Wednesday, September 18, 2024
গল্প

ছোটগল্পঃ অবনমন

গ্রাফিক : সামাউল্লাহ মল্লিক
 মুহসীন মোসাদ্দেক

পৃথিবীর এ ভাগে আঁধার নেমেছে বহুক্ষণ হলো। রাত এখনো গভীর হয় নি, তবুও নিশ্চুপ এপাড়া ওপাড়া। নিশিপোকাদের গুঞ্জনে নিস্তব্ধতা ভাঙার চেষ্টা। আকাশের বুকে আধখানা চাঁদ ভাসছে, সাদা সাদা ফুলের মতো তারা জ্বলছে পুরো আকাশে। আঁধারকে আড়াল করার প্রাণপণ প্রচেষ্টা চাঁদ-তারার, তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। ভাদ্র মাসের ভ্যাপসা গরমের অস্বস্তি, মশাদের গুন গুন গানের বিরক্তি, সেইসঙ্গে নিজের ভেতরে নিজের সাথেই চাপা দ্বন্দ্ব—জহরের মেজাজ চরমে তুলে দিয়েছে। বারান্দায় বসে উঠোনের দিকে তাকিয়ে আছে জহর, চাঁদের আলো লুটোপুটি খাচ্ছে ওখানে, তাতে তার ভেতরে কাব্যের ভাব জাগছে না মোটেও, চাঁদের আলোর লুটোপুটি খেলা দেখারও আগ্রহ তার নেই—অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে উঠোনের দিকে।

লুঙ্গিটা হাঁটু পর্যন্ত তুলে জহর ল্যাটা মেরে বসে আছে। গায়ের জামাটা হাতে নিয়ে নাড়াচ্ছে একটু পর পরই, তাতে মশা তাড়ানো আর বাতাস খাওয়া দুই-ই হচ্ছে, কিন্তু জহরের অস্বস্তি কিংবা বিরক্তি—কোনোটাতেই প্রলেপ দিতে পারছে না তা। জহরের পায়ের কাছে বসে কুকুরটা কুঁই কুঁই করছে। জহরদের মতো তার পেটেও মাস দুয়েক ধরে ঠিকমতো দানা-পানি পড়ে না। আগে যে খুব পেটপুরে খেতে পারতো তা-ও না, তবে কিছু না কিছু পেটে পড়তো প্রতিবেলায়। গ্রামের এপাড়া ওপাড়ায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে জোটে কেবল লাথি, খবার জোটা অলীক স্বপ্ন। গেরস্থ বাড়িগুলোর সামনে পিছে উচ্ছিষ্ট খাবারও অপ্রতুল আজকাল। মাঝেমধ্যে বাজারের দিকে যায় কুকুরটা। রাস্তার ধারে উচ্ছিষ্ট মেলে কিছু, কিন্তু আশেপাশের কয়েক গ্রামের দুস্থ কুকুর আর বাজার এলাকার দাপুটে কুকুরগুলোর সাথে খাবার ভাগ করে খাওয়া দুষ্কর। অনেক সময় পাত্তাই পায় না, ঝগড়া-ঝাটি করে ফিরে আসে। কুকুরটার কুঁই কুঁই শব্দে মেজাজ আরো চড়ে যায় জহরের। কুঁই কুঁইটা খাবারের বায়না, বুঝতে কষ্ট হয় না জহরের। যেখানে নিজেদের পেটে খাবার জোটে না সেখানে এই কুকুরটার খাবারের বায়না সহ্য হবার কথা না। চোখ গরম করে কুকুরটার দিকে তাকালো জহর, চাঁদের আবছা সাদা আলোতেও কুকুরটা সেটা বুঝতে পেরেই কিনা কুঁই কুঁইয়ের ভলিউম কমিয়ে দিলো।

