Monday, September 16, 2024
সম্পাদক সমীপেষু

‛আরও বেশি দায়িত্ব পালন করুন’ – ইমামদের প্রতি একটি অনুরোধ

ইমরান হোসেন

এ দেশীয় সমাজ ব্যবস্থায় ধর্ম এবং ধর্মীয় ইমামদের এক ব্যাপক গুরুত্ব ও অবদান অতীতেও ছিল, আজও আছে। ধর্মের প্রচার, প্রসার ছাড়াও বিভিন্ন সমাজ সংস্কারের কাজে ধর্মীয় নেতাগণ প্রথমসারিতে অবস্থান করে। সুতরাং ধর্ম ছাড়া ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার কল্পনা শুধু ভুলই নয় বরং ভিত্তিহীন। একথা বলা যায় যে, সূচনাকাল থেকেই এ দেশীয় সমাজ ও সভ্যতা গড়ে উঠতে ধর্ম এবং ধর্মীয় ইমামগণ এক অনন্য ভূমিকা রেখেছে।

একজন মসজিদের ইমাম সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষ তাঁদের কথা শুনতে জমায়েত হয়, তাঁদের উপদেশ পালন করে। বিশেষত মসজিদে ইমামদের সাপ্তাহিক খুৎবার সময় সমস্ত মুসলিম একত্রিত হয়ে ইমামদের অমৃত বাণী শোনে। সেই দিক থেকে একজন ইমামের প্রভাব ও কার্যকরীতা মুসলিম সমাজে যথেষ্ট বেশি। ইমামদের এই নমুনা আমরা বিভিন্ন সময় দেখে থাকি এবং তাঁদের নির্দেশ পালনের ইতিহাসও খুব উজ্জ্বল। দাঙ্গার কবলে পড়ে নিজের প্রানপ্রিয় পুত্র হারানোর পরও আসানসোলের ইমাম রাশিদীর মুখ থেকে উচ্চারিত হয় শান্তির আহবান। ইমাম সেদিন হাজার হাজার লোকের সামনে দীপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছিল, “আমি শান্তি চাই। আমার ছেলে জীবন হারিয়েছে। আমি চাইনা আর কোন পরিবার তাদের প্রিয়জনকে হারাক। আমি আর কোন বাড়িকে জ্বলতে দেখতে চাইনা।” সারা দুনিয়ার মানুষ সেদিন আসানসোলের ইমামের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাঁর মুখ দিয়ে উচ্চারিত শান্তির বাণী যেন সমাজে নতুন বসন্তের ছোঁয়া নিয়ে আসে।

মুসলিম সমাজ যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন রমজানে রোজা করা, ঈদুল ফিতর পালন করা এবং অন্যান্য ইসলামী হুকুম পালন করতেও তাকিয়ে থাকে ইমাম সাহেবদের ঘোষনার দিকে। পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় ‛ফিতরা’ (ঈদুল ফিতর নামাজের পূর্বে প্রদান করা এক বিশেষ দান) পরিমান নির্ধারন করতে ইমামদের দ্বারস্থ হয় সকলেই।

আজ সারা বিশ্ব এক মহা বিপদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। প্রতি মুহূর্তে কোন না কোন মানুষের মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এ দেশের ভীত নাড়িয়ে দিচ্ছে জীবনের দুশমন করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাসের ভয়ে ছোট্ট শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলকে ঘরে বন্দিদশা কাটানোর নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে কোরোনার আঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মানুষের জীবনে এক ভয়ঙ্কর কালো অধ্যায় নিয়ে এসেছে এই করোনা ভাইরাস। দেশের সম্পূর্ন লকডাউন বৃদ্ধি করার পরামর্শ ও আলোচনা চলছে। কারণ ঘরবন্দি থাকাটাই এই যুদ্ধের ময়দানে জয়ী হওয়ার সেরা হাতিয়ার। সমস্ত রকম প্রাত্যহিক কাজকর্ম বন্ধ। মসজিদে জমায়েত বন্ধ করা হয়েছে। একজন মুসলিমের প্রধান পরিচয় ‛নামাজ’ মসজিদে আদায়ের উপরও পাবন্দী লাগানো হয়েছে। দেশের বড় বড় মুসলিম সংগঠন দারুল উলুম দেওবন্দ, মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড, জামাআতে ইসলামী হিন্দ সহ অন্যান্য সমস্ত সংগঠন একমত পোষন করেছে যে, এই সময় নিজের বাড়িতেই নামাজ আদায় করতে হবে। এমনকি শুক্রবারের জুম্মার জমায়েতও বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  এ ক্ষেত্রে মানবতার মুক্তিদূত প্রিয় মোহাম্মদ (সঃ)-এর একটি হাদিস উল্লেখ্য। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর(রাযি:) বর্ণনা করেন, “প্রত্যেক ঠান্ডা ও বৃষ্টির রাতে আল্লাহর রাসূল(সঃ) মুয়াজ্জিনকে (আজান দাতা) এই বলে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিতেন যে, ‛নিজ বাড়িতেই নামাজ আদায় করে নিন’।” অর্থাৎ বিপদকালীন অবস্থায় বাড়িতে নামাজ আদায়ের উপর প্রিয় নবী (সঃ)-এর সময়ও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, এই মহা বিপদের কালে মসজিদের ইমাম সাহেবদের ভূমিকা ও কার্যকরীতা দৃষ্টান্তমূলক হওয়া দরকার যেমনটি ছিল সে যুগে প্রিয় নবী মোহাম্মদ (সঃ)-এর সময়ে। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্য যে মুর্শিদাবাদের এক মসজিদে জুম্মার সমবেত নামাজ আদায়ের ভিডিও প্রকাশ্যে আসার পর থেকেই আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যমে প্রশ্ন উঠেছে কেন সেই দিন মসজিদে লকডাউনের নিয়ম পালনে শিথিলতা দেখানো হল। হাওড়ার টিকিয়াপাড়ায় প্রশাসন ও নিরাপত্তারক্ষীদের উপর হামলা এই সমাজকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

