আফরিদা খাতুন আঁখি : নভেম্বরের শীতে জামিয়া কন্যাদের হুংকারে ভারত নামক দেশটির জীর্ণ হৃদয়ে জীবনের উষ্ণতার আলো জ্বলে উঠেছিল কয়েক শতক পর। দেশের কোণায় কোণায় বীরাঙ্গনারা নিজেদের বুকে আলো জ্বেলে জন্ম দিয়েছিল শত শত শাহীনবাগ। কাপুরুষ, সৈরাচারীদের রাঙা চোখ উপেক্ষা করে দেশ যেন মেতেছিল আজাদীর নেশায়। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, বাংলা থেকে বিহার, অসম থেকে মণিপুর সর্বত্র মুখরিত হয়েছিল আজাদীর শ্লোগানে। ডিসেম্বরের শীতলতাও সেদিন আপন হাতে এই দেশকে সাজিয়ে ছিল বসন্তের সাজে, দেশের প্রতি অঙ্গে লাগিয়েছিল মুক্তির আবির। আজাদীর লড়াই সেদিন ‛বিন্দি-হিজাব’ পরিধান করে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে দিয়েছিল আবার জেগে ওঠার আনন্দ।
আজ থেকে একশো দিন আগে দিল্লির শাহীনবাগ-এর না হার মানার লড়াইয়ে উজ্জীবিত হয়ে তিলোত্তমার বুকের পার্কসার্কাসে জ্বলেছিল আজাদীর আলো। আসমাত জামিলের উৎসাহে বেশ কিছু নারী সেইদিন তিলোত্তমার বুকে দেশের দ্বিতীয় ধর্ণা মঞ্চের জন্ম দিয়ে এই আন্দোলনকে দিয়েছিলেন ‛দ্বিতীয় স্বাধীনতার আন্দোলন’ এর সম্মান। শত বাধা সত্বেও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ গুটি কয়েক অবগুণ্ঠিত নারী সেদিন এই নগরের বুকে প্রথম জন্ম দিয়েছিলেন শাহীনবাগের আদর্শকে। অনেকটা ঠিক মায়ের মত তাঁদের লালনপালনে আজাদীর আদর্শ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে লাভ করেছিল পরিপূর্ণতা। বিশ্ব অবাক হয়েছিল ঘোমটার অন্তরালে তাঁদের শক্তিকে দেখে। আর এই ময়দানেরই প্রতিটি কোণে এখনো বেঁচে আছে আজাদীর আন্দোলন প্রথম মহিলা শহীদ সামিদা আম্মির না হার মানার সাহস।
পার্কসার্কাস যেন ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছিল উৎসব মুখর। জাতি ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে প্রভুর আস্থাকে বুকে ধারণ করে তাঁরা হয়ে উঠেছিলেন একেকজন প্রকৃত দেশের সেনানী, সংবিধানের পাহারাদার। হাজার হাজার নারীর বুকের ভিতর সৃষ্টি সেই মারাত্মক শক্তিকে কাছ থেকে না দেখলে হয়তো উপলব্ধি করা সম্ভবপর হত না। ধর্ণা মঞ্চে হিন্দুদের সহকারী হয়ে উঠেছিলেন মুসলিমরা, মুসলিমদের সহচারী হয়ে উঠেছিলেন হিন্দুরা। কারোর হৃদয়ে ছিল না কোন দ্বেষ কোন সংকীর্ণতা। অচেনা হৃদয়গুলো গুলো কী বিস্ময়করভাবে মিলেমিশে হয়েছিল একাকার।
সাধারণ কয়েকটা নারীর শুরু করা লড়াইয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে এসে পা মিলিয়ে ছিলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা। কখনো অতুল প্রসাদ সেনের বৃদ্ধ কণ্ঠে ফুটে ওঠা ‛আমি বাংলার গান গাই’ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল ধর্ণা মঞ্চে অবস্থিত প্রাণ গুলো। আবার কখনো কবির সুমন আর তাঁর গীটার ধুনে মেতেছিল পার্কসার্কাসের বাতাস। রত্নাদির ক্লান্ত হীন শ্লোগান সতেজ করে রেখেছিল বীরাঙ্গনাদের। আবার কখনো বাঙালি কন্যাদের মঞ্চে উপস্থাপন করা ভাষা দিবসের আবেশে হিন্দি ভাষীরাও হয়ে উঠেছিল আবেগপ্লুত। একদিকে মুখরিত