ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ : আজ ৫ অক্টোবর বৃহস্পতিবার বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩। বাংলাদেশ, ভারতসহ বিশ্বের প্রায় ১৭০টি দেশে ৩০ মিলিয়ন শিক্ষক ও ৫০০টি সংগঠন শিক্ষকদের সম্মানার্থে এই দিবসটি উদযাপন করছে। এইদিন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিবসে এই দিনটি উদযাপন করা হলেও মূলত ৫ অক্টোবর ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব শিক্ষক দিবস। দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে থাকে-যা জনসচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে শিক্ষকতা পেশায় অবদানকেও স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রতি বছরের ন্যায় ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৩’ এর প্রতিপাদ্য বিষয় হল- ‘The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage.’ বিশ্বব্যাপী বর্তমান শিক্ষা ব্যববস্থায় যে শিক্ষক সংকট বিদ্যমান সেই প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি যুক্তিসঙ্গত, বিশেষত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশে যেমন মানসম্মত শিক্ষকের সংকট রয়েছে, সাথে সাথে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় শিক্ষকেরও সংকট রয়েছে। তথাপি যে সংখ্যক শিক্ষক রয়েছে তাদের সকলকে অবশ্যই আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে হবে।
১৯৪৭ সালে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে ‘শিক্ষা সনদ’ প্রণয়নের আলোচনার প্রেক্ষিতে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত করার জন্য ১৯৫২ সালে ‘বিশ্ব শিক্ষা সংঘ’ গঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে অনুষ্ঠিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় সরকারের বিশেষ সম্মিলনে শিক্ষকদের পেশাগত অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা বিষয়ক ঐতিহাসিক ইউনেস্কো আইএলও সুপারিশ প্রণীত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯০ সালে ১৬৭টি দেশের ২১০টি জাতীয় সংগঠনের প্রায় ৩ কোটি সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত হয় বেলজিয়াম ভিত্তিক বা আন্তর্জাতিক শিক্ষা সংগঠন। বাংলাদেশসহ জাতিসংঘের ১৭০টি রাষ্ট্রের শিক্ষক সম্প্রদায় ২৪ঘণ্টার জন্য হলেও ৫ অক্টোবর কে ‘বিশ্ব শিক্ষা দিবস’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দাবি জানান ইউনেস্কোর কাছে।
বিশ্ব শিক্ষক সম্প্রদায়ের তীব্র দাবির মুখে ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ড. ফ্রেডরিক প্যারিসে অনুষ্ঠিত ২৬তম অধিবেশনে ৫ অক্টোবরকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৫ সালে ৯ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং শিক্ষক সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে প্রথম বারের মত ‘বিশ্ব শিক্ষা দিবস’ পালিত হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার এই দিবসটি পালনে নিরব থাকলেও বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া আদায়ে সরব রয়েছে। কিন্তু যে ইউনেস্কো আইএলও সনদের ভিত্তিতে এই দিবসটি নির্ধারিত হলো- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২বছরেও শিক্ষকদের সেই অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়নি। শিক্ষার গুণগতমান ও শিক্ষকদের চাহিদা নিশ্চিত করা যায়নি। স্বাধীনতার ৫ দশকেও জাতীয় শিক্ষা নীতি বাস্তবায়ন করা হয়নি। শিক্ষানীতিতে অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার চরম বৈষম্যের কারণে জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আর শিক্ষকেরা মোমবাতির মতো নিজে পুড়ে অন্যকে শিক্ষার আলো দান করেন।
শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে। তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ, সবাক, সকর্ম করে তুলে মানুষের মধ্যে ঘুমন্ত মানবতাকে জাগত করে। আর পেশাগত দ্বায়িত্ববোধ, মেধা, প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দক্ষতায় পরিপূর্ণ শিক্ষক হচ্ছে দেশ ও জাতির অনন্য মানব সম্পদ। আর প্রবাহের জন্য যাকিছু উত্তম, যা কিছু সত্য- তাই প্রগতিশীলতা। তারই মিলনমেলার নব তারুণ্যের মধ্যমণিতে যারা আছেন তারা হলেন শিক্ষক। সমাজের মহাকাশের মাঝে নীহারিকা হয়ে অবস্থান করছে শিক্ষকসমাজ। যে নীহারিকা জন্ম দেয় হাজার হাজার নক্ষত্ররাজি, শিক্ষকদের অনাদি আলোক রশ্মির উৎস থেকে জন্ম হয় আগামীর সমাজ সচলতার একক গুলি। যাদের সমাহারে তৈরি হয় গোটা সমাজ, গোটা বিশ্ব।
