সামাউল্লাহ মল্লিক : বর্তমান সমাজে সহানুভূতির বদলে সমানুভূতির প্রয়োজন রয়েছে। ঠান্ডা ঘরে বসে নীতি নৈতিকতার জ্ঞান বিতরণকারীদের মাঝেই সমানুভূতি লোপ পেয়েছে। নীতি তৈরীর সময় তাঁরা পরিসংখ্যানের খোঁজ করেন, অনুভূতি নিয়ে তাঁদের আর কাজ কী? সমানুভূতি অর্থাৎ, নদী, পাখি, শিশুদের জায়গায় নিজেকে দাঁড় করিয়ে তাঁদের মতো করে ভাবা। একটি শিশু খুন হয়েছে আর আমার বাচ্চাকে খুন করে দেওয়া হয়েছে, এই দুই ঘটনায় কি কোনও পার্থক্য আছে? একটা ঘর আগুনে ভষ্ম হয়ে গেছে এবং আমার ঘর আগুনে ভষ্ম হয়ে গেছে। এই দুই ঘটনার মধ্যেও কি কোনও পার্থক্য আছে? ১০ বছর বয়সী একটি মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ও আমার দশ বছর বয়সী মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে এতেই বা পার্থক্য কোথায়? এই পার্থক্য বুঝতে হলে একটু এক্সপেরিমেন্ট করা জরুরী। এধরণের কোনও ঘটনা ঘটলে মনে করে নিন এটা আপনার সঙ্গেই ঘটেছে। মনে সেরকম কষ্ট পাওয়ার চেষ্টা করুন, যেমন কষ্ট ওই ধর্ষিতা শিশুর বাবা-মার হতে পারে। তাহলে বুঝবেন এই কাজটা অত্যন্ত জঘন্য এবং ভুল কাজ হয়েছে। তখনই আপনার এক্সপেরিমেন্ট সফল।
কখনও নিজেকে একটি বই ভাবুন। কেমন লাগছে নিজেকে একটি বই হিসেবে? এইবার একটি বইয়ের পাতা ছিঁড়ে দেখুন কেমন অনুভূতি হয়। একটা তুর্কি প্রবাদ বাক্য আছে, ‛যদি মুখে উচ্চারিত কথা রুপো হয়, তাহলে কানে শোনাটা হল সোনা।’ কিন্তু আমরা শুনতে নারাজ, জানতে অনিচ্ছুক। আমরা শুধু ভেবে নিই, আর হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠি! আমাদের মধ্যে প্রায় সকলেই ফেসবুক নামক প্রবাহ পদ্ধতিটির ব্যবহার করে থাকেন। এই মাধ্যম বা পদ্ধতিটি সবার জন্য উন্মুক্ত। এটি ব্যবহার করে যে কেউ মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন। এই মাধ্যমে কোনও বাধা নেই (কিছু নিয়ম ও শর্ত ছাড়া) এবং এই মাধ্যম ব্যবহার করে আলাপ আলোচনা বিতর্ক সবই করা সম্ভব। এইজন্যই এটার নাম দেওয়া হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা সোশ্যাল সাইট।
এই মঞ্চ ব্যবহার করে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি উবেদ টিইউ নামের এক ব্যক্তি নিজের তোলা একটি ছবি (সেলফি) ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন। এই ছবিতে তাঁর সহাস্যমুখের অর্ধেক অংশ দেখা যাচ্ছিল এবং তাঁর ঠিক পিছনে দেখা যাচ্ছিল একজন রোগাপটকা গোছের যুবককে। ওই যুবকের গালে ছিল খোঁচাখোঁচা দাড়ি, এলোমেলো চুল, শার্ট এর বোতাম খোলা। ঠোঁটে ছিল ক্ষতের চিহ্ন এবং শরীর ছিল ধূলামলিন। তাঁর দুই হাত কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। আহত ওই যুবকের নাম ছিল মধু (৩০)। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে নাকি কিছু খাদ্যদ্রব্য ও চাল চুরি করেছে, যার মূল্য প্রায় ২০০ টাকা। এই চুরির দায়ে বিক্ষুব্ধ জনতা তাঁকে বেদম প্রহার করা শুরু করলে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় সে। উবেদ টিইউ নামের ওই ব্যক্তি পেটানোর সময় তোলা মধুর ছবিটি পোস্ট করেছিলেন।
দলিত যুবক মধুর মায়ের কথায়, মধুর মানসিক অবস্থা একটু খারাপ ছিল। তাই সে বহুবছর ধরে রাস্তাঘাট ও জঙ্গলেই বাস করে আসছিল। মধুও একজন মানুষ। মধুর হত্যা আমাদের জন্য কি অশনিসংকেত নয়? কেননা আমরা এই ঘটনায় উপলব্ধি করতে পারছি যে, আমাদের মানবীয় বোধ বিলুপ্তপ্রায়। এখানে আমাদের সমানুভূতি দেখানোর প্রয়োজনীয়তা ছিল না কি? আমরা কি মধুর জায়গায় নিজেদের দাঁড় করিয়ে ভেবে দেখতে পারতাম না? মধুর অস্তিত্ব কি এবং তাঁর মনে কি চলছে? এটা মধু না হয়ে কি উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল? চেষ্টা করলেই তা সম্ভব ছিল। মধুর জীবনের অনুভব কি ছিল যে, সে জঙ্গল থেকে এসে চাল চুরি করতে গেল? কেন সে চাল চুরি করল? সে আনন্দ পাচ্ছিল না নিশ্চয় চুরি করার সময়। ক্ষিদের জ্বালায় হয়তোবা চুরি করতে বাধ্য হয়েছিল সে।
মানব স্বভাবে সমানুভূতি একটি প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মানুষ কল্পনা ও স্বপ্নের মাধ্যমে সহানুভূতি ও সমানুভূতি দুইই অর্জন করতে পারে। সে অপরের কষ্ট ইচ্ছা করলেই অনুভব করতে পারে এবং নিজের দুঃখে অপরের সমানুভূতি অর্জন করতে পারে। আসলে বর্তমান সময়ে আমাদের শেখানো হচ্ছে আত্মকেন্দ্রিকতা। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য সব কিছু করা বৈধ। নিজের পথে কেউ কাঁটা হলে তাঁকে খুন করাও অপরাধ না। আমাদের নিজদের কাছে এই প্রশ্ন করা উচিত যে, আমরা কি অস্ত্র ও যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের উন্নয়ন সাধন করতে চাইছি? এহেন মানবিক প্রশ্ন উঠবে কি? তাহলে উত্তর নিজেরাই পেয়ে যাবেন।