মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন
দেশ এখন কৃষকদের আন্দোলনে উত্তাল। দিল্লির চারদিক থেকে কৃষকদের মিছিল অবরুদ্ধ করে রাখছে দিল্লি প্রবেশের রাজপথগুলি। সরকার সবরকম চেষ্টা করেও ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি বিদ্রোহী কৃষকদের অগ্রযাত্রাকে। কয়েক মাস আগে পাস হওয়া ‛কৃষি বিল ২০২০’ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত ময়দান ছেড়ে নড়বেন না। এমনই যুদ্ধ ঘোষণা বিদ্রোহীদের কৃষকদের। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে কী আছে এই বিলে? তা কৃষকদের পক্ষে না বিপক্ষে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দাবি কৃষকদের স্বার্থেই নিয়ে আসা হয়েছে এই বিল। পক্ষান্তরে কৃষকদের দাবি সরকারের এই আইন কর্পোরেট দুনিয়ার স্বার্থে। কৃষকদেরকে দাস বানানোর এক নীল নকশা করা হয়েছে এই আইনের মাধ্যমে।
বিষয়টি যথার্থ বুঝতে হলে আমাদের আরেকটু গভীরে প্রবেশ করতে হবে। মূল আলোচনা বুঝে নেওয়ার জন্য দু একটি বাস্তব উদাহরণকে সামনে রাখা যাক। কলকাতা থেকে ট্রেনে চেপে পৌছালাম কুচবিহার স্টেশনে। সেখান থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে দিনহাটা শহর। দিনহাটা বাজারে শসা বিক্রি হচ্ছে দাম জিজ্ঞাসা করে চমকে গেলাম। কলকাতায় যেখানে আমরা ৫০টাকা দরে শশা কিনি সেখানে দিনহাটা মার্কেটে শসার খুচরা মূল্য ৫ টাকা কিলো। ভিমরি না খেয়ে ভাবলাম হয়তো এটা ব্যতিক্রম হতে পারে। কৌতূহলবশতঃ অন্যান্য সবজির দাম জিজ্ঞাসা করতে এগিয়ে গেলাম। করলা কত করে কিলো? উত্তর এলো ৮ টাকা। কলকাতার বাজারে ৪০ টাকার কম নয়। একইরকমভাবে বেগুন পটল লাউ সবকিছুর দামে এইরূপ আকাশ-পাতাল ফারাক।
কলকাতায় কাজ করতেন শিল্পী আমিনুর রহমান। হুগলির আরামবাগ বাড়ি। কিছু কৃষি জমি আছে। হুগলিতে আলুর চাষ বিখ্যাত। আমিনুল সাহেব আলু চাষ করতে সময় মত গ্রামের বাড়িতে ছোটেন। একবার কথায় কথায় বললেন এবছর আলু ভালো দামে বিক্রি হয়েছে। ২ টাকা কেজি পেয়েছি। আমরা শুনে অবাক। ২ টাকা কেজি আলু বিক্রি করা হলে তা আবার ভালো দামে! হাসতে হাসতে আমিনুল ভাই বললেন, দুই টাকা তো অনেক। কোন কোন বছর ৫০ পয়সা দিয়েও আলু কেউ কিনতে চায় না। প্রশ্ন হল দামের এত তফাৎ কেন? যারা মধ্যস্বত্বভোগী, তাদের হাতেই কি সব কলকাঠি? শীতের মাঝামাঝি বা শেষের দিকে ভাঙ্গড়, পাকাপোল, সায়ের বাজার, প্রভৃতি এলাকায় ফুলকপির স্তূপ রেখে চাষীদের পালিয়ে যাওয়ার গল্প শোনা যায়। সবজি রেখে পালিয়ে যাওয়া চাষীদের ধরতে আবার বাজার কমিটির পক্ষ থেকে দারোয়ানও রাখা হয়। কেন এ অবস্থা? যখন ক্ষেতে বেশি ফসল ফলে সেই ফসল বিক্রি করার জন্য আসে বাজারে। বাজারে খরিদ্দার না থাকলে সেই ফল বা সবজি বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচ উঠবে না। বাধ্য হয়ে চাষীদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।
অর্থাত পরিকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে কৃষকরা সরাসরি কৃষিপণ্য বিক্রি করার সুযোগ পায় না। মাঝে থাকে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীগণ। প্রশাসনের দুর্নীতি বা ঢিলেমির কারণে তারা অবৈধভাবে সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে বেশি। তারা যেমন একদিকে কৃষকদের ঠকায় তেমনি সাধারণ মানুষের কাছে অতিরিক্ত চড়া দামে কৃষি পণ্য বিক্রি করে তারা মালামাল হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সর্বত্র উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা না থাকার কারণে কাঁচা সবজি প্রচুর পরিমাণ নষ্ট হয়। এমনকি ধান, গম, আলু, সরিষার মতো ফসল টনের পর টন নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। সমস্ত ক্ষতিগুলো পড়ে গিয়ে চাষীদের ঘাড়ে। ব্যবসায়ীরা সেই ক্ষতির সম্মুখীন হয় না বললেই চলে।