জহরদের গ্রামটায় বলা চলে দুর্ভিক্ষ চলছে। মানুষের কাজ নাই, আয়-রোজগার নাই, মনসুর ব্যাপারির মতো দুই-চারজনের বাড়িতে ভালো রান্না হয়, বাদ বাকি বাড়ির চুলোয় আগুন জ্বলে না প্রায়ই। অনেকেই গ্রাম ছেড়েছে রোজগারের ধান্দায়, কেউ টিকে গেছে, কেউ শূন্য হাতে ফের ফিরেছে গ্রামে। জহর কোথাও যায় নি, গ্রামে থেকে গেছে। বছর খানেক ধরে যুদ্ধ করে টিকে আছে কোনোমতে। মাঝেমধ্যে কোনো কাজ পেলেও স্থায়ী হয় না, বেশিরভাগ সময় কাজ ছাড়াই দিন কাটাতে হয়। তবুও আধ-পেট খেয়ে দিন চলে যাচ্ছিল, কিন্তু মাস দুয়েক থেকে অবস্থা খুবই খারাপ। কোনো কূলেই কেউ নেই জহরের। বাপ-মা মরেছে বহু আগে। মরে-টরে ভাই-বোন যারা ছিল তারা সবাই নিরুদ্দেশ। বাপের এই ভিটাটাই কেবল তার সম্পত্তি। তিনটা ছেলেমেয়ে নিয়ে একটা ঘরে রাহেলার সঙ্গে তার সংসার এ ভিটায়। বন্ধু বরকতের মতো দিন-রাত বউকে পিটিয়ে যে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে চাপ দেবে, সে উপায়ও নেই জহরের। প্রথম কথা, বউকে খুব ভালোবাসে সে। দ্বিতীয় কথা, বউকে পিটিয়ে মেরে ফেলে দিলেও বাপের বাড়ি থেকে কিছু এনে দিতে পারবে না। বাপের কূলে কিছু থাকলে তো তা এনে স্বামীকে দেবে!

রাহেলা বায়নাটা ধরে মাঝেমধ্যেই, ‘তোমার দোস্তো সালাম তো শহরে যায়া নাকি ম্যালা কামাইতেছে। বউ-বাচ্চারেও নিয়া গ্যালো। আমরাও যাই না চলো!’ জহর সায় দেয় না। এক সালাম না হয় টিকতে পেরেছে, কাছের বন্ধু বরকত, পুব পাড়ার রহিম, মজনু, আরো কতোজনই তো শহরে গেলো। ফিরলো তো খালি হাতে। বরকতের শালা হালিম তো অ্যাকসিডেন্ট করে লুলা হয়ে ফিরেছে।
‘কী হইবো শহরে যায়া! শহরে কাম পাওয়া অতোই সুজা! বরকইত্যা তো গ্যালো, হের কাছে শুনোস নাই শহরে কাম করা কেমন ঠাপ!’ রাহেলা চেপে যায়। ‘ভিটে আছে, একখান ঘর আছে, ঠেইলা ঠুইলা চইলা যাইবো।’ জহরের কথা মেনে নেয় রাহেলা।
কিন্তু মাস দুয়েক যে অবস্থায় দিন কেটেছে তাতে একবার শহরে যাবার কথা ভেবেছিল জহর। কী ভেবে শেষে আর পা বাড়ায় নি।

জামাটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে জহর উঠে দাঁড়ায়। লুঙ্গির পুরনো গিঁট খুলে নতুন করে বাঁধে। উঠোনে হাঁটে, পিছে পিছে হাঁটে কুকুরটাও। ভয়ে ভয়ে দুই-একবার কুঁই কুঁই করে। উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকায় জহর। কোনো কারণ নেই তবুও চাঁদটাকে দেখে গা জ্বলে যায় জহরের, ভেতরের দ্বন্দ্বটা চাড়া দিয়ে ওঠে, মেজাজ নিয়ে তাকায় চাঁদের দিকে। চাঁদের সাথে চোখ রাঙানির পর্ব শেষে জহর একটু এগোয় সামনের দিকে। চাপা স্বরে কুঁই কুঁই করতে করতে কুকুরটাও এগিয়ে যায়। উঠোনের এই জায়গায় বড় একটা কড়ই আর একটা নিমগাছ ছিল পাশাপাশি। গত বছর গাছ দুটো বিক্রি করে বাজারে চা-পানের একটা দোকান দিয়েছিল জহর। যে গ্রামে মানুষের আয়-রোজগারে টানাটানি, বেশিরভাগ বাড়িতে চুলো জ্বলে না প্রায়ই সে গ্রামে চা-পানের দোকানে বেচা-বিক্রি আর কেমন হবে! মাস দুয়েকের ভেতরে দোকান গুটিয়ে নিতে হয়েছে। মাঝখান থেকে গচ্চা গেছে বেশ কিছু টাকা।

