Thursday, September 19, 2024
শিল্প-সাহিত্য

“উটের দিকে তাকিয়ে দেখেছ, কীভাবে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে?” কোরআনে কেন এমন প্রশ্ন!

গ্রাফিক : সামাউল্লাহ মল্লিক

দৈনিক সমাচার, ডিজিটাল ডেস্ক : মুসলিমদের ধর্মগ্রন্থ হল পবিত্র কোরআন। যদিও তাঁরা ‛কোরআন সবার জন্য’ অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করা হয়েছে বলে দাবি করে। সেই কোরআনের আল-গাশিয়াহ নামের একটি অধ্যায়ে (কুরআনের ভাষায় তাকে সুরা বলা হয়) প্রশ্ন করা হয়েছে, “তাহলে কি এরা উটগুলো দেখছে না, কিভাবে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে?” এখন প্রশ্ন হচ্ছে এতকিছু বাদ দিয়ে ১৪০০ বছর আগে পৃথিবীতে আসা কোরআনে কেন উট কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে সেই প্রশ্ন উত্থাপন করা হল! আসুন উত্তর খোঁজা যাক।

উট প্রকৃতির এক মহাবিস্ময়, এটি ৫৩ ডিগ্রি গরম এবং মাইনাস-১ ডিগ্রি শীতেও টিকে থাকে। মরুভূমির উত্তপ্ত বালির উপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা পা ফেলে রাখে। কোনো জল পান না করে মাসের পর মাস চলে। মরুভূমির বড় বড় কাঁটাসহ ক্যাকটাস খেয়ে ফেলে। দেড়শ কেজি ওজন পিঠে নিয়ে শত মাইল হেঁটে পার হয়। উটের মত এত অসাধারণ ডিজাইনের প্রাণী প্রাণীবিজ্ঞানীদের কাছে এক মহাবিস্ময়।

মানুষসহ বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর দেহের তাপমাত্রা সাধারণত ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের (৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর আশেপাশে থাকে। যদি দেহের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে ৩৮.৫ ডিগ্রির (১০২ ফা) বেশি হয়ে যায়, তখন অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর ক্ষতি হতে থাকে। ৪০ ডিগ্রির (১০৪ ফা) বেশি হয়ে গেলে লিভার, কিডনি, মস্তিষ্ক, খাদ্যতন্ত্র ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৪১ ডিগ্রি (১০৫ ফা) তাপমাত্রায় শরীরের কোষ মরে যেতে শুরু করে।

একারণেই যখন স্তন্যপায়ী প্রাণীদের অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেড়ে যায়, তখন শরীর ঘেমে বাড়তি তাপ বের করে দিয়ে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। কিন্তু উটের জন্য এভাবে জল অপচয় করা বিলাসিতা। কারণ মরুভূমিতে সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ হচ্ছে জল। একারণে উটের শরীরে এক বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। ভোরবেলা এর শরীরের তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি থাকে। তারপর আবহাওয়া যখন প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়, তখন অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা বেড়ে ৪১ ডিগ্রি (১০৪ ফা) পর্যন্ত ওঠে। এর পর থেকে এটি ঘামা শুরু করে। এর আগে পর্যন্ত এটি জল ধরে রাখে। এভাবে প্রতিদিন উট স্বাভাবিক তাপমাত্রা থেকে প্রচণ্ড জ্বরের তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করে। এর শরীরের ভেতরে ব্যবস্থা রাখা আছে, যেন তা দিনের পর দিন ভীষণ জ্বর সহ্য করার পরেও অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোর বড় ধরনের ক্ষতি না হয়।

উটের রক্ত বিশেষভাবে তৈরি প্রচুর পরিমাণে জল ধরে রাখার জন্য। উট যখন একবার জল পান করা শুরু করে, তখন এটি প্রায় ১৩০ লিটার জল, প্রায় তিনটি গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্কের সমান জল, ১০ মিনিটের মধ্যে পান করে ফেলতে পারে। এই বিপুল পরিমাণের জল অন্য কোনো প্রাণী পান করলে রক্তে মাত্রাতিরিক্ত জল গিয়ে অভিস্রবণ চাপের কারণে রক্তের কোষ ফুলে ফেঁপে ফেটে যেত। কিন্তু উটের রক্তের কোষে এক বিশেষ আবরণ আছে, যা অনেক বেশি চাপ সহ্য করতে পারে। এই বিশেষ রক্তের কারণেই উটের পক্ষে একবারে এত জল পান করা সম্ভব হয়।