বীজ ও কীটনাশকের অতিরিক্ত মূল্য হওয়ার কারণে চাষের খরচ অনেক বেড়ে যায়। বেগুন শসা টমেটো ফলাতে স্বাভাবিকভাবে যে পরিমান খরচ হওয়ার কথা তার থেকে অনেক গুন বেশী খরচ হয়। যার ফলে উৎপাদনের খরচ বাড়ে কিন্তু বিক্রি করার সময় সেই দাম চাষিরা পায় না। তাদেরকে একের পর এক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়।
কৃষকরা সাধারণত গরিব হয়। পর্যাপ্ত মূলধন না থাকার কারণে সময়মতো তারা কৃষি ক্ষেত তৈরি করতে পারেন না। একই কারনে উপযুক্ত পরিচর্যা করাও সম্ভব হয় না। ফসল ফলাতে গেলে তাদেরকে ঋণের মুখোমুখি হতে হয়। এই ঋণ কখনো শোধ সুদখোরদের কাছ থেকে গ্রহণ করতে হয়। কখনো সার ব্যবসায়ী, কীটনাশক ব্যবসায়ী বা কোল্ড স্টোরেজের মালিকরা দেয়। তারা একরকম ঋণের দায়ে কৃষকদেরকে বেঁধে ফেলে। এই বাঁধন থেকে কৃষকরা সাধারণত মুক্ত হতে পারেন না। এ ঋণের দায় সারা জীবন তাদেরকে বয়ে বেড়াতে হয়।
এ সমস্যাগুলো আজকের নয়। প্রতিটি সরকার এ বিষয়ে কিছু না কিছু করার চেষ্টা করেছে। কমিশন বসেছে। আইন তৈরি হয়েছে। একের পর এক পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। কোথাও কোথাও সেই পদক্ষেপগুলো কিছুটা কৃষকদের সমস্যার সুরাহা করলেও এখনো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। যেকোনো জন-দরদী সরকারের পক্ষে এই সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবা উচিত এবং যথাসম্ভব তার সমাধানের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
পূর্বের কেন্দ্রীয় বা রাজ্যের সরকার অনেক অনেক বেশি কৃষি-বান্ধব ছিল এ দাবি না করেও বলতে হয় কৃষকদের স্বার্থে কিছু কিছু পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছিল এবং কমবেশি কৃষকরা তার থেকে উপকার পেত। যেমন গ্রামে গ্রামে সমবায় কৃষি বাজার তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোথাও তা আধুনিক প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। যাতে কাঁচা সবজি ফসল বিক্রি না হলে তা সংরক্ষন করার ব্যবস্থা করা যায়। সহায়ক মূল্যে কৃষি পণ্য ক্রয় করার জন্য সরকার আইন তৈরি করেছিল এবং একটা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল সরকার নিজেই কৃষকদের কাছ থেকে ক্রয় করত। যার ফলে কৃষকরা অনেকটা সুবিধা পেত। অত্যাবশ্যক পণ্য গুদামজাত করার ব্যাপারে আইন ছিল। নির্দিষ্ট সীমার বেশি পণ্য মজুদ করা নিষিদ্ধ ছিল। যার ফলে বাজার যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব ছিল। কিন্তু এখানেও সমস্যা ছিল অনেক। মূলত সরকারি আধিকারিকদের দুর্নীতি, স্থানীয় নেতা, মোড়ল মাতব্বরদের মাতব্বরি। সব সময় কৃষকদের উপর ছড়ি ঘোরাত। যার ফলে প্রকৃত গরিব কৃষকরা তেমনভাবে উপকৃত হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে এটাও লক্ষ্য করা গেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে যখন সরকার সাহায্য দেয় তখন প্রকৃত কৃষকরা সেই ক্ষতির টাকা হাতে পায় না ।কারণ তারা জমির মালিক নয়। অন্য কারো কাছ থেকে জমি লিজ নিয়ে যারা চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারাই। কিন্তু জমির দলিল দেখিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে যারা তারা আদৌ চাষি নয়। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের আম্ফান ঝড়ের ক্ষতিপূরণের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি কিভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে।
