Friday, March 29, 2024
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদকীয়

নারী তুমি হৃদয় মোহিনী তুমিই তো শাহীনবাগ

জুবায়ের আহসান

ভাবছি বছরের এমন কোনও দিন কি অবশিষ্ট আছে যে দিনটা কোনও না কোনওভাবে উদযাপিত হয় না! ইংরেজি ক্যালেন্ডারের প্রথম দিনেই সেই যে নিউ ইয়ার্স ডে থেকে শুরু, পরদিনই বুক ডে, তার পরের দিন ভারতীয় নারী দিবস, পরের দিন বিশ্ব ব্রেইল দিবস, পরদিন জাতীয় পক্ষী দিবস। চলতেই থাকে।

১৯৭৫ সালে ৮ই মার্চ জাতিসংঘের স্বীকৃতি দানের পর থেকে সারা বিশ্ব ব্যাপী উদযাপিত আন্তর্জাতিক নারী দিবসের বাজার একদম চরম গরম। সারাবিশ্ব ব্যাপী সিংহভাগ কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে সমাজসেবক প্রায় প্রতিটি কেউকেটাই অবলা নারী প্রেমে কেঁদে কেটে নাকের জল চোখের জল এক করে ফেলবেন। নারী ক্ষমতায়নের জন্য আজব আজব সব প্রকল্পের শিলান্যাস হবে, হিউম্যান চেইন হবে, মিটিং মিছিল সমাবেশ হবে, সাহিত্য সভা হবে, কাব্য রচিত হবে, সর্বত্রই অকাতরে কুম্ভাশ্রু বিসর্জিত হবে, নারীকে দেবীর আসনে বসিয়ে সাহিত্য রচিত হবে, বিচিত্র রকমের নগ্ন পোট্রেট অঙ্কিত হবে, আর সবকটা সেকেলে ধর্মের পিন্ডি চটকে তাল বানানো হবে।

কারা করবেন এসব? যাদের নামে দশটা বিশটা রেপ কেস ঝুলছে, যারা কবর থেকে তুলে রেপ করার হুমকি দেয়, নতুবা নারী নির্যাতনের আসামি, নিদেনপক্ষে নারীর অর্ধনগ্ন দেহ ফিনফিনে পোশাকের ওপর থেকেই রাক্ষুসে দৃষ্টি দিয়ে গিলে খাওয়া মানুষগুলোই নারী সম্মানের কথা তুলে সোশ্যাল মিডিয়া আর মঞ্চ কাঁপিয়ে বেড়াবেন, চায়ের কাপে তুফান ওড়াবেন। উল্লেখ্য যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহাশয় এখনো তার স্ত্রীকে স্বীকৃতি দেননি আবার ডিভোর্সও দেননি। ইনিও কিন্তু নারী ক্ষমতায়নের কথা জোরালো ভাষণে বলে যাবেন। তবে বিশেষ এই দিনটিতে বুদ্ধিজীবীদের মরাকান্না একটা দর্শনীয় জিনিস বটে।

আমরা এমন এক সময়ে বিশ্ব নারী দিবস উদযাপন করতে চলেছি যখন নয় মাসের শিশুও পঞ্চাশোর্ধ পাষণ্ডের যৌন লালসার শিকার হয়, যখন আট বছরের আসিফারা ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই হয়ত মন্দিরে পুরোহিতের প্রত্যক্ষ মদতে গণধর্ষণের শিকার হয় ও পচাগলা দেহ বস্তাবন্দি উদ্ধার হয়। যখন ছোট্ট টুইঙ্কেলের রক্তাক্ত দেহ আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে আমরা কি ক্রমাগত সভ্যতার পথে অগ্রসর হচ্ছি নাকি অসভ্যতার জগতে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলেছি! এনসিআরবি ২০১৮র রিপোর্ট অনুযায়ী চৌত্রিশ হাজার রেপ কেসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে অর্থাৎ প্রতি ১৫ মিনিটে এক জন মা অথবা বোন আমার দেশে এই নির্মম যৌন সহিংসতার শিকার হয়। প্রকৃত চিত্র হয়ত আরো ভয়াবহ। তবে আজকাল এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর্ষনের পাশাপাশি নির্মম ভাবে হত্যা করার প্রবণতা। আসিফা, টুইঙ্কল, নির্ভয়া, প্রিয়ঙ্কা আরও কত নাম সবটা গুনে পারবেন না। সদ্য ঘটে যাওয়া উন্নাওয়ের ঘটনা সমগ্র ভারতবাসীকে বিশ্বের দরবারে মাথা হেঁট করিয়েছে। খাস বাংলার পার্ক সার্কাস কান্ড, কামদুনি, প্রমীলা, রিমার ঘটনাও বর্তমান সমাজে মহিলাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। তবে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানে থাকছে যোগী রাজ্য। রামরাজ্য বলে কথা শীর্ষস্থান দখল করতে না পারলে মান থাকেনা।

