দৈনিক সমাচার, নয়াদিল্লি: জন্মের সময় তাঁর নাম রাখা হয়েছিল দিলীপ কুমার। কিন্তু বড় হওয়ার পরে নিজের নামটা পছন্দ হয়নি তার। এ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘‘কিংবদন্তী অভিনেতা দিলীপ কুমারের প্রতি কোনও ভাবেই কোনও অসম্মান নেই আমার। শুধুমাত্র আমার মনে হয়েছিল যে আমার সঙ্গে এই নামটা খাপ খাচ্ছে না।” পরে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তিনি। বদলে ছিলেন নামও। নাম নিয়েছিলেন, আল্লাহ্ রাখা রহমান। তিনিই সুরের জাদুকর, এ আর রহমান।
প্রসঙ্গত, বলিউড অভিনেতা দিলীপ কুমারের নামটিও কিন্তু ছদ্মনাম। তাঁর আসল নাম মুহাম্মদ ইউসুফ খান। রহমান ধর্মান্তরণ করে মুসলিম হয়েছিলেন, কিন্তু অভিনেতা দিলীপ কুমারের মনে হয়েছিল, মুসলিম হওয়ার কারণে বলিউডে তাঁর কেরিয়ার ফ্লপ করতে পারে। তাই ইউসুফ খান ধর্ম না পাল্টালেও, শুধু ফিল্মজীবনে ছদ্মনাম দিলীপ কুমার রাখেন। অন্যদিকে যাঁর জন্মের পরই নাম রাখা হল দিলীপ কুমার, তিনি হয়ে গেলেন এ আর রহমান! এই নতুন নামে ভর করেই বলিউডের মিউজিকে দক্ষিণের মুক্ত বাতাস বয়ে এনেছিলেন তিনি। তাঁকে বলা হয় ‘দক্ষিণের মোৎজার্ট’। তাঁর তামিল ভক্তরা তাঁকে ‘মিউজিকের ঝড়’ বলেও ভূষিত করেছেন।
১৯৬৬ সালের ৬ জানুয়ারি মাদ্রাজের এক শৈব হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় এ এস দিলীপ কুমার। দিলীপ কুমার ওরফে এ আর রহমানের বাবা আর কে শেখর মুধালিয়ার ছিলেন মালায়ালম ও তামিল ছবির সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর মায়ের নাম ছিল কস্তুরী দেবী। শিশু শিল্পী হিসেবে একসময় দূরদর্শনের ‘ওয়ান্ডার বেলুন’ শোতে দেখা গিয়েছিল রহমানকে। তিনি ওই অতটুকু বয়সে একসঙ্গে চারটি কী-বোর্ড বাজিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সকলকে।
বাবার কাছেই রহমানের সঙ্গীতশিক্ষার হাতেখড়ি হয়। বাবার সহকারী হিসেবেই কাজের শুরু। তবে মজার কথা হল, সঙ্গীতকার নয়, রহমান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্যাশন মিউজিক হয়ে গেল তাঁর প্রফেশন। ভাগ্যিস হল! তবে রহমানের নাম পরিবর্তন ও ধর্ম পরিবর্তনের কারণটা কী? অনেক হিন্দু শিল্পীই ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হয়েছেন ভিন্ন ধর্মে বিয়ের কারণে। কিন্তু এ আর রহমানের ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণটা একেবারে অন্যরকম। নামটা তাঁর নিজের পছন্দ হতো না নিছকই। কেরিয়ারের ক্ষেত্রেও তাঁর মনে হত, তাঁর নামটা যেন কোনও শ্রীবৃদ্ধি আনছে না। সেই সময়েই তাঁর বাবা আচমকা মারা যান। বাবার অকালমৃত্যুতে স্তব্ধ হয়ে যায় পরিবার। থমকে যায় জীবন। মা কস্তুরী বেগম তাঁর সন্তানদের খাওয়া-পড়ার জোগান দিতে হিমশিম খেতে থাকেন।
