তুহিন সাজ্জাদ সেখ
আজ অত্যাধুনিকতার বাড়বাড়ন্ত……!
সভ্যতা আজ এতই আধুনিক যে, কোন একজন ছেলে এবং একজন মেয়ের একই ঘরে একই শয্যায় থাকার জন্য বিয়ে নামক ছাড়পত্রের কোন প্রয়োজন হয় না। নিছকই স্বেচ্ছাচারিতা আজ সন্তানের জন্ম দেওয়া – যে কেউ চাইলেই ‛একক বাবা’ (Single Father) কিংবা ‛একক মা’ (Single Mother) হতে পারেন; সবই বিজ্ঞানের দৌলতে। তবে বিয়ের প্রচলন আজও আছে। ভাবনার বিষয় হল এই যে, সমস্ত বিয়ে কিংবা ‛একসঙ্গে থাকা’ (Live in relationship) কিন্তু বিজ্ঞান সম্মত নয়। কার শরীরে কি আছে কে বলতে পারে – নারী পুরুষের মিলনের ফলে যে সন্তান সন্ততির জন্ম হবে তার কপালে নেমে আসতে পারে দূর্ভোগ, জীবন হয়ে উঠতে পারে দূর্বিসহ! তাই সংকরায়ণের আগেই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নেওয়া দরকার আমাদের শরীরে কোন রোগ বাসা বেঁধে নেই তো? যা আমাদের সন্তানের জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারে।
‛সিকল সেল’ এমনই একটি রোগ যা মা ও বাবার শরীর থেকে সন্তানের শরীরে আসে, এটি একটি জিনগত রোগ। এই রোগে বহু মানুষ মারা যান, এটি বংশগত বিকার তাই এ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে রাষ্ট্রসংঘ একটি বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে প্রতিবছর ১৯ জুন ‛বিশ্ব সিকল সেল দিবস’ পালন করে।
আমাদের শরীরে যে প্রথম বাইশ জোড়া ক্রোমোজোম আছে যা লিঙ্গ নির্ধারণে সাহায্য করে না, তাদের মধ্যেই ‛সিকল জিন’ অবস্থান করে। তাই ‛সিকল সেল’ রোগের কারণ বাবা ও মা উভয়ই হতে পারেন। বাবা ও মা উভয়ের শরীর থেকে এই রোগটি সন্তানের দেহে আসে। এটি কখনোই অন্যের শরীর থেকে কারোর শরীরে প্রবেশ করে না। যদি মা ও বাবা দুজনের মধ্যে যে কোন একজনের শরীর থেকে ‛সিকল জিন’ সন্তানের শরীরে প্রবেশ করে তাহলে ওই সন্তানের দেহে ‛সিকল সেল’ রোগের কোন লক্ষণ দেখা দেবে না, কিন্তু ‛সিকল জিন’ এর বাহক হয়ে থাকবে। এই জিনের বাহক হওয়া মানেই কিন্তু অসুস্থতা নয়।মা ও বাবা উভয়ই যদি ‛সিকল জিন’-এর বাহক হন তাহলে তাদের জন্ম দেওয়া ২৫ শতাংশ সন্তান সন্ততিরই এই রোগের শিকার হবে এবং ৫০ শতাংশ এই রোগের বাহক। কিন্তু যদি মা ও বাবার মধ্যে যে কোন একজন এই জিনের বাহক হন তাহলে তাদের অপত্য কখনোই রোগী হবে না, তবে ৫০ শতাংশ অপত্যের শরীরে এই জিনের ধারা বর্তমান থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই একটি রক্ত পরীক্ষা খুব জরুরী।
এটি একটি মারাত্মক জিনঘটিত রোগগুচ্ছ যা কোন একজন ব্যক্তির শরীরে রক্তের মধ্যে উপস্থিত লোহিত রক্ত কণিকা তথা হিমোগ্লোবিন কে আক্রমণ করে।এর ফলে স্বাভাবিক গোলাকার নমনীয় রক্ত কোষের আকার পরিবর্তিত হয়ে দৃঢ় এবং অর্ধ চন্দ্রাকৃতি হয়ে যায়। ওই শক্ত অনমনীয় বিকৃত কোষ সমূহ সারা শরীরে রক্ত কনিকার এবং অক্সিজেনের প্রবাহ প্রায় বন্ধ করে দেয় ফলে সারা শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয়। এই অজ্ঞাত প্রচন্ড যন্ত্রণার ঘটনা কে ডাক্তারী পরিভাষায় ‛সিকল সেল সংকট’ বলা হয়ে থাকে।