আর ইউনেস্কো-আইএলও যে সুপারিশ গ্রহণ করে তাতে তিনটি বিষয় লক্ষণীয়। এগুলো হলো শিক্ষকের অধিকার, কর্তব্য ও মর্যাদা। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে রাষ্ট্র প্রদান করবে শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা, সমাজ প্রদান করবে শিক্ষকের মর্যাদা আর শিক্ষকের কর্তব্য শিক্ষকরা নিজেরাই পালন করবেন। অ্যাকাডেমিক শিক্ষার জগতে শিক্ষকদের প্রধানতম কাজ হলো শ্রেণিভিত্তিক। শ্রেণীতে শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকবে আর শিক্ষক পাঠ্যসূচি অনুযায়ী তাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেবেন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ে শিখন শিখানো কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করবে। শ্রেণিকার্যক্রম ছাড়াও শিক্ষার্থী মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা কার্যক্রম, উত্তরপত্র মূল্যায়ন, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আরো যুক্ত হবে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম, এগুলো হলো শিক্ষকের কর্তব্য। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরিচালিত উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে বিশেষ করে বেসরকারি পর্যায়ে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া সেমিনার-সিম্পোজিয়াম অনুপস্থিত। সেগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় না। এ ছাড়া মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকও উচ্চশিক্ষাপর্যায়ে বেসরকারি ক্ষেত্রে পূর্বে যে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে তা স্বজনপ্রীতি, রাজনৈতিক এবং উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে হয়েছে বলে শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে এদের মধ্যে বিভক্তি রয়েছে। যারা শ্রেণিকার্যক্রমে আগ্রহী ছিলেন এবং দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করে আসছেন তারা বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানার্জন করতে পেরেছেন। ফলে পেশাগত জীবনে এরা অভিজ্ঞ।
আরো দু’টি শ্রেণী এখানে রয়েছে। এর একটি হলো রাজনৈতিক শ্রেণী-যারা রাজনীতিকে বেশ গুরুত্ব দেন। শ্রেণিকার্যক্রমে এরা থাকেন না, রাজনৈতিক কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকেন, দল যখন সরকার গঠন করে তখন এরা মহাক্ষমতাধর। কেউ কিছু এদের বলতে পারে না। আর দল যখন বিরোধী দল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তখন এদের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন থাকে, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করতে পারেন না।এই উভয় অবস্থায় তারা শ্রেণিকার্যক্রমের বাইরে অবস্থান করেন। ফলে দীর্ঘ চাকরিকাল অতিক্রম করলেও এরা অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন না- এদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান নিম্ন পর্যায়ের। এদের মধ্যে আরেক শ্রেণী রয়েছে যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকেন কিন্তু রাজনীতি করেন না। এরাও শ্রেণিকার্যক্রমবিমুখ। এই উভয় শ্রেণীর শিক্ষক হলেন উইক টিচার্স। আরেক ধরনের শিক্ষক রয়েছেন যারা শিক্ষা বাণিজ্যের সাথে জড়িত। শ্রেণিকক্ষে দরদের সাথে পাঠ দান না করালেও ঘরোয়া পরিবেশে অর্থের বিনিময়ে এরা পাঠ দান করান। এদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ভালো। কিন্তু তাদের কর্মটি অনৈতিক। এ ছাড়াও রয়েছেন গবেষক শিক্ষক, এদের দেখা মেলে উচ্চশিক্ষাপর্যায়ে। এদের সংখ্যা নেহায়েত কম হলেও শিক্ষক হিসেবে এরা উচ্চমানের। এদের অবস্থা শ্রেণিকার্যক্রমের সীমা পেরিয়ে যায়। শিক্ষা বেসরকারি পর্যায়ে থাকায় প্রকৃত অভিজ্ঞ শিক্ষকদের যথাযথ মূল্যায়ন করা যাচ্ছে না। তাই চাকরি জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তা হলে দুর্বল শিক্ষক বাদ দেয়া যাবে। সমস্কেলে ও বেতনে এদের অন্য কোনো সেক্টরে তৃতীয় শ্রেণীর পদে স্থানান্তর করা। এটি দায়িত্ব ও কর্তব্যে অবহেলার ফলে করতে হবে। উল্লেখ্য, রাজনীতির সাথে জড়িত সব শিক্ষক উইক টিচার্স নন, তবে ব্যাপক অংশ তাই।