এই বিপদের মুখে প্রিয় নবী (সঃ)-এর যে পদক্ষেপ ছিল তা যথাযোগ্য সমাজের বুকে রূপায়ন করার দায়িত্ব মসজিদের ইমামদের কাঁধেই সবথেকে বেশি। মহামারীর সময় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়ে মুহাম্মদ (সঃ) বলেন, “যাদের সংক্রামক ব্যাধি রয়েছে তাদের উচিত সুস্থ মানুষদের থেকে দূরে থাকা।” সুতরাং কোথাও ধর্মীয় কারণ বা অন্য কোন জমায়েত হওয়ার নিষেধাজ্ঞা প্রদান করার জন্য ইমাম সাহেবদের এগিয়ে আসা দরকার। এই রকম নাজুক পরিস্থিতিতে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় ভ্রমণের উপরও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন খোদ প্রিয় নবী (সঃ)। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যে, “যদি তুমি কোন স্থানে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার খবর পাও তবে সেখানে প্রবেশ করবে না, কিন্তু যদি তুমি সেই স্থানেই অবস্থান করতে থাকো তবে সেখান থেকে বেরিয়ে যাবে না।” আজ এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে সবথেকে বেশি জরুরী এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত বন্ধ রাখা। এই ভাইরাস যদি একবার গোষ্ঠী সংক্রমণ শুরু করে তবে তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। তাই ভ্রমণ করা বা অন্যের সংস্পর্শে যাওয়া কোন ভাবেই কাম্য নয়।

পবিত্র মাহে রমজান মাস বিশ্বের দরবারে উপস্থিত। এই পবিত্র মাসে প্রতি বছর মুসলিম সমাজ মসজিদে সমবেত হয়ে প্রার্থনায় রত হয়। কিন্তু এই বছর ব্যাতিক্রম হতে চলেছে। এক বিশাল চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে এই বছরের রমজান অতিবাহিত হবে। তাই সচেতনতা এবং লকডাউন পালন অত্যাবশ্যকীয়। এই ক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম সাহেবগণের আরও বেশি দায়িত্ববান হতে হবে।

মানুষকে করোনার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে আরও বেশি দায়িত্বের বোঝা কাঁধে তুলে নিতে হবে। মসজিদের আজানের মাইক ব্যবহার করে কিংবা লকডাউনের সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে জনগণকে সচেতন করা আশু প্রয়োজন। সেই সাথে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়ানোর যে চরম পরাকাষ্ঠা প্রতি রমজানেই দেখতে পাওয়া যায় তা আরও বেশি করে করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব ইমাম সাহেবদের। আজ এই দুনিয়ায় ইমাম রাশিদির মত নেতা খুব প্রয়োজন যাঁরা মানবতা রক্ষার্থে এবং করোনা নামক অক্টপাসের কবল থেকে সমাজকে বাঁচানোর জন্য দায়িত্বের বোঝা কাঁধে তুলে নেবে। করুণা, ক্ষমা ও মুক্তির মাস মাহে রমজানে ইমাম সাহেবগণ ও মুসলিম সমাজ দায়িত্ববানের পরিচয় দিলে আশা করা যায় অবশ্যই কোরোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা ক্রমে জয়ের পথে এগোবে।

লেখক : কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র (+91 9153251781)

Leave a Reply

error: Content is protected !!