‛সিকল সেল’ হলো এমন একটি রোগ যার ‘ব্যাপক উপসর্গ’ এবং রোগীর ‛আশু মৃত্যু’।এই রোগের লক্ষণ অপত্যের শরীরে জন্মের এক বছরের মধ্যে ধরা পড়ে – প্রায় পাঁচ মাস বয়সের মধ্যেই। এর মূল লক্ষণ হলো রক্তাল্পতা: শরীরে লোহিত রক্ত কণিকা এবং হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ দারুন ভাবে কমে যায় বলে। এই জন্য এই রোগটিকে ‛সিকল সেল অ্যানিমিয়া’ বলা হয়। এই রোগের ফলে সারা শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা শুরু হয় যখন সারা দেহে রক্ত চলাচল বিঘ্নিত হয়। হাত ও পায়ের পাতার নিচে ঘাম হয়, ঘন ঘন জীবাণুর সংক্রমণ দেখা দেয় শরীরে, দৈহিক বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয় এবং দৃষ্টি শক্তি কমে যায় এই রোগের কারণে। এমনকি এর ফলে দেহে কমলা রোগের প্রকোপ দেখা যায়, অবসাদ গ্রস্ত হয়ে পড়ে সারা শরীর ও মন; আমাদের বয়ঃসন্ধিকালের বিকাশ ব্যাহত হয় দারুন ভাবে।
এই রোগ সাধারণত আমাদের শরীরের যকৃত, বৃক্ক, ফুসফুস, হৃৎপিন্ড এবং প্লীহা নামক অঙ্গ গুলোকে আক্রমণ করে। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের মূলত ব্যাপক উপসর্গের দরুন মৃত্যু হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকিটা খুব বেশি দেখা যায়। স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকির মাত্রা টা সর্বোচ্চ হয় দুই থেকে ষোলো বছর বয়সের মধ্যবর্তী সময়ে। তবে উক্ত রোগাক্রান্ত প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারীর মৃত্যুর প্রধান কারণ হলো তীব্র বুকে ব্যাথা, স্ট্রোক, ফুসফুসীয় উচ্চচাপ এবং জীবাণুর সংক্রমণ। এ রোগ বড়ই মারাত্মক!
এতটাই মারাত্মক রোগ যে, এ যাবৎ এই রোগের সরাসরি কোন চিকিৎসা নেই; কেবলমাত্র উপসর্গের চিকিৎসা ছাড়া। এই রোগের কারণে সৃষ্ট তীব্র যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে বেদনানাশক ওষুধই ব্যবহার করা হয়, যেমন ‛মরফিন’ এই যন্ত্রণা কমাতে বেশ ভালো কাজ করে। এই রোগ সারিয়ে তোলার জন্য ‛হাইড্রক্সিইউরিয়া’ নামক অন্য একটি ওষুধও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে এই বিকার সারাতে সবচেয়ে ফলপ্রসূ উপায় হল অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন: একটি চিকিৎসাগত প্রক্রিয়া যেখানে একটি আন্ত:ধমনীয় নলের মাধ্যমে হাড়ের মধ্যে সস্য কোষ (stem cell) প্রবেশ করানো হয় ,হাড় মধ্যস্থিত মৃত কোষ সমূহকে প্রতিস্থাপন করার উদ্দেশ্যে। এই সস্য কোষ হলো স্পঞ্জের মতো নরম একধরনের কোষ যা আমাদের শরীরে রক্ত তৈরি করতে সাহায্য করে। তবে এই পদ্ধতি অবলম্বন করেও খুব কম সংখ্যক রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব – সাফল্যের হার খুবই কম।
এই রোগ যে কোন মানুষের হতে পারে। তবে প্রধানত আফ্রিকা, আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ ইউরোপ এবং মধ্য পূর্বের দেশ গুলোর মানুষজনদের মধ্যে এই রোগের প্রকোপ অনেক বেশি। প্রায় ত্রিশ লক্ষ আমেরিকার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। আফ্রিকার আট থেকে দশ শতাংশ মানুষ এই রোগে ভুগছেন। যুক্ত রাজ্যের প্রতি ৭৬ জন শিশুর মধ্যে একজন এই রোগের বাহক; প্রায় পনেরো হাজার লোক এই রোগের শিকার, প্রতি বছর প্রায় ২৭০ টি শিশু এই রোগ নিয়ে জন্মায় যুক্ত রাজ্যে। তবে ভারতবর্ষেও এই রোগের প্রভাব কম নয়। ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই রোগের যথেষ্ট প্রাদুর্ভাব লক্ষনীয়, যেমন- মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট,ওড়িশা, বিহার, কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তিশগড় প্রভৃতি রাজ্যে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে প্রায় ১-৪০ শতাংশ এই রোগের শিকার।মধ্যপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৯ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৯২ জন ব্যক্তি অসম জাইগোটের ‛সিকল সেল’ রোগী এবং প্রায় ৬৭ হাজার ৮৬১ জন সম জাইগোটের রোগী।