উটের কুজ হচ্ছে চর্বির আধার। চর্বি উটকে শক্তি এবং পুষ্টি যোগায়। আর জল শরীরের যাবতীয় আভ্যন্তরীণ কাজকর্ম সচল রাখে, শরীরের তাপমাত্রা ঠিক রাখে। একবার যথেষ্ট খাবার এবং জল নেওয়ার পর একটি উট ছয় মাস পর্যন্ত কোনো খাবার বা জল পান না করে টিকে থাকতে পারে।

উট হচ্ছে মরুভূমির জাহাজ। এটি ১৭০-২৭০ কেজি পর্যন্ত ভর নিয়েও হাসিমুখে চলাফেরা করে। এই বিশাল, শক্তিশালী প্রাণীটির মানুষের প্রতি শান্ত, অনুগত হওয়ার কোনোই কারণ ছিল না। বরং এরকম স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রাণীর হিংস্র হওয়ার কথা, যেন কেউ তাকে ঘাঁটানোর সাহস না করে। বিবর্তনবাদীদের বানানো বহু নিয়ম ভঙ্গ করে এই প্রাণীটি কোনো কারণে নিরীহ, শান্ত, মানুষের প্রতি অনুগত হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তা যদি উটকে মানুষের জন্য উপযোগী করে না বানাতেন, তাহলে মরুভূমিতে মানুষের পক্ষে সভ্যতা গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে যেত।

উটের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা হলো কাটা যুক্ত গাছপালা চিবানোর ক্ষমতা, যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। বড় বড় কাঁটাসহ ক্যাকটাস এরা খেয়ে ফেলতে পারে। অন্য কোনো প্রাণী হলে ক্যাকটাসের কাঁটার আঘাতে মাড়ি, গাল, জিভ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেত। কিন্তু উটের কিছুই হয় না। উটের মুখের ভেতরে এক বিস্ময়কর ব্যবস্থা রয়েছে। এর মুখের ভেতরের দিকটাতে অজস্র ছোট ছোট শক্ত আঙ্গুলের মত ব্যবস্থা রয়েছে, যা কাটার আঘাত থেকে একে রক্ষা করে। এমন এক জিভ আছে যা কাঁটা ফুটো করতে পারে না।

উটের চোখে দুই স্তর পাপড়ি রয়েছে। যার কারণে মরুভূমিতে ধূলিঝড়ের মধ্যেও তা চোখ খোলা রাখতে পারে। এই বিশেষ পাপড়ির ব্যবস্থা সানগ্লাসের কাজ করে মরুভূমির প্রখর রোদের থেকে চোখকে রক্ষা করে এবং চোখের আদ্রতা ধরে রাখে। একইসাথে এটি বিশেষভাবে বাঁকা করা যেন তা ধুলোবালি আটকে দিতে পারে।

উপরে বর্ণিত উটের এসব গুণাবলী আজকের যুগের বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানতে পেরেছেন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে কোরআনে ১৪০০ বছর আগেই উট সৃষ্টির প্রশ্ন তুলে উটের গুরুত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পূর্বে বর্ণিত কোরআনের আল-গাশিয়াহ নামের সেই অধ্যায়ে উট সৃষ্টির পাশাপাশি আরও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “তাহলে কি এরা উটগুলো দেখছে না, কিভাবে তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে? আকাশ দেখছে না, কিভাবে তাকে উঠানো হয়েছে? পাহাড়গুলো দেখছে না, কিভাবে তাদেরকে শক্তভাবে বসানো হয়েছে? আর যমীনকে দেখছে না, কিভাবে তাকে বিছানো হয়েছে?” এসবের পর একটি কথা বলে শেষ করা হয়েছে, তা হল – “বেশ (হে নবী – মোহাম্মদ) তাহলে তুমি উপদেশ দিয়ে যেতে থাকো। তুমি তো শুধু মাত্র একজন উপদেশক, এদের উপর বল প্রয়োগকারী নও ৷ তবে যে ব্যক্তি মুখ ফিরিয়ে নেবে এবং অস্বীকার করবে, আল্লাহ তাকে মহাশাস্তি দান করবেন। অবশ্য এদের আমার কাছেই ফিরে আসতে হবে। তারপর এদের হিসেব নেয়া হবে আমারই দায়িত্ব।”

Leave a Reply

error: Content is protected !!