Thursday, March 28, 2024
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদক সমীপেষু

আইএসএফ, ভাইজান, ২১শে রাম-২৬শে বাম ইত্যাদি…

ইমরান হোসেন : অলিমুদ্দিনের লালবাড়ির মৌন স্লোগান ২১শে রাম-২৬শে বাম। সেলিম-সুজন বাবুদের বুক ফটলেও মুখ ফুটে কিন্তু এই কথা বলতে পারছে না, মুসলিম ভোট যে চাই। ৩৪ বছর ধরে ঠান্ডা ঘরে বসে পরিকল্পনা মাফিক মুসলিমদের পিছিয়ে দেওয়ার জন্য বামেদের জুড়ি মেলা ভার। মুসলিম সমাজ এখন বামেদের থেকে শত হস্ত দূরে। তাই এখন তারা হারানো জমি ফিরে পেতে ভাইজনের আইএসএফ-কে নৌকায় তুলে তীরে ফিরতে চায়। সূর্য বাবুদের ভাবনা, আব্বাস সিদ্দিকীর জলসায় বসা চটপাতা পাবলিকদের ভোট যদি মেলে তবে হয়ত সুদিন আসতে পারে। আইএসএফ নিয়ে তাদের মৌন ভাবনাটা যদিও আব্বাস ভাইজান সহজেই বুঝবে না এটাই প্রত্যাশিত।

এখন প্রশ্ন, জলসায় সুর তোলা ভাইজান হঠাৎ কেনই বা রাজনীতির ময়দানে? এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ভাইজান এই কয়েক বছরে বেশ রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠেছেন যা তাঁর বংশের কেউ আগে হয়নি। সাধারণত হাওড়া-হুগলির কারও কাছেই ভাইজনের অতীত ও বর্তমান অজানা নয়। মূলত মুসলিমদের জলসা বা ধর্মীয় সভাগুলোতে বিতর্কিত কথা বলে আলোচনার শিরোনামে উঠে এসেছেন বর্তমান আইএসএফ-এর সর্বেসর্বা আব্বাস সিদ্দিকী। এমনকি জলসায় তাঁর কথাগুলোর মাধ্যমে মুসলিমদের ঈমানের উপর আঘাত করতে শুরু করেন তিনি। প্রথম থেকেই ফুরফুরা শরীফ ছাড়া অন্যান্য মুসলিম সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে ধর্মীয় জলসায় ঝড়ের বেগে সমালোচনা করতেন। সাঁতরাগাছির মৌখালিতে তাঁর জন্যই সম্মুখ সমরে নেমেছিল মুসলিম তরুণেরা। এখন অবশ্য সে সব অতীত। কয়েক বছর আগে তাঁর মাথায় আসে নলেজ সিটির স্বপ্ন। এই স্বপ্ন অনেক মানুষকেই অবাক করে দিয়েছিল। সাধারণত দাদা হুজুর পীর আবুবক্কর সিদ্দিকী (রঃ) এর মৃত্যুর পর এমন গঠনমূলক ও জনকল্যাণমুখী ভাবনা সিদ্দিকী বংশের আর কেউ নেয়নি। অনেকেই ভাবতে শুরু করে, এই তো আমাদের প্রাণের হুজুর যিনি শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির কথা ভাবতে শুরু করেছেন। কিন্তু অচিরেই সেই স্বপ্নে জল ঢেলে দিয়ে উনি রাজনীতির ময়দানে নামার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। নলেজ সিটির মাটি এখন গবাদি পশুদের চারণভূমি।

কথিত আছে ক্ষমতা বা কতৃত্বের স্বপ্ন মানুষকে অন্ধ করে তোলে। ভাইজানও সিদ্দিকী বংশের অন্যান্য সকলকে অগ্রাহ্য করে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য জলসগুলো ব্যবহার করতে শুরু করেন। এমনকি দাদা হুজুরের নামেও বলতে শুরু করেন যে, তিনি নাকি ৪৪টি সিটে রাজনীতির ময়দানে লড়াই করেছেন। ফুরফুরা শরীফ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে থেকেও এমন কথা আমি এই জীবনে শুনিনি। ছোট থেকেই ফুরফুরা শরীফ বা হুজুরদের সঙ্গে বেশ খাস সম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে। ভাইজনের এমন সব অদ্ভুত মন্তব্য শুনে অনেক হুজুরই অবাক হয়েছিলেন।