সরকারের উচিত ছিল এই অবস্থাগুলো দূর করা। এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যাতে করে দুর্নীতিবাজরা সুযোগ না পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে হয়েছে তার উল্টো। কৃষকদের সমস্যা দূর করা তো দূরের কথা বরং কৃষকদেরকেই বিক্রি করে দেয়ার ষড়যন্ত্র হয়েছে নয়া কৃষি আইনে। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল কৃষকদের সমস্যার আরো গভীরে প্রবেশ করা এবং সেই সমস্যাগুলো দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা। কিন্তু কৃষিবিল ২০২০তে যে আইনগুলি নিয়ে আসা হয়েছে তা কৃষকদের সমস্যা দূর করা তো দূরের কথা বরং তাদের স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতা সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেয়া হচ্ছে এবং নীলকরদের মত ভারতের এক শ্রেণীর পুঁজিপতিদের হাতে তাদেরকে বন্দী করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
এই বিলে চাল, ডাল, আটা, আলু, চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।এবং মজুদ করার উর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পরপরই কৃষকদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আইন তৈরি করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে এই আইনের ফলে সরকার সরাসরি কৃষকদের থেকে খাদ্যশস্য কিনে গণবণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতরণ করতো। নতুন আইনে সরকার কৃষকদের থেকে পণ্য কিনতে বাধ্য থাকবে না। আর কর্পোরেট ব্যবসায়ীরা যতখুশি পণ্য গুদামজাত করতে পারবে। তাদের কোনো বাধা থাকবেনা।
বিলের দ্বিতীয় অংশে কৃষকদের সাথে সরাসরি পেপসিকো, আদানি, রিলায়েন্সের মত বড় বড় কোম্পানিরা চুক্তি করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সরকারের উদ্যোগে যে আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে তা ব্রিটিশ আমলের নীলকরদের থেকেও ভয়ঙ্কর। বড় বড় কোম্পানি গুলোর সাথে কৃষকদের চুক্তি হওয়ার পর কোন কারনে উৎপন্ন ফসল পছন্দ না হলে তা কিনতে কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে ফসল নষ্ট হলে সেই আর্থিক দায়-ভার নিতে কোম্পানিগুলো বাধ্য নয়। সরকার বলছে সে ক্ষেত্রে ক্ষতির মূল্য পেতে চাষিরা আইনের সাহায্য নিতে পারে কিন্তু কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা গরীব কৃষকদের কোথা থেকে আসবে?
দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে কৃষকরা সরাসরি কেনাবেচা করতে পারবে মুক্তভাবে। সে ক্ষেত্রে সরকার আর কোনরকম হস্তক্ষেপ করবে না। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিস মেনে খরচের দেড়গুন দাম কৃষকদের জন্য সুনিশ্চিত করতে হবে সেই দায়-ভার থেকে সরকার হাত তুলে নিল। এমনকি এই বিলে বিদ্যুতের সরবরাহ সম্পূর্ণ বেসরকারিকরণ, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের কৃষককে ভর্তুকি বন্ধ করার ব্যবস্থা উল্লেখ আছে। আমাদের দেশে কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত ১৪.৬৫ কোটি পরিবারের মধ্যে ৫৪.৬৫ শতাংশ পরিবার ভূমিহীন। যে দেশের সরকার নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে ২০১৬ সালের পর থেকে কৃষক আত্মহত্যা রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ করে দেয়। যে দেশে সেই সরকার কতটা কৃষক বিরোধী তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে দেশে প্রতি ১২/১৩মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করে সে দেশের এই দমনমূলক কৃষি আইন কৃষকদের স্বার্থ কতটা রক্ষা করবে তা বোঝাই যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই ভারতের কৃষক জাগ্রত হয়েছে। দুর্বার কৃষি আন্দোলন হয়তো সরকারের ভুল ভাঙাতে পারে। আর তা না হলে অবিলম্বে এ দেশের জনতা কর্পোরেট হাউসের হাতে বন্দি হয়ে পড়বে।