তবে যে এত ঘটা করে প্রতিবছর বিশ্ব নারী দিবস পালিত হচ্ছে তার সুফল তো নারী পাচ্ছেনা তাহলে কে সেই সুফল ঘরে তুলছে? তবে কি আধুনিকতার নামে নারীকে নগ্ন করে পথে নামিয়ে পণ্য বানানো ও পুরুষের ভোগ্য বানানোর মধ্যেই নারী দিবসের সার্থকতা? ১৯৯৯ সালের নারী দিবসের থিম ছিল ‛নারী প্রতি সহিংসতা মুক্ত পৃথিবী’। এ বছরের থিম ‛আমি সমলিঙ্গের প্রতীক : নারীর সমস্ত অধিকার নিয়ে জন্মেছি’। প্রায় প্রতিবছরই অত্যাধুনিক সব থিম নিয়ে দিনটি পালিত হয়। তবে বাস্তবায়ন হলে পৃথিবীটা সগ্গো হয়ে যেত। কিন্তু বাস্তব টা সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রতি বছর যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে নারী নির্যাতনের সংখ্যা বেড়ে চলেছে তাতে আমাদের উদ্বেগে ঘুম ভাঙেনা বটে কিন্তু নারীবাদীদের কি অবস্থা জানতে বড়ই কৌতূহল হয়।

তবে নারীবাদী বুদ্ধিজীবিরা অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন যে পণপ্রথা, বধূ নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, অ্যাসিড অ্যাটাক, ধর্ষণ ইত্যাদি কোন সমস্যা নয়, আসল সমস্যা হচ্ছে পর্দা প্রথা। মুসলিম মেয়েদের পর্দা প্রসঙ্গ আসলে অত্যাশ্চর্য ভাবে কলম বজ্রকলমে রূপান্তরিত হয় আর কবিত্ব প্রতিভা চরমে ওঠে। আওকাত থাকলে পেনের খোঁচায় পর্দার অন্তিম সংস্কার করে দিতেন। নারী স্বাধীনতার কথা বলবেন অথচ কোন নারী তার দেহ ঢাকতে চাইলে আপনার গায়ে বিচুটির চুলকানি শুরু হয় কেন? কেন মশাই মুসলিম মেয়েদের বোরখা দেখলে আপনাদের এত ফাটে কেন? এই একবিংশ শতাব্দীতে আপনার বাড়ির মেয়ে কতটা বোল্ড হতে পারল সেটা নিয়ে আপনি ভাবুন না, আপনার মেয়ের মুসলিম বান্ধবীটি কতটা হাবিজাবি কাপড় পরে সেটা নিয়ে আপনার কুম্ভরোদনের কি দরকার মশাই? কেন আপনি সেক্যুলার হয়ে ভাবতে পারলেন না যে আমার মেয়ে দেহ খোলা রাখতে চাইলে প্রতিবেশী মেয়েটারও দেহ ঢাকার অধিকার আছে? আর এই বুদ্ধিজীবিরা কিভাবে বোরখা ভেদ করে বোরখা পরিহিতা মুসলিম মেয়েদের মনের কথা, অর্থাৎ ওরা দেহ প্রদর্শন করে নারীবাদীদের চক্ষু প্রশান্ত করতে চাইছে কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক মোল্লা সমাজ ও তাদের ধর্মীয় অনুশাসনের ফলে এদের গুড়ে বালি পড়ে যাচ্ছে, এটা বুঝে যান সেটা আমার কাছে তাজমহলের কারুকার্যের থেকেও বিস্ময়কর মনে হয়েছে। এমনিতে মেয়ের মন বোঝা বড়ো মুশকিল এমনটা বড় বড় দিজ্ঞজরাই তো বলে গেছেন। তাহলে এরা কিভাবে বুঝে যান!