তারপর বহু জল গড়িয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপির জায়গা তৈরি হয়েছে। এইবার ভাইজান পাকাপাকি রাজনীতিতে নামতে চাইলেন। কিছু বিক্ষুব্ধ তৃণমূলী এবং দলিত নেতা কর্মীদের নিয়ে রাজনৈতিক দল ঘোষণা করলেন, ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের রাজনৈতিক সচেতনতা সত্যিই খুবই দরকার। অস্বীকার করার উপায় নেই, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তারা শুধু ‘ভোট ব্যাঙ্ক’ হয়েই থেকে গেছে। তাই তাদের অধিকারের কথা কেউ বললেই মুসলিম তরুণরা তাকে মাথার মুকুট মনে করতে শুরু করে। এই ক্ষেত্রে ভাইজান সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু ওঁর মধ্যে আছে ক্ষমতা ও কতৃত্বের ভাবনা। হাওড়া,হুগলী ও দুই ২৪ পরগনার তরুণদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা এবং জলসার ময়দানে মানুষের ভিড়কে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের সঙ্গে জোট করার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কিন্তু সেখানে পাত্তা না পেয়ে, অলিমুদ্দিনে গিয়ে উঠে। এইসব দেখে অনেকেই ভেবে বসল ভাইজান তো বেশ জমে উঠেছে। ৩৪ বছরের শাসক দল বামদের দুর্গে ভাইজানের পদচারণায় ভক্তদের বুক ভরে যায়। এই সবকিছুর মধ্যে ভাইজান এবং তাঁর ভক্তগণ বুঝে উঠতে পারছে না, ‘মাদ্রাসায় সন্ত্রাসী তৈরি হয়’ বলা বুদ্ধবাবুরা মুসলিমদের বন্ধু সাজতে পারে, কিন্ত প্রকৃত দরদি হতেই পারে না। বামেরা তাদের অন্তর্নিহিত কর্মসূচিতে তলে তলে বিজেপিকে ২১শে বাংলার মসনদে বসাতে যে মরিয়া হয়ে উঠেছে তা বুঝেও বুঝতে চাইনা ভক্তগণ। বামেরা ভাইজানকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

ভাইজান মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রাজনীতির ময়দানে নিজের জায়গা তৈরি করতে চায়। মুসলিমদের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে যে, পার্টিতে সব যোগ্য লোক নিয়ে এসে সবকিছু পাল্টে দেবে। কিন্তু রাজনীতির ময়দানে সংগঠন তৈরি করা, ভোটে লড়াই করা আর ধর্মীয় জলসায় বক্তব্য দেওয়ার মধ্যে যে আসমান জমিন পার্থক্য এখন তা তলে তলে বুঝতে পারছেন। কিন্তু এখন যে আর সময় নেই। এক বুক জলে হাবুডুব খেতে খেতে সাঁতার না শিখে জলে নামার ভুল স্মরণ করে লাভ নেই। সংগঠন নেই, যোগ্য নেতা ও কর্মী নেই। জাতীয়তাবাদী ভাবনা নিয়ে ভাইজান যে খামোখা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করছেন তা ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার মাঝে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তিনি নিজেও সিপিএম, সংবাদমাধ্যম এবং জনমানুষের ভিড়ে বুঝে উঠতে পারছেন না যে, আদতে তিনি ক্ষমতা ও কতৃত্বের স্বপ্নে মুসলিম তরুণদের আবেগকে তিলে তিলে শেষ করছেন। বিধানসভায় লড়বেন, বিধায়ক প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছেন না। ৩০ থেকে ২৬শে নেমে আসার কথাও ভেবেছেন। অন্য দল থেকে আসা সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে মজবুত যাকে পাচ্ছেন তাকেই প্রার্থী করছেন। বাচবিচার নেই, থাকবেই বা কি করে, দলে তো আর আসমান থেকে ফেরেশতা আসবে না। আমার ব্লক জগৎবল্লভপুরে প্রার্থী করেছেন সাব্বির আহমেদকে যিনি তৃণমূলের প্রাক্তন যুব সম্পাদক। উলুবেড়িয়া পূর্বে প্রার্থী করেছেন প্রাক্তন তৃণমূল নেতা আব্বাস উদ্দিন খানকে যিনি পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান। সুতরাং দুর্নীতিবাজ মুকুল-শুভেন্দুরা বিজেপিতে গিয়ে যেমন ক্লিনচিট পেয়েছে, আইএসএসএফ-এ ঠিক তারই পুনরাবৃত্তি হলো। এখনো কিছুটা সময় আছে ভাইজান এবং তাঁর ভক্তদের কাছে। মুসলিমদের রাজনৈতিক অধিকারের নামে সাম্প্রদায়িক শক্তির পালে হওয়া দেওয়ার পরিবর্তে ভাইজনের উচিৎ জলসার ময়দানে ফিরে যাওয়া যেখানে তিনি বেশ সাবলীল। রাজনীতি যদি করতেই হয়, তবে জাতীয়তাবাদী ভাবনায় নয় বরং মূল্যবোধের দ্বারাই মুক্তি মিলবে…

 

Leave a Reply

error: Content is protected !!