু উত্তরোত্তর বেড়ে চলা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা দেখে মনে হয়, ‛ধর্মনিরপেক্ষ’, ‛সেক্যুলার’ এই সমস্ত শব্দগুচ্ছ যেন সংবিধান নামক হারিয়ে যাওয়া পুরানো পুঁথির লুপ্ত প্রায় কিছু শব্দগুচ্ছ, এই ভূখণ্ডে যারা সম্পূর্ণ রুপে অচল। এই দেশের সংবিধান সংখ্যালঘুদের তাদের ধর্মীয় নীতি পালন করার সম্পূর্ন অধিকার দিলেও, ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের খাওয়া, বাঁচা, পরা নিয়ে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বিগত কয়েক বছরে চোখের সামনে এই ঘটনার রেশ ধরে নিহত-আহতর ঘটনার ও সাক্ষী হয়েছি আমরা।
‛হিজাব’ শব্দটি বেশ কয়েক দিন যাবত তপ্ত করে চলেছে আবহাওয়া। ‛বুল্লি বাই’ এর পর আরও একবার ভারতের মুসলিম ছাত্রী তথা মহিলাদের স্বীকার হতে হচ্ছে, যা বেশ ঘৃণ্যকর। বিজেপি শাসিত কর্ণাটকের উডুপিতে গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এক গভর্নমেন্ট স্পন্সার কলেজে মুসলিম ধর্মালম্বী ছাত্রীদের হিজাব পরিধান করে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ নিয়ে সৃষ্টি হওয়া সমস্যার আরো একাধিক কলেজে পুনরাবৃত্তি ঘটছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বা কর্মক্ষেত্রে মুসলিম নারীদের হিজাব পরিধান করার নিষেধাজ্ঞ বা পুরুষদের দাড়ি রাখার নিষেধাজ্ঞার ঘটনা আজ নতুন না। সংবিধানের ১৪নং এবং ২৫নং ধারা হিজাব পরার অধিকার দিলেও মুসলিম শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধান করার জন্য বারবার নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ২০১৯ সালে পুদুচেরী ইউনিভার্সিটির মাস কমিউনিকেশনের গোল্ড মেডেলিস্ট রেবেয়া আব্দুর রহিমকে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের উপস্থিতি সত্ত্বেও কনভেনশন কক্ষে কেবল হিজাব পরিধান করার কারণে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। গতবছর ২৬শে সেপ্টেম্বর খোদ বাংলাতেই পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কনস্টেবল পরীক্ষায় ৫ জন মুসলিম পরিক্ষার্থী হিজাব পরিহিতা ছবি আপলোড করার কারণে তাদের ফর্ম বাতিল করা হয়। ১৯৯০ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত মুলিম ও শিখ সম্প্রদায়কে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাড়ি রাখার অনুমতি দিলেও ভারতীয় বিমান বাহিনীতে মোহাম্মদ জুবায়ের ও আনসারি আফতাব আহমেদের দাড়ি রাখা নিয়ে বেশ টানাপোড়েন চলে। এছাড়াও আরো কত এমন অপ্রকাশিত দ্বিচারিতার ঘটনা আছে তার কোন সীমা নেই। কিন্তু সংবিধানের ঠিক একই ধারা মেনে কোন বিবাহিত হিন্দু ধর্মের মেয়ে স্কুল কলেজে শাঁখা-সিঁদুর-টিপ পরে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রবেশ করলে বাধা প্রদান করা হয় না যেমনভাবে হিজাব পরিহিতা একজনকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়, অথবা কোন শিখ সম্প্রদায়ের পুরুষের দাড়ি, পাগড়ি অথবা ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের ছাত্ররা কপালে তিলক কেটে সব জায়গাতেই বৈধতা পেলেও মুসিলম সম্প্রদায়ের ব্যাক্তিদের দাড়ি রাখার অনুমতি পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের জন্য ভিন্ন নীতি আর মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য কেন থাকবে এমনসব ভিত্তিহীন নীতি? এই দেশের সমস্ত নিয়ম-নীতি কী কেবল মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য নির্ধারিত?