শিক্ষা যেমন জাতির মেরুদণ্ড, ঠিক তেমনি আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র। শিক্ষক মানেই যেন একটি সম্মানিত শব্দ, জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার, সব মানবিক গুণের অধিকারী। আমাদের জাতীয় জীবনে শিক্ষকের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তাই ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। একজন আদর্শ শিক্ষক শুধু সুকৌশলে পাঠদানই করেন না, ছাত্রদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাদের সুপ্ত প্রতিভাকেও জাগিয়ে তোলেন। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ডাক্তার, আইনজীবী, আমলা, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, তথা আগামীর ভবিষ্যৎ। তিনি যেন প্রজন্ম গড়ার কারিগর! ব্যক্তিত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি গঠনেও শিক্ষক প্রতিনিয়ত অবদান রেখে চলছে।
বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষকের আচরণ, মূল্যবোধ, সততা প্রতিটি কোমল শিশুর জীবনেই ব্যাপক প্রভাব ফেলে। তারা তাদের প্রিয় শিক্ষকটির অনুসারী হতে চায়, তাঁর আচরণগুলো আয়ত্ত করে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করে। তাই একটি জাতিকে আলোকিত ও সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী করতে সুশীল শিক্ষক সমাজের কোনো বিকল্প নেই, শিক্ষকরা আমাদের জাতীয় জীবনে একেকটা আশীর্বাদ।
যোগ্য শিক্ষকরাই প্রতিটি ছাত্রের মনে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ, ধর্ষণের মতো অপরাধপ্রবণতার প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করে দেশপ্রেম, সততা, সময়ানুবর্তিতা জাগিয়ে তুলে একটি আদর্শ জাতি গঠন করতে পারেন। তাই জাতির প্রতি তাঁদের দায়িত্ববোধের জায়গাটাও অনেক বেশি। প্রতিটি শিক্ষক ভালো থাকুক, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা আরো সমৃদ্ধ হোক।
শিক্ষার্থীদের অধিকার ক্ষুণ্ন না হয় লক্ষ্য রাখতে হবে সেদিকে – এ তো গেল সমস্যার কথা। সমস্যা সব দেশেই কমবেশি আছে। আমাদের সমস্যা হয়তো কিছু বেশি। তবে এর মধ্যেও আমাদের শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের অধিকারের কথা যেমন ভাবতে হবে, তেমনি শিক্ষার্থীদের অধিকার যাতে কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন না হয়, সেদিকটার প্রতিও লক্ষ্য রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তানের মতো। শত প্রতিকূলতা, সংকট, আর বাধাবিপত্তির মধ্যেও তাদেরকে এগিয়ে নিতে হবে। তাদের পাশে থেকে স্বপ্নের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে তাদের স্বপ্নবাজ করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের বঞ্চনার প্রভাব তাদের ওপর কোনোভাবেই যাতে না পড়ে, তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ রাখতে হবে। একজন সত্যিকারের শিক্ষকের বাধাবিপত্তিকে অতিক্রম করার লড়াকু মানসিকতা থাকতে হবে। আর এই মানসিকতাটা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই তারা জীবনসংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য লড়াই করার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে।
বিশ্বে যেসব শিক্ষক স্মরণীয়-বরণীয় হয়েছেন, তাঁরা লড়াই যেমন করেছেন, তেমনি ধৈর্য আর ত্যাগের অসাধারণ দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কথাই বলি। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক হতে গিয়ে উনি কত যে লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা তো সবার জানা। কিন্তু পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তাআলা প্রেরিত হুকুম-আহকামগুলো মানুষকে শিক্ষা দিতে কখনো পিছপা হননি। জাগতিক কোনো কিছুর জন্য নয়, বরং মহান আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য তিনি আজীবন শিক্ষাদানের কাজটি করে গেছেন। যার ফলে বিশ্ব আজ পেয়েছে শান্তির এক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলাম, যা ইহকাল আর পরকালের শান্তি ও কামিয়াবি লাভের উপায়।
বিশ্ব বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস মূলত ছিলেন একজন শিক্ষক। আর তার এই শিক্ষাদানের পিছনে জাগতিক কোনো চাওয়া–পাওয়ার বিষয় না থাকা সত্ত্বেও তাঁকে এথেন্সের তৎকালীন শাসকগোষ্ঠী মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। তাতে সক্রেটিসের অবশ্য কোনো ক্ষতি হয়নি, বরং সারা বিশ্বে আজ তিনি স্মরণীয়-বরণীয় এক দার্শনিক ও শিক্ষকের প্রতীক হয়ে বেঁচে আছেন কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ের মনিকোঠায়।
