আফরিদা খাতুন আঁখি
“একটি ফটোগ্রাফ একটি গোপন বিষয় সম্পর্কে একটি গোপন বিষয়। এটি আপনাকে যত বেশি বলবে, আপনি তত কম জানেন” – ডায়ান আরবস।
বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস, যার সূত্রপাত ঘটে ১৮৩৭ সালে প্রথম ফটোগ্রাফিক প্রক্রিয়া ‛ডাগুয়েরিওটাইপ’-এর মাধ্যমে। যা ফরাসি বাসিন্দা লুই ডাগুয়েরে এবং জোসেফ নাইসফোর নিপ্পেস দ্বারা আবিষ্কৃত হয়। ফেব্রুয়ারী ৯, ১৮৩৯ সালে ফরাসী বিজ্ঞান একাডেমি এই প্রক্রিয়াটি ঘোষণা করে এবং পরে একই বছরে ফরাসী সরকার ১৯ আগস্ট এই আবিষ্কার উদ্দেশ্যে পেটেন্ট কিনে ‛Free to the World’ নামে একটি উপহার হিসাবে দান করে। এই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতি বছর ১৯ আগস্ট বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবস বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প ও ফটোগ্রাফির শৈলীর বার্ষিক বিশ্বব্যাপী উদযাপন করা হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় একটি ছবি হাজার কথার থেকে অধিক মূল্যবান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। একটি ছবি একটি সম্পূর্ণ যুগের হাসি-কান্না সহ নানান ঘটনা তার বুকের ভিতর ধারণ করে বয়ে নিয়ে চলে। পরিচয় ঘটায় এক যুগের সাথে আর এক যুগের।
আজ এই বিশ্ব ফটোগ্রাফি দিবসের দিন লন্ডনের বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার পিটার স্যাণ্ডার্সের কথা না উল্লেখ করলে কোথাও যেন একটা অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। ৬০-এর দশকের মাঝামাঝি হলিউড জগৎ কাঁপানো পিটার স্যাণ্ডার্সের জন্ম লণ্ডনে, তাঁর ক্যামেরার লেন্সে একে একে ধরা পরে বব ডেইলান, জিমি হ্যানড্রিক্স, জিমি মরিসনের মত বিখ্যাত তারকাদের ছবি। কিন্তু ষাটের দশকের হলিউডের ‘রক এণ্ড রোল’ এই ফোটোগ্রাফারের সত্তরের দশকে এসে চিন্তনের বদল ঘটে। তাঁর ক্যামেরার রিভার ভিউ হলিউড সহ জগৎ এর সমস্ত জাঁকজমক ছেড়ে খুঁজে ফেরে ভিন্ন ধরনের কোন এক জিনিস, যা এই পার্থিব জগতের আড়ম্বরের মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। পিটারের এই খোঁজই তাঁকে সন্ধান দেয় আলোর, যেই আলোতে পরিপূর্ণ হয়েছিল তাঁর হৃদয়, পরিশুদ্ধ হয়েছিল তাঁর আত্মা।
১৯৭০ দশকে পিটার স্যাণ্ডার্সের ক্যামেরাই তাঁকে হাজির করিয়েছিল ইসলাম নামক প্রশান্তির মরুদ্যানে। ১৯৭১ সালে তিনি হজ্বে যাওয়ার সুযোগ পান এবং সেখানে তিনি ক্যামেরা ব্যবহারের অনুমতি পান, ১৯৭১সালে তাঁর ক্যামেরাতে বন্দি পবিত্র কাবা গৃহের দরজার চিত্র পশ্চিমা সহ সমগ্র বিশ্বে বিখ্যাত হয়ে ওঠে যা তৎকালীন সময়ে সানডে টাইমস ম্যাগাজিন, দ্যা অবজারভার সহ বেশ কিছু বিখ্যাত পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। এরপর তাঁর ক্যামেরাই হয়ে ওঠে ইসলামের প্রতি তাঁর ভালোবাসা নিবেদন একমাত্র মাধ্যম।
ইতিহাসের গর্ভে লুক্কায়িত ইসলামি স্থাপত্যকে তিনি এই জগৎ এর সামনে আবার হাজির করেন, যার নামকরণ করেন In the Shade of the Tree (২০০৭)। শুধুমাত্র ইসলামের স্থাপত্য নয়, জগৎ এর সমস্ত ব্যস্ততা,আড়ম্বর ছাড়িয়ে ইসলামের পবিত্রতা ও হয়ে ওঠে তাঁর ক্যামেরার মূল কেন্দ্রবিন্দু, যা প্রকাশিত হয় The Art of Integration (২০০৮), Meetings with Mountains (২০১৯)। এরপর তিনি আয়োজন করে চলেছেন একের পর এক এগ্সিবিজান, ট্রেনিং দিয়ে চলেছেন তরুণ ফটোগ্রাফারদের। বর্তমানে পিটার স্যাণ্ডার্সের হলেন সমগ্র বিশ্বের কাছে উল্খেযোগ্য ব্যক্তিত্ব, আমেরিকান লেখক মাইকেল সুগিচের মতে, ‛তিনি একটি অসাধারণ সময় এবং একটি সমৃদ্ধ এবং চিত্তাকর্ষক সংস্কৃতির একটি অবর্ণনীয়, কাব্যিক এবং ছদ্মবেশী রেকর্ড রেখে গেছেন।’
পিটার স্যাণ্ডার্স তাঁর পঞ্চাশ বছরের এই পেশায় তিনি বন্দি করেছেন অগণিত মূহুর্ত, যে সব মূহুর্তরা ছিল পবিত্রতাতে সিক্ত। তাঁর কাছে ফটোগ্রাফি ছিল তাঁর জীবনের অঙ্গ, তাঁর মতে “ফটোগ্রাফি একটি দুর্দান্ত মাধ্যম – প্রভুর দেওয়া উপহার – যা আমাকে নিজের এবং আমার চারপাশের বিশ্ব সম্পর্কে অনেক কিছু জানাতে সাহায্য করেছিল।”
এই ধরাতে জন্মানো প্রতিটি মানুষের মধ্যে প্রভু প্রদত্ত কিছু না কিছু প্রতিভা লুক্কায়িত রয়েছে। কেবলমাত্র চিকৎসক,শিক্ষক অথবা ধর্মগুরু হয়েই যে মানব সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা এবং এর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন পিটার স্যাণ্ডর্স। কলম, ক্যামেরা সহ আরো ভিন্ন জিনিসের মাধ্যমেও এই সমাজ তথা মানবতা তথা স্রষ্টার সেবা করে যায়। আমাদের প্রতিটি ব্যক্তির কাজ হলো আমাদের মধ্যে লুক্কায়িত সেই প্রতিভা খোঁজা এবং তাকে সঠিক পথে ব্যবহার করা। স্রষ্টা প্রদত্ত প্রতিভার তাঁর সৃষ্টির কল্যাণের জন্য ব্যবহার না করা ও একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বটে।
লেখিকা: রিসার্চার, সোসিও এডুকেশনাল রিসার্চ সেন্টার (সার্ক)