১৯৮৮ সালে যখন রহমানের বয়স ২২, সে সময়ে তাঁর বোন কঠিন অসুখে আক্রান্ত হন। তখন আবদুল কাদের জিলানী নামের এক মুসলিম পীরের দোয়ায় নাকি তার বোন ঐশ্বরিকভাবে সুস্থ হয়ে যান। এর পরেই রহমানের গোটা পরিবারের ইসলাম ধর্মের উপর বিশ্বাস গড়ে ওঠে। ইতিমধ্যে সেই পীর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কস্তুরী দেবী তাঁর সমস্ত শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলেন। এই সময়েই বাবা-মেয়ের মতো সম্পর্ক তৈরি হয় তাঁদের দু’জনের মধ্যে। এর পরে তাঁরই কিছু কথা, পরামর্শ ধীরে ধীরে কস্তুরী ও তাঁর সন্তানদের ব্যক্তিত্বে পরিবর্তন আনে। সুফির প্রভাব পড়ে তাঁদের উপর। কিন্তু কোনও দিন পীর বাবা তাঁদের ধর্মান্তরকরণের কথা বলেননি। রহমানের দক্ষিণী হিন্দু পরিবারের সদস্যদের নিজের থেকেই মনে হয়, ধর্মের ভেদাভেদ সমাজের নিচতার পরিচয়। আদতে মানুষে মানুষে কোনও ভেদ নেই। সবাই ভগবানের সন্তান।
সুফি সংস্কৃতি ক্রমশ তাঁদের ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে। কস্তুরী দেবী সিদ্ধান্ত নেন, তাঁরা মুসলিম হবেন। ছেলেও দিলীপ কুমার থেকে ততদিনে নাম বদলাবেন বলে স্থির করে ফেলেছেন। কস্তুরী বেগম ধর্মান্তরণ করে হয়ে যান করিমা বেগম। ছেলে-মেয়ের কোষ্ঠীবিচার করাতে করিমা বেগম এক জ্যোতিষীর কাছে যান। তখনই তাঁর কাছে নাম পরিবর্তনের কথা বলেন দিলীপ ওরফে রহমান। জ্যোতিষ তাঁকে দু’টি নামের কথা বলেন— আব্দুল রহমান ও আব্দুল রহিম। এক জন হিন্দু জ্যোতিষ হয়েও তিনি মুসলিম নামের পরামর্শ দেন তাঁকে। শেষে তাঁর মা ‘আল্লাহ্ রাখা’ নামটি রাখেন। সঙ্গে রহমান। আল্লাহ্ রাখা শব্দের অর্থ, ঈশ্বর যাকে রক্ষা করেন।
দিলীপ থেকে রহমান- এই নাম পরিবর্তনই তাঁর ভাগ্যে বাঁকবদল ঘটায়। মণি রত্নমের একটি বিজ্ঞাপনী জিঙ্গলে গেয়ে রহমান জনপ্রিয়তা পান প্রথম। তারপর মণি রত্নমের ‘রোজা’ ছবির অফার আসে। ‘রোজা’র কালজয়ী গান ও মিউজিক রচনা করে এ আর রহমান আসমুদ্রহিমাচল কাঁপিয়ে দেন। এর পর আর তাঁকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘দিল সে’, ‘বম্বে’, ‘তাল’, ‘জুবেইদা’, ‘স্লামডগ মিলিওনার’– একের পর এক ছবিতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী গান তৈরি করেন তিনি। তাঁর সংগীত পরিচালনায় ষাটোর্ধ্ব লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের কণ্ঠে বালিকা সুলভ তারুণ্য প্রকাশ পায়। আবার হরিহরণ, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, সাধনা সরগমের মতো শিল্পীদের নতুন পরিচয় গড়ে ওঠে রহমান সুরেই।
১৯৯২ থেকে ২০২২, তিন দশক ধরে আজও সঙ্গীত দুনিয়ার এক নম্বরে সমাদৃত তাঁরই মিউজিক। সবশেষে এক মজার তথ্য দেওয়া যাক শুরুর প্রসঙ্গ ধরেই। দিলীপ কুমারের নামের সঙ্গে রহমানের যে কাকতালীয় মিল, সেই মিল রহমানের পরবর্তী জীবনেও আরও বেশি করে মিলে যায়। কারণ অভিনেতা দিলীপ কুমারের মতোই রহমানের স্ত্রীর নামও সায়রা বানু।