বিক্রি করার মতো আর কোনো গাছ নেই এ ভিটায়। একটা বরইগাছ আছে, টকের ঠেলায় পাখিও ছোঁয় না এ গাছের বরই। বেশ কয়েকটা পেঁপেগাছ আছে। আর এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে কচুগাছ। কাঁচা পেঁপে আর কচু পাতা সেদ্ধ দিয়েই গত কিছুদিন আহার চলছে জহরদের। পেঁপে আর কচু গাছেরা জহরদের আহারের যোগান দিতে দিতে ক্লান্ত! এমন করে আর কয়দিন চলা যায়! পাড়া-পড়শির দ্বারে গেলেও একমুঠো ভাত জোটে না। পাড়া-পড়শিরই কি জোটে! মনসুর ব্যাপারির মতো যারা এই আকালেও ভর-পেটে নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে তারা যেন এখন ভিনগ্রহের বাসিন্দা, নাগাল পাওয়াই ঠ্যালা! জামার পকেট হাতড়ে দোমড়ানো-মোচড়ানো একটা বিড়ি পায় জহর। বিড়িটা ধরিয়ে টান দেয়, ভাব নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ে। অস্বস্তি একটু কমে আসে এবার। কুকুরটা কুঁই কুঁই করে জহরের পা চাটতে শুরু করে। জহরের ইচ্ছে হয় লাথি মেরে পেটের ভুঁড়ি বের করে দেয়! কিন্তু মারে না। কুকুরটার কী দোষ? ছেলেমেয়েগুলোকে বরকতের বাড়িতে রেখে না আসলে ওরাও হয়তো রাতভর খাবারের বায়নায় পিছে পিছে ঘুরতো! আজকের রাতটার জন্য ছেলেমেয়েগুলোকে বরকতের বাড়িতে রেখে এসেছে জহর। নিশ্চয় একমুঠো মুড়ি হলেও পেটে পড়েছে ওদের। হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে কুকুরটাকে আদর করতে থাকে জহর। জন্মের পর থেকে খাইয়ে-আদর দিয়ে জহরই বড় করে তুলেছে কুকুরটাকে। আদর করে কুতু বলে ডাকে। কুকুরটা জহরের আরেকটা সন্তানই যেন! আদর পেয়ে কুতুর কুঁই কুঁইয়ের ভলিউম বেড়ে যায়, আরো ঘেঁষে আসে জহরের কাছে। জহর কুতুকে আদর করতে করতে ফিসফিস করে বলে, ‘আইজকার রাইতটাই রে কুতু। একটা রাইতেরই ব্যাপার।’ কুতু আরো জোরে কুঁই কুঁই করে ওঠে।

সকালে একবস্তা চাল পাবে জহর। সকাল থেকে আবার ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত খেতে পারবে বাচ্চাদের নিয়ে, রাহেলাকে নিয়ে, কুতুকে নিয়ে। মনসুর ব্যাপারি জহরকে একবস্তা চাল দেবে কাল সকালে, মাগনা অবশ্য দেবে না, মাগনা কে-ই বা দেয়! দাম দিতে হবে। সে দাম জহরের ঘরেই আছে। একটা রাত কেবল চেয়েছে ব্যাপারি। রাহেলা প্রথমে অবশ্য রাজি ছিল না। বিড়ি টানতে টানতে জহর সংশয়-দ্বিধার কয়েকপর্ব পেরিয়ে কথাটা বলতেই রাহেলা প্রতিবাদ করেছিল, ‘এ আমি পারবো না গো! এমন সর্বনাশা কথা আর মুখেও আইনো না!’ জহর খেঁকিয়ে উঠেছিল, ‘তাইলে কি করবি, না খায়া মরবি!’ ‘তাই বইলা ইজ্জত বেচতে কও!’
‘ইজ্জত! গরিবের আবার কীসের ইজ্জত! পেটে ভাত না জুটলে ইজ্জত দিয়া কী করবি!’ বিড়িতে লম্বা টান দিয়ে কায়দা করে ধোঁয়া ছেড়ে জহর আদেশের ভঙ্গিতে বলে, ‘সন্ধ্যার পর আইবো। ঝামেলা করবি না। একটা রাইতেরই ব্যাপার। সব ঠিকঠাক রাখবি।’ রাহেলা জবাব দেয় না, মাথা নিচু করে বসে থাকে—সম্মতি অসম্মতি কিছুই বোঝা যায় না তাতে।