ছিল আইনের ছাত্রী শাফকাতের সাহসী স্লোগানে অন্যদিকে সকলে সমস্বরে চিৎকার করেছিল ছোট্ট বীরাঙ্গনার ‛ইসলামোফোবিয়া’ স্লোগান। কখনো জামিয়ার কন্যারা পার্কসার্কাসে উপস্থিত হয়ে বৃদ্ধি করেছিল সাহস আবার কখনো শাহীনবাগের দাবাং দাদীরা বাড়িয়েছিল মনোবল। আবার কোন এক সকালে গান্ধীজীর বর্তমান বংশধর উপস্থিত থেকে অঙ্গীকার করেছিলেন পাশে থাকার আবার কখনো আদিবাসীরা তাদের নৃত্যের তালে তালে সাহস যুগিয়েছিল আজাদীর লড়াই এ থেমে না থাকার। সব মিলিয়ে পার্কসার্কাসের শিরায় বয়ে যাওয়া আজাদীর আবেগে কখনো ভাঁটা পড়েনি।
ধর্ণা মঞ্চে উপস্থিত শিশুদের নির্মল অথচ প্রাণবন্ত ক্রিয়াকলাপ দেখে মনে হত প্রত্যেকের ভিতরে যেন সমগ্র দেশটা ঘুমিয়ে আছে। কখনো তারা রঙিন হয়ে উঠতো ত্রিরঙা আবির রঙে আবার কখনো উজ্জীবিত হতো আজাদী স্লোগানে আবার কখনো মেতে উঠতো গান অথবা কবিতাতে। ময়দানে উপস্থিত সাধারণ শিশু গুলোর অসাধারণ হয়ে ওঠার তেজ দেখে আমার মতো যুবতী অথবা যুবক অবাক হয়ে যেত। আজাদীর উৎসবে মেতে ওঠা এই মঞ্চে কত সম্ভাবনার যে সমরহ ঘটতো প্রতিনিয়ত তা বুঝি নিজ চোখে না দেখলে জানায় হতো না। আর উপস্থিত নারীরা কেও কারোর পর ছিলনা ধনী গরিব, উচ-নীচ সব বাধা ভেঙে কে হয়ে উঠতো মায়ের সমান কেও হয়ে উঠতো বোনের সমান। সমস্ত ক্লান্তি, ভয়কে ঝেড়ে ফেলে তাঁরা হয়ে উঠে ছিলেন গৃহকর্মে নিপুণা দেশকে সুস্থ করে তোলার সেবিকা।
পার্কসার্কাসের আজাদীর ডাইরি তে পুরুষরাও কিন্তু খোদাই করেছেন তাঁদের নাম। পুরুষরা হয়ে উঠেছিলেন বীরাঙ্গনাদের আত্মমর্যাদা, পবিত্রতার পাহাড়াদার। বীরাঙ্গনাদের সমস্ত রকম ভাবে নিরাপদ রাখতে যেমন একদল যুবক হয়ে উঠেছিল রাত জাগা পাহারাদার ঠিক তেমনভাবে অর্থবান পুরুষেরা যুগিয়েছিলেন বীরাঙ্গনাদের বেঁচে থাকার জন্য আহারে সমগ্রী।
পার্কসার্কাস ময়দানে উপস্থিত প্রতিটি মা-বোন দাঁতে দাঁত চেপে কসম খেয়েছেন এ দেশকে ভালো রাখার, ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকে থাকে প্রতিটি মানুষের সব হারানোর ব্যাথা কে উপশম করার, শাসকের বিষ দাঁত গুঁড়িয়ে দেওয়ার। অনেক দূষিত প্রাণ হয়তো উল্লাসিত হয়েছে ধর্ণা মঞ্চ থেকে তাদের ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দেখে। কিন্তু তাদের মনে রাখা দরকার শত শত বীরাঙ্গনারা সেদিন করোনা আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে ফিরে যাননি, তাঁরা ফিরে গিয়েছিলেন দেশকে ভালো রাখার জন্য কারণ তাঁরা ছিলেন দেশ মেরামতের কারিগর। আমার বিশ্বাস অবস্থা স্বাভাবিক হলে তাঁরা ঠিকই ফিরবেন, হ্যাঁ তাঁরা ফিরবেন দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে।
প্রার্থনা করি সুস্থ হয়ে উঠুক এই পৃথিবী, লড়াই এখনও যে বাকী। সুস্থ হয়ে উঠুন আমাদের সবার প্রিয় আসমাত মা জী, কারণ এই লড়াইয়ের অন্তিম পর্যন্ত তাঁকে যে আমাদের চাই। বেঁচে থাকুক পার্কসার্কাস কারণ এবার ফুরিয়েছে ফিরে আসার গল্প। জীবন্ত থাকুক শামিদা আম্মির ত্যাগ কারণ এবার আজাদীটা অবশ্যই আনা চায়।
লেখিকা: রিসার্চার, সোসিও এডুকেশনাল রিসার্চ সেন্টার (সার্ক)