নিজস্ব সংবাদদাতা, দৈনিক সমাচার, কলকাতা: চলতি বছরের আগামী মাস থেকে সরকার পরিচালিত মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা করেছেন আসামের শিক্ষা মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। সেইসঙ্গে এ সকল মাদ্রাসায় আর্থিক সহায়তা বন্ধের কথাও তিনি বলেছেন। মাদ্রাসা নিয়ে অসম সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করলেন সংখ্যালঘু মুসলিম নেতারা। তাদের মতে, সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যালঘুরা নিজেদের সংস্কৃতি রক্ষা করে নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়তে পারে, সেক্ষেত্রে সরকার সব রকম সহযোগিতা করবে। এদেশে খ্রিস্টান পরিচালিত, মুসলিম পরিচালিত বহু প্রতিষ্ঠান আছে যেটা সংখ্যালঘু মর্যাদাপ্রাপ্ত এবং সরকার শিক্ষকদের বেতন দেয়।
আসাম সরকারের মাদ্রাসা নিয়ে সিদ্ধান্ত জানার পর ওই রাজ্যের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে জামাআতে ইসলামী হিন্দের কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্ষদ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া বিবৃতিতে নিন্দা জ্ঞাপন করেছে। পর্ষদের চেয়ারম্যান নুসরাত আলি বলেন, একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতির অধীনে শিক্ষার সার্বজনীনতা এবং সামাজিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাদপদ শ্রেণির সঙ্গে সংযুক্ত করার কথা সরকার বলছে, আর অন্যদিকে আসামের বিজেপি সরকার মাদ্রাসাগুলিতে আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে মুসলিম বিরোধী নীতিকে গ্রহণ করছে। করোনো মহামারীর সময় কেন্দ্র সরকার একটার পর একটা জনস্বার্থ বিরোধী আইন পাশ করার পদক্ষেপ নিয়েছে, একইভাবে আসামের বিজেপি সরকার জনস্বার্থ বিরোধী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে।
এটিকে সরকারের নিন্দনীয় কার্যকলাপ বলে অভিহিত করে নুসরাত আলি রাজ্য সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্তের জন্য হাজার হাজার মাদ্রাসা পড়ুয়াদের পড়াশোনায় ছেদ পড়বে । সেইসঙ্গে শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীরা চাকরি বিহীন হয়ে পড়বেন। এই প্রসঙ্গে জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন, কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রক এবং কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রকের উচিত আসাম সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আসাম সরকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করুক এই দাবি জানিয়েছে জামাআত। নুসরাত আলি বলেন, জামায়াতের কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্যদ সকল প্রকার গণতান্ত্রিক ও আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যাতে মাদ্রাসাগুলি সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত নাহয়।
তিনি আরো বলেন, আসামের শিক্ষা মন্ত্রী বলেছেন যে ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকার আর্থিক সহায়তা দিতে পারে না। স্মরণীয় যে প্রায় শতাব্দীকাল ধরে আলিয়া সিস্টেমের মাদ্রাসা সরকারি আর্থিক আনুকুল্য পেয়ে আসছে। বর্তমান আসাম সরকার একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে টার্গেট করে রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। মাদ্রাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে বলেন, নতুন নতুন সমস্যা তৈরি না করে বরং রাজ্যের সমস্যাগুলির সমাধানে সরকার নজর দিক।
শুধু জামাআতের কেন্দ্রীয় নেতা নন, বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সংগঠন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংখ্যালঘু যুব ফেডারেশনের রাজ্য সম্পাদক মুহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন,’সাংবিধানিক অধিকার মোতাবেক দেশের বিভিন্ন রাজ্যে সংখ্যালঘু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা মাদ্রাসা চলছে। আসাম সরকার যে পদ্ধতিতে মাদ্রাসা তুলে দিতে চাইছেন, সেটা সাংবিধানিক বিধির পরিপন্থী। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো সরকার এভাবে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে পারেনা।
জামায়াতে ইসলামী হিন্দের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি মাওলানা আব্দুর রফিক বলেন, অসম সরকার মাদ্রাসার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা অসমের ঐতিহ্য বিরোধী। অসমে প্রায় ১১ হাজার মাদ্রাসা আছে তার মধ্যে প্রায় হাজারখানেক সরকারি মাদ্রাসা আছে। মাদ্রাসা ব্রিটিশ জামানা থেকে আছে। মাদ্রাসা অর্থ বিদ্যালয়। সংখ্যালঘু মুসলিমরা যাতে কৃষ্টি সংস্কৃতি বজায় রেখে শিক্ষার্জন করতে পারে তার জন্য মাদ্রাসা। মাদ্রাসা বন্ধ করে দিলে হাজার হাজার যে জমি মুসলিমরা দান করেছে তার কী হবে? তাছাড়া মাদ্রাসায় শুধু মুসলিমরা পড়াশোনা করে না,অমুসলিমরাও পড়াশোনা করে। সংখ্যালঘু প্রান্তিক মানুষদের শিক্ষার সুযোগ করে দিতে আসাম সরকারকে মাদ্রাসার পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে।
জমিয়তে আহলে হাদিসের রাজ্য সম্পাদক আলমগীর সরদারের মন্তব্য,’আসাম সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও সংবিধান বিরোধী। নানা ভাষা নানা মতের ভারতবর্ষকে আজ গৈরিকীকরণের অপচেষ্টায় মেতে উঠেছে বর্তমান সরকার। যার ফলে দেশ আজ বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। দেশে হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও বেছে নেওয়া হয়েছে বিশেষ এক সম্প্রদায়কে, বিভিন্ন ঘটনায় তাদেরকে বলির পাঠা করা হচ্ছে, তারই একটি অংশ হিসেবে আসামে মাদ্রাসা শিক্ষাকে বন্ধ করা। বর্তমান মাদ্রাসাগুলিতে আধুনিক শিক্ষার সাথে সাথে নামমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়। বর্তমান সরকার সেটাও চাইছে না। আমরা সরকারের কাছে মাদ্রাসা শিক্ষা যাতে বন্ধ না হয় তার অনুরোধ জানাই।
যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আব্দুল মতিন বলেন,’ভারতের সংবিধানে মাদ্রাসা ও সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার কথা বলা আছে। তাই অসম সরকারের এই প্রস্তাব সংবিধান ও দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বিরোধী।
উল্লেখ্য আসামে সরকারি মাদ্রাসা ও টোল বন্ধের সিদ্ধান্তের আগেই সমালোচনা করেছেন আসাম রাজ্যের কংগ্রেস নেতা শামসুদ্দিন বড় লস্কর। অল ইন্ডিয়া জমিয়তে মিল্লাতে ইসলামিয়ার সভাপতি মাওলানা সাহিদ আহমদ আল কাসেমী আগেই বলেছেন, মাদ্রাসায় শিক্ষা বন্ধ করার ঘোষণা নোংরা রাজনীতি ছাড়া কিছুই নয়।
এদিকে মাদ্রাসা ও সংস্কৃত টোল বন্ধের ঘোষণা ‘অসাংবিধানিক’ বলে মনে করছেন আসামের বহু শিক্ষক। তারা মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার এই ঘোষণার সমালোচনা করেন। অসম মাদ্রাসা সমন্বয় রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই প্রতিবাদ জানিয়েছে। বদরুদ্দিন আজমলের এআইইউডিএফও মাদ্রাসা নিয়ে রাজনীতির সমালোচনা করেছেন।