সমগ্র ভারতবর্ষের প্রায় ৪৬১ টি উপজাতিদের মধ্যে এই রোগটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় – গন্ড, ভিল, পাওয়ার, প্রধান, ওটকার, মাদিয়া, দোদিয়া, রোহিত, ডুবলা, গমিত, নাইকা, কুকানা, বাসব প্রভৃতি উপজাতিদের মধ্যে। ভারতের প্রথম ‛সিকল সেল’ রোগটি ধরা পড়ে ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দে, দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পর্বতের পাদদেশে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যে। ঠিক ওই একই বছরে উচ্চ অসমের চা কর্মীদের দেহেও ওই রোগের লক্ষণ দেখা যায়; ওই শ্রমিকগুলো বিহার ও ওড়িশা থেকে আগত।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই রোগটি সম্পর্কে প্রথম বলেন আর্নেস্ট এডওয়ার্ড আইরনস্ নামে একজন প্রশিক্ষণরত ডাক্তার, যিনি শিকাগো প্রেসবাইটেরিয়ান হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। ওই সময় গ্রেনাডার ওয়াল্টার ক্লীমেন্ট নোয়েল নামে একজন কুড়ি বছর বয়সী তরুণ পাঠরত দাঁতের ডাক্তার রক্তাল্পতা নিয়ে ওই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন,যার চিকিৎসা করছিলেন ড. আইরনস্ এবং তিনিই প্রথম ‛সিকল সেল’ সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে ড. আইরনস্ এর তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক ড. জেমস বি হেরিক এক গবেষণা পত্রে আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রের প্রথম ‛সিকল সেল’ রোগীর উল্লেখ করেন। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যাদের রক্তের গ্রুপ ‛ও’, ‛বি’,‛এ’ এবং ‛এ বি’ তাদের শরীরে ‛সিকল জিন’ থাকার সম্ভাবনা বেশি।
‛সিকল সেল’ বা ‛সিকল সেল অ্যানিমিয়া’ একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। এই রোগ সম্পর্কে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে জনসচেতনতা তৈরি করতে ২০০৮ খ্রীষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রসংঘ তার সাধারণ সভায় ‛সিকল সেল’কে একটি জনসাধারণের ‛সর্বাগ্রবর্তী জিনবাহিত রোগ’ হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০০৯ খ্রীষ্টাব্দে ১৯ জুন প্রথম ‛বিশ্ব সিকল সেল দিবস’ উদযাপিত হয়। এ বছরেও সমান গুরুত্বে এই দিনটি উদযাপিত হচ্ছে বিশ্বের বহু প্রান্তে।
আত্মসচেতনতাই সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক সমস্ত বিকারের ক্ষেত্রে। তাই নিজে থেকেই যদি নিজেদের এবং আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে একটি সহজ রক্ত পরীক্ষা করা হয় তাহলেই নিশ্চিত হওয়া যায় জীবনের ব্যাপারে। কোন সন্তানের জন্ম দেওয়ার আগে মা ও বাবা উভয়ের রক্ত পরীক্ষা করা অত্যন্ত আবশ্যিক। একটি সুস্থ সন্তানই পারে একটি সুস্থ পরিবেশ রচনা করতে। একটি রক্ত পরীক্ষা বদলে দিতে পারে একটি জীবন ওরফে একটি গোটা সভ্যতা। আজ প্লাবিত প্রযুক্তির যুগে একজন জনবিজ্ঞান লেখক হিসেবে আদরনীয় পাঠকবর্গের কাছে এই টুকু সচেতনতা প্রত্যাশা করতেই পারি – কি বলেন আপনারা???