আমাদের বঙ্গবন্ধুর কথাই বলি। তাঁর কর্ম, আদর্শ আর ত্যাগের মাধ্যমেই তিনি আজ এ দেশের লক্ষ-কোটি মানুষের কাছে একজন বড় মাপের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু। ঘাতকেরা তাঁকে হত্যা করে তাঁর নাম-নিশানা পর্যন্ত এদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। বঙ্গবন্ধু আজ হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে স্বীকৃত। যত দিন দেশ থাকবে, যত দিন ইতিহাস থাকবে, তত দিন তিনিও বেঁচে থাকবেন মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ভালোবাসার লাল গোলাপ আর রাজনৈতিক শিক্ষাগুরুর প্রতীক হয়ে।
এমন আরও অনেক উদাহরণ দিয়ে লেখাটা বড় করা যাবে। আর সেদিকে যেতেও চাই না। তবে এটাও ঠিক সবাই হজরত মুহাম্মদ (সা.), সক্রেটিস বা বঙ্গবন্ধু হতে পারবেন এমনটা আশা করার কোনো কারণ নেই। এরপরও আমাদের সমাজেও যেসব সম্মানিত শিক্ষক নিঃস্বার্থভাবে একটু গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে ওঠে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করতে পারেন, তাঁরা নিঃসন্দেহেই স্মরণীয় ও বরণীয় হন। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অসাধারণ সম্মান পান। শুধু যে শিক্ষার্থীরা তাঁদের সম্মান করে এমন নয়, বরং সমাজেও তাঁরা বরণীয় হয়ে থাকেন। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে অন্যান্য বিভাগের ক্যাডাররা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সমাজে খুব সম্মান পান। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি অন্য রকম মনে হয়। তাঁরা সম্মান পান ঠিকই। তবে ব্যক্তি হিসেবে নন, মানুষ সম্মান করেন তাঁদের পদকে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পদ চলে যাওয়ার পর তাঁদের সম্মানও চলে যায়। কিন্তু একজন আদর্শ শিক্ষকের সম্মান কিন্তু কোনো দিনই কমে না। এমনকি মৃত্যুর পরও না। তবে এমন আদর্শ মানে পৌঁছাতে হলে অবশ্যই পরিশ্রম যেমন দরকার, তেমনই ত্যাগ স্বীকারও অপরিহার্য।
দেশ ভেদে শিক্ষক দিবস – বিশ্বের ১০০টি দেশে শিক্ষক দিবস পালিত হয়ে থাকে। অনেক দেশে দিবসটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখে পালিত হয়। যেমন: ভারতে শিক্ষক দিবস পালিত হয় ৫ সেপ্টেম্বর। অস্ট্রেলিয়ায় অক্টোবর মাসের শেষ শুক্রবার শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়। শেষ শুক্রবার যদি ৩১ অক্টোবর হয়, তা হলে ৭ নভেম্বর শিক্ষক দিবস পালিত হয়। ভুটান শিক্ষক দিবস পালন করে ২ মে, ইন্দোনেশিয়া ২৫ নভেম্বর, মালয়েশিয়া ১৬ মে, ইরান ২ মে, ইরাক ১ মার্চ, আর্জেন্টিনা ১১ সেপ্টেম্বর, ব্রাজিল ১৫ অক্টোবর, চীন ১০ সেপ্টেম্বর, তাইওয়ান ২৮ সেপ্টেম্বর, থাইল্যান্ড ১৬ জানুয়ারি, সিঙ্গাপুর সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার দিনটি পালন করে।
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব শিক্ষক দিবস শুধুমাত্র শিক্ষকদের ন্যায্য স্বার্থ সংরক্ষণের কথাই বলেনা, বরং আগামি প্রজন্মের মানসম্মত শিক্ষার কথা চিন্তা করে শিক্ষকতা পেশাকে আরো আকর্ষনীয় এবং শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করনের কথাও বলে,আর শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতির স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত ও দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমা দুনিয়ায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে আদব-কায়দার খুব একটা গুরুত্ব নেই। কিন্তু আমাদের দেশে আছে এবং তা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরই অংশ। এ ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার স্নেহ-ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা-সম্মানের যে পবিত্র সম্পর্কের ঐতিহ্যে আমরা বিশ্বাসী, তা রক্ষায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ এর ফলে কেবল ছাত্র-শিক্ষক নয়, সমগ্র জাতি উপকৃত হবে।আর শিক্ষকদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের জন্য জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে সময়োপযোগী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করলে শিক্ষার মান উন্নয়ন ঘটবে।বিশ্ব শিক্ষক দিবসে বিশ্বের সকল শিক্ষককে জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। একজন আদর্শ মানুষ গড়তে আদর্শ শিক্ষকের কোন বিকল্প নেই।
লেখক, কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি (বাংলাদেশ)
Tags:World Teachers Day