Sunday, February 23, 2025
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদকীয়

গৃহে তুমি রাবিয়াতুল বাইত আর বিশ্ব রণাঙ্গনে তুমি হয়ে ওঠো লাদিদা

আফরিদা খাতুন আঁখি

 

কত মাতা দিল হৃদয় উপড়ি, কত বোন দিল সেবা
বীর স্মৃতি স্তম্ভের গায়ে লিখিয়া রেখেছে কেবা?
কোন কালে একা হয়নি ক জয়ী পুরুষের তরবারী
প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী।

– নারী, কাজী নজরুল ইসলাম

‛নারী’ কথাটি আদতে দেখতে ক্ষুদ্র হলেও অথবা এই ক্ষুদ্র কথাটি কে তুচ্ছ জ্ঞান করলেও ‛নারী’ নামক প্রাণগুলি এই জীবকূলে স্পন্দিত না হলে কেবল মানবকূল কেন জীবকূলও একটা অণু পরিমাণেও বর্ধিত হতে পারতনা। তবে নারীকে কেবল বংশবৃদ্ধির যন্ত্র বললে বড়ো ভুল যেমন হবে ঠিক তেমনি নারী যে বংশ বিস্তারের ক্ষমতাতে ক্ষমতাসীন এটা একেবারে তুচ্ছ জ্ঞান করলেও নারীত্বের অপমান হবে বৈকি! ‛নারী’ মাতৃত্বের গুণে গুণান্বিত একাধিক ক্ষমতার অধিকারী এক সত্ত্বা। নারী পুরুষের থেকে যেমন ছোটো না তেমন বড়ো ও না আবার সমতুল্য যদি বলি এটাও সম্পূর্ন রুপে সঠিক না কারণ নারী আর পুরুষ দুয়ে মিলেই এই বিশ্বের সমস্ত, তবে দুজন ভিন্ন গুণে গুণান্বিত।

ধর্মের পাবন্দির বুলি আওড়ে এই সমাজের এক শ্রেণীর পুরুষরা যুগ যুগ ধরে ‛নারী’র সংজ্ঞা হিসেবে গৃহ কর্মে নিপুণা, সন্তানের জননী এই ধারণা গাঢ়ভাবে প্রথিত করেছে, এমনকী অধিকাংশ নারীও, ‛নারী’র এই সংজ্ঞা পাঠ করে নারী সমাজকে বেঁধে রেখেছে এই সংজ্ঞা দিয়ে। কিন্তু ঐশ্বরিক গ্রন্থ বারবার নারীকে সম্মান দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সর্বশেষ ঐশ্বরিক গ্রন্থের বার্তাবাহক স্বয়ং নিজে আজ থেকে চৌদ্দোশো বছর পূর্বে নারীদের কখনো চিকিৎসক হতে উৎসাহ দিয়েছেন আবার কখনো উৎসাহ দিয়েছেন সাহিত্য, আইন শাস্ত্র পাঠ করার, সেখানে কীভাবে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীকে ঘরকন্নাতে সীমাবদ্ধ থাকার ফতোয়া দেন?

এর বিপরীতে আর একশ্রেণীর ভদ্র মহোদয় ও মহোদয়াগণ ‛নারী’ জাতিকে মুক্তির আলো দেখাতে গিয়ে নারীর সমস্ত অলংকার ভুষণ কেড়ে তাকে মুক্তির রোশনাই চোখ ধাঁধিয়ে সুকৌশলে করছে ভোগের বস্তু। স্বাধীনতা কে ইউটোপিয়া র মতো উপস্থাপন করে কখনো বা তাকে অনুপ্রেরিত করছে স্বেচ্ছায় পুরুষের শয্যাক্ষুধা মেটানোর সহজলভ্য খাদ্য হবার আবার কখনো তাকে জোর করে হায়নাদের মুখে তুলে দেওয়া হচ্ছে ছিঁড়ে খাবার জন্য। নারী স্বাধীনতার লোভাতুর দৃষ্টি তাকে ছলবলে কৌশলে করে তুলছে নারীত্বহীন সত্তা। তাদের তৈরী স্বাধীনতার নামে এই নগ্ন শিল্প তাকে আদতে প্রকৃত মুক্তি দেয়নি, বরং গৃহ কোণ থেকে মুক্ত করে বন্দি করেছে নরপিশাচদের লোভাতুর দৃষ্টিতে। কালের নিয়মে বিশ্বে কোণায় কোণায় যে বীর, সূর্যসন্তানদের আগমন ঘটে ছিল তাতো কোন এক নারীর গর্ভেই বেড়ে উঠে ছিল কোন একদিন, তাহলে কীভাবে নারীর নারীত্বকে হেও করা যায়?