নারী শক্তির একটা বড়ো প্রতীক হয়ে উঠেছে শত শত শাহীনবাগ। মুসলিম মেয়েরা হিজাব সহযোগেই সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা দেখে আবার আমাদের কাটজু মহাশয় ‛জু/zoo’ এর বাসিন্দাদের মতই সংবিধান বোধ হারিয়ে ফেলছেন। শশী থারুর মহাশয়ের অবস্থাও অনুরূপ। বাংলার সেক্যুলার বামেদের কথা আর নাই বা বললাম! ওরা খরচের খাতায়। তাহলে কি নারীর আধুনিকীকরণের মূল অন্তরায় হিজাব?

বর্তমানে ও ইতিহাসে ভুরি ভুরি উদাহরণ থাকতেই পারে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে হিজাব প্রগতির অন্তরায় নয় কিন্তু সত্য ইতিহাসে এদের বড় অ্যালার্জি। এরা জানে যে দেশ তথা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হিজাবধারীরা কিভাবে অত্যাধুনিক জগতের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রথম সারিতে জায়গা করে নিচ্ছে। সোফিয়া গুডসন কে এরা জানে একজন পৃথিবী বিখ্যাত মডেল হিসেবে, হ্যাঁ একজন বোরখা পরিহিতা মডেল। লিন্ডা সর্সৌর, ফ্যাশন ব্লগার রুমা, বিখ্যাত হিজাব পরিহিতা মডেল হালিমা আদেন ইত্যাদি অসংখ্য মুসলিম মহিলা হিজাব পড়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। বেহনাজ শাফিঈ একজন হিজাব পরিহিতা রোড রেসার। আয়েশা রেননা, লাদিদা ফারজানা, রানিয়া সুলেখারা তো হিজাব পরেই শাসকের চোখে চোখ রেখে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর আপনি মশাই বীর বাহাদুর নারীবাদী প্রবল বীরত্বে গৃহ দ্বার রুদ্ধ করে আধুনিক হুঁকোয় টান মারছেন।

তাই বলি কি অত্যাধুনিক দাদাভাই দিদিভাই রা আপনারা বরং পরনের পোশাক টুকু ছোট করতে করতে জারোয়া জাতির ন্যায় সভ্য হয়ে ওঠেন, অসুবিধা নাই। তবে শাড়ি, চুড়িদার, বোরখা যে যা পড়তে চায় পড়তে দিন। স্বাধীনতা সবারই থাকা দরকার। আপনারা গো রক্ষা বাহিনীর মত জয় শ্রীরাম বলতে বলতে মানুষ মারেন না বটে, কিন্তু আপনাদের তীক্ষ্ণ বক্র দৃষ্টি, পথে ঘাটে মুসলিম মেয়ে দেখে কটূক্তি, আপনার তীব্র ব্যাঙ্গ করে লেখা কবিতা, আপনার সৃষ্টি কলজয়ী সাহিত্য কিন্তু প্রতিনিয়ত লাখ লাখ মুসলিম মহিলা হৃদয়কে রক্তাক্ত করে চলেছে। পরিশেষে বলি, সবকিছু ইতিহাসে লেখা হবে। যদি প্রকৃত অর্থেই নারীবাদী হয়ে উঠতে চান তাহলে এই বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করুন। বোরখা সমস্যা নয়, নারী নির্যাতনই এই সময়ের মূল সমস্যা। সমাধানে অগ্রবর্তী হউন, প্রকৃত অর্থেই নীতিবান হয়ে উঠুন, মানুষ হয়ে উঠুন। স্বার্থক হবে বিশ্ব নারী দিবস।

Leave a Reply

error: Content is protected !!