বিজেপি নেতা সিটি রাভি বা সুপ্রিমকোর্টের বিচারক আশ্বীনী কুমার দুবের মত একাধিক ব্যাক্তি এ বিষয়ে যে মত প্রকাশ করেছেন তা শুনে বেশ অবাক হতেই হয়। তাঁদের মতে হিজাব ধারণকারী ঐ সমস্ত ছাত্রীরা তাদের দাবীতে অটল থাকায় উত্তপ্ত করেছে তাদের পিছনে থাকা ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে। আবার কেও মত প্রকাশ করছেন আজ মুসলিম ছাত্রীরা হিজাব পরার অনুমতি চাচ্ছে আগামীতে তারা শরিয়াহ আইন প্রতিষ্ঠিত করার দাবি জানাবে। বাস্তবে ঘটনা যে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজেপি নেতাদের ক্রমাগত হিজাবের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্যে, বজরং দলের একপ্রকার জোরাজুরিতে কর্ণাটকে শিক্ষাক্ষেত্রে হিজাব নিষিদ্ধ করার দাবিতে এক বিশাল সংখ্যার পড়ুয়া গেরুয়া উর্দি পরে পথে নামে। হিজাবের দাবিতে অটল এক ছাত্রী উল্লেখ করেন পূর্বে কলেজে তাঁর পরিচিতরাই হিজাব পরিধান করে পঠনপাঠন করেছেন তবে আজ তাদের কেন বাধা দেওয়া হচ্ছে? আর তারা কলেজ এবং সংবিধানের আইন মেনেই তাই দাবি করছে তাহলে কেন আজ তাদের প্রবেশাধিকার মিলছে না? আর এক ছাত্রী অধ্যাক্ষকে অনুরোধ করেন তাদের প্রবেশের অনুমতি দিতে, কারণ পরীক্ষা মাত্র দু’মাস বাকি।
‛হিজাব’ নামে এই ইস্যুটার দিনের আলোয় একটা বিহীত হওয়ার অধিক প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। সংবিধান অধিকার দেওয়া সত্ত্বেও বারবার কেন মুসলিম শিক্ষার্থীদের হেনস্থা হতে হবে? হিজাব পরিধান করা একজন মুসলিম মহিলার সাংবিধানিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিদ্যালয়ে নিছক অনুমতি না থাকার কারণে মুসলিম ছাত্রীদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে হয় যা এই ভারতের মাটিতে বাঞ্ছনীয় না। একজন মহিলার হিজাব পরিধান তার পারিপার্শ্বিক কোন ব্যক্তিকে সমস্যায়ও ফেলেনা তাহলে কেন এই নিষেধাজ্ঞা?
কর্ণাটক পার্লামেন্টর সদস্য বিজেপি নেতা নলীন কুমার কাটিলর বলেন যে যেহতু আলোচ্য রাজ্যে ক্ষমতাতে বিজেপি তাই বিজেপির কথা সর্বোচ্চ মানদণ্ড। তাঁর এই বক্তব্য শুনে আগমীর ভারতের যে রুপ চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা বেশ ভীতিকর। হিজাব পরে যদি একজন মহিলার শিক্ষা গ্রহণের অনুমতি না মেলে তাহলে একজন হিন্দু মহিলারও শাঁখা, সিন্দুর পরে শিক্ষা গ্রহনের অধিকার থাকা উচিত না। একজন মুসলিম যুবকের যদি সরকারী ক্ষেত্রে দাড়ি রাখার অনুমতি না থাকে তাহলে একজন শিখ ব্যাক্তির দাড়ি রাখার অনুমতি না মেলা উচিত। বিভিন্ন রঙের মেলবন্ধনে সৃষ্ট রঙের নামই ভারত তাই এখানে কেবল একটি রঙের আধিপত্য থাকা বাঞ্ছনীয় না। বিজেপির কিছু নেতা মন্ত্রী হিজাব পরিধান করা ছাত্রীদের তালিবানদের সাথে তুলনা করে বলেন যে তারা যদি হিজাবের দাবি তে অটল থাকে তাহলে তাদের পাকিস্তানে চলে যাওয়া দরকার। একজন মুসলিম মেয়েকে এই ভারতের সংবিধানই হিজাব পরার অধিকার দিয়েছে তাই হিজাব পরে সে পাকিস্তান যাবে, না কাজাকিস্তানে যাবে সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা। হিজাবকে এবার বাঁকা চোখে দেখা বন্ধ হোক। সংবিধান হিজাবকে যে অধিকার দিয়েছে সেই অধিকার নিয়ে নির্দ্বিধায় সমস্ত ক্ষেত্রে সামিল হওয়ার অধিকার মিলুক এ ভারতে।
আফরিদা খাতুন আঁখি
পাঁচলা, হাওড়া