কিন্তু এই দুইটি ছাড়া ও নারীর পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে বিরাজ যে সম্ভব তা কেবল বর্তমানে না অতীতের পাতাতে মেলে অসংখ্য উদাহরণ। যদি আমরা অতীতে পাড়ি দিই ইতিহাসে আমরা দেখতে পাবো জ্ঞানী, বিচক্ষণ আয়েশা(রঃ), খ্যাতনামা শল্য চিকিৎসক রুফাইদা বিনতে সাদ (রাঃ), পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালযের নির্মাতা ফাতিমা আল ফিহরিকে অথবা বিশ্ব শান্তির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাদার টেরিজাকে, আরো দেখতে পাবো স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বেগম মহল, লক্ষ্মী বাঈ, মাতঙ্গিনী হাজরার মতো অবগুণ্ঠিত একদল সেনানীকে। বর্তমানে যদি চোখ রাখি তাহলে বিদেশ বিভুঁইয়ে না দেশের মাটিতেই চলমান দ্বিতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীদের নিরবিচ্ছিন্ন অংশগ্রহণ দেখে মনে হয় এই আন্দোলন তাদের গর্ভ থেকেই জন্মলাভ করেছে। মনে হয় তারা আপন সন্তানের মতো এই আন্দোলনকে লালন করে চলেছে নির্ঘুম রাত গুলোকে আপন বুকে ধারণ করে।

ক্লারা জেটকিন, কেট ডান্সকারের শুরু করা নারীদিবস কে জাতিসংঘের সম্মতিতে ৮ই মার্চ ১৯৭৫ সালে বিশ্ব নারীদিবস হিসাবে প্রতিষ্ঠিতহতে বেশ বেগ হতে হয়েছে । লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে ছিনিয়ে আনা এই একটি দিন বিশ্বের কোণে কোণে নারী নিয়ে নানারকম চর্চা হলেও আদতে কী আসলেই নারী এই এক বিংশ শতকের পৃথিবীতে সমস্ত বৈষম্য থেকে স্বাধীন? উত্তরটা অবশ্যই ‘না’। নারী যদি প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন হতো তাহলে কেবল ভারতেই প্রতি পনেরো মিনিটে একটি নারীর ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত হতো না। নারীবাদী, মানবতাবাদী একদল মানুষ নারীকে স্বাধীনতা দেওয়ার মন্ত্রাবলি গিলিয়ে নারীর নারীত্বকে কেড়ে নগ্ন প্রায় করে পরিণত করেছে পুরুষদের ভোগের বস্তু।

নারী বসন-ভূষণ, মান-সম্ভ্রম বজায় রেখে হয়ে উঠুক এক একটা মাতঙ্গিনী, আয়েশা রেন্না অথবা সাদ বিন রুফাইদা অথবা মাদার টেরিজা অথবা ফাতিমা। আর পুরুষ হয়ে উঠুক গৃহ কোণ থেকে শুরু করে তার পরিচয় গড়ে তোলার সহায়ক। প্রতিদিন নারী হয়ে উঠুক গৃহের রাণী সাথে তার মান-সম্ভ্রম নিয়ে হয়ে উঠুক বিশ্বের রণাঙ্গনে এক সফল বীরাঙ্গনা আর এতেই নারী দিবসের স্বার্থকতা।

লেখিকা : বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির ছাত্রী

Leave a Reply

error: Content is protected !!