জহরের কুঁড়েঘরে দরজায় খিল লাগিয়ে মনসুর ব্যাপারি এখন রাহেলাকে নিয়ে ব্যস্ত। ব্যাপারি দরজার খিল লাগানোর পর থেকেই নিজের ভেতরে দ্বন্দ্বটা শুরু হয়েছে জহরের, অস্বস্তির দাপাদাপি বাড়তে থাকে—বউয়ের ইজ্জতের দামে একবস্তা চাল কেনা কি ঠিক হলো! দ্বন্দ্বটা প্রশমনের চেষ্টা করে জহর—পেটে ভাত না জুটলে ইজ্জত দিয়ে কী হবে! গরিবের বউ টাকাওয়ালা ব্যাপারির সাথে এক-দুই রাত কাটালে এমন কিছু ইজ্জত যায় না! বারান্দায় এসে বসে জহর। থু করে একদলা থুতু ফেলে বিরক্তিতে। বিরক্তিটা কার প্রতি জহর নিজেই জানে না!

একথালা গরম ভাত জহরের সামনে। ভাত থেকে সাদা ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে উঠে আসছে। গরম ভাতের ঘ্রাণ পাচ্ছে জহর। ঘ্রাণটা বড় অচেনা লাগছে জহরের। গরম ভাতের ঘ্রাণ সে অনেকদিন পায় না। কয়দিন হবে? দশ, বারো না তেরো দিন, নাকি তারও বেশি? হিসাবটা ঠিক মনে পড়ে না, জহর অবশ্য মনে করার চেষ্টাও তেমন করে না। ঝরঝরে দানার ভাতগুলো নাড়তে থাকে জহর, মুখে তুলতে পারে না, কেমন যেন অরুচি লাগে। ভাতের ঘ্রাণটাও তার কাছে কেমন কেমন লাগে, কেমন যেন একটা দুর্গন্ধ লাগে তার! কেন এমন লাগে বোঝে না জহর। বোঝার চেষ্টাও অবশ্য করে না!

একপাশে রাহেলা বসে আছে। কোনো কথা বলছে না। কেবল তাকিয়ে আছে জহরের ভাতের থালার দিকে। সেখানে জহরের আঙুলগুলো ভাতের দানা নিয়ে খেলছে। কিন্তু একটা দানাও মুখে উঠছে না! উঠোনে বসে কুতুও খাচ্ছে। ভাতের মারের সাথে গরম ভাত গপাগপ গিলছে কুতু। সেদিকে নজর পড়ে জহরের। জহরের মতো কুতুও পেটপুরে খাওয়ার সুযোগ পেলো বেশ কয়েকদিন পর। খাবার পেয়ে সে কোনোদিকে তাকায় নি, কোনো কিছু ভাবেও নি। খাবার কোথায় থেকে এলো, কীভাবে যোগাড় হলো তাতেও সে ভ্রূক্ষেপ করে নি। গপাগপ গিলতে শুরু করেছে। এসব বিষয় বিবেচনা করার মতো বোধ কুকুর সম্প্রদায়ের নেই-ও।

জহর বুঝতে পারে এখন তাকে কুতুর মতো হতে হবে। বোধ-বুদ্ধিগুলোকে কুতুর পর্যায়ে নামিয়ে নিতে হবে। যেখানে কপালে একমুঠো ভাত জোটে না সেখানে ভাতের থালা সামনে রেখে আত্মসম্মান ও অপরাধবোধ নিয়ে ভাবার, অনুশোচনায় পোড়ার কিংবা ভাতটুকু কীভাবে যোগাড় হলো সে ঘটনা হাতড়াবার যৌক্তিকতা কতোটুকু! ক্ষুধার জ্বালার কাছে মান-ইজ্জত সবই তুচ্ছ! জহর মুখে ভাত তুলে নেয়। গপাগপ গিলতে থাকে কুতুর মতো!

Leave a Reply

error: Content is protected !!