Saturday, January 25, 2025
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদক সমীপেষু

পবিত্র লাইলাতুল কদর এবং আমাদের করণীয়

সম্পাদকীয়, দৈনিক সমাচার: আজ ১৪৪২ হিজরির ২৬তম রমজান। আজ দিবাগত রাতে লাইলাতুল কদর বা শবে কদর। হজরত আয়শা (রা.) নবিয়ে করিম (সা.) কে জিজ্ঞেস করেন যে, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.) আমি যদি ভাগ্যক্রমে শবে কদরের রাত পেয়ে যাই, তাহলে কী দোয়া পাঠ করবো। আল্লাহর রাসুল (সা.) আয়শা (রা.)কে বলেন, এই দোয়া পাঠ করিও। আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফউন, তুহিব্বুল আফওয়া ফাফু আন্না। অর্থাত্ হে আল্লাহ তুমি বড় ক্ষমাশীল, আমাকে ক্ষমা করো। শবে কদরের রাতে মহান আল্লাহর কাছে বেশি করে খালিছ তাওবা করা উচিত। শবে কদরের রাত থেকে অনেক মহিলা ইতিকাফে বসতে চান। তাই কোনো মহিলা যদি ইতিকাফে বসতে চান, তাহলে তার হাজবেন্ড যেন তাকে খুশি মনে ইতিকাফে বসার অনুমতি দান করেন। মহিলাদের নিজ গৃহকোণে ইতিকাফে বসতে হবে। শবে কদরের রাত থেকে অনেক পুরুষও ইতিকাফে বসতে চান। মহান আল্লাহ পাক সবার ইতিকাফ এবং মহান আল্লাহর নিকট খালিছ তাওবাকে কবুল করুন।

বিত্র শাবান মাসের ফজিলতপূর্ণ রাত—‘লাইলাতুল বারাআত’। লাইলাতুল বারাআত আরবি শব্দ, ফারসিতে বলা হয়—‘শবেবরাত’। ‘শব’ অর্থ রাত, ‘বরাত’ অর্থ ভাগ্য, সেই হিসেবে ‘শবেবরাতের’ আভিধানিক অর্থ ভাগ্যরজনি। পবিত্র কুরআনে এ রাতকে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ্’—বরকতময় রজনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস শরিফে রসুল (স) এ মহিমান্বিত রাতকে ‘লাইলাতুন নিছফি মিন শাবান’—শাবান মাসের মধ্যরজনি বলে উল্লেখ করেছেন। হাদিসের ব্যাখ্যাগ্রন্থসমূহ ও তাফসিরের কিতাবে এ রাতের আরো কিছু নাম উল্লেখ হয়েছে।

যেমন—‘লাইলাতুল কিসমাহ্’—ভাগ্যের রাত, ‘লাইলাতুত তাজবিয’—রিজিক বণ্টনের রাত, ‘লাইলাতুল ফায়সালাহ্’—তকদির নির্ধারণের রাত, ‘লাইলাতুল আফউ’—ক্ষমার রাত, ‘লাইলাতুল কারামি’—দয়ার রাত, ‘লাইলাতুত তাওবাহ্’—তাওবার রাত ও ‘লাইলাতুন নাদামাহ্’—মিনতির রাত ইত্যাদি।

আরবি মাসে রাত আগে আসার কারণে ১৪ শাবান দিবাগত রাতেই পালিত হবে শবেবরাত। শাবান মাস আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদাপূর্ণ মাস। এ মাসকে রমজানের প্রস্তুতি মাস বলা হয়েছে। নবি করিম (স) অন্য মাসের তুলনায় এ মাসে বেশি নফল রোজা পালন করতেন। শবেবরাতের ফজিলত সম্পর্কে হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ (স)-এর সঙ্গে কোনো এক রাতে রাত্রিযাপন করছিলাম। এক সময় আমি তাকে বিছানায় না পেয়ে মনে করলাম—তিনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। আমি তাকে খুঁজতে বের হলাম। গিয়ে দেখি—তিনি জান্নাতুল বাকিতে কবরবাসীদের পশে দাঁড়িয়ে অঝোর নয়নে কাঁদছেন। নবিজি আমাকে উদ্দেশ করে বললেন—‘হে আয়েশা! তুমি কি মনে করো, আল্লাহর রসুল তোমার ওপর বেইনসাফি করেছেন?’ আমি বললাম—ইয়া রসুলাল্লাহ! আপনাকে বিছানায় না পেয়ে ধারণা করেছিলাম—আপনি হয়তো অন্য কোনো স্ত্রীর ঘরে গিয়েছেন। এরপর রসুল (স) বললেন, হে আয়েশা! আজকের রাত সম্পর্কে তুমি জেনে রেখ, মহান আল্লাহ এই রাতে দুনিয়ার প্রথম আকাশে অবতীর্ণ হয়ে দুনিয়াবাসীর ওপর তাঁর খাস রহমত নাজিল করেন। কাল্ব গোত্রের মেষের গায়ে যত পশম রয়েছে তার চেয়েও অধিকসংখ্যক বান্দাকে তিনি ক্ষমা করেন। (সুনানে তিরমিযি—১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫৬)

রাসুলে পাক সা. বলেন, লাও লাম তুজনিবু লাযাহাবাল্লাহু বিকুম ওয়া লিজায়া বিকাওমিন ইয়ুযনিবুনা ফাইয়াসতাগফিরুনাল্লাহু ফাইয়াগফিরুলাহুম। অর্থাত্ তোমরা যদি গোনাহ না করো, তবে আল্লাহ পাক তোমাদের সরিয়ে দেবেন এবং সে স্থলে এমন জাতি সৃষ্টি করবেন যারা গোনাহ করবে। অতঃপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইবে। তখন তিনিও তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন। (মুসলিম) মহান আল্লাহর কাছে তাওবাহ করতে দেরি করা এবং গোনাহের কাজে অটল থাকা মহা বড় পাপ। তাওবা কবুল হওয়ার শর্তাবলি।

সংশ্লিষ্ট গোনাহের কাজটিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা।
কৃত পাপের কারণে মহান আল্লাহর কাছে লজ্জিত হওয়া। ভবিষ্যতে পুনরায় উক্ত পাপে লিপ্ত হবে না, এ কথার ওপর দৃঢ় অঙ্গীকার করা। তাওবার ক্ষেত্র চার ভাগে বিভক্ত।

১ . জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত তাওবার ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকা। এই রকম তাওবাকে তাওবায়ে নাছুহা বলা হয়, অর্থাত্ একনিষ্ঠ দৃঢ় তাওবাহ।
২. প্রশান্তিময় আত্মা, তাওবা করার পর মৌলিক আমলসমূহে দৃঢ় থাকবে। কিন্তু পাপাচার হতে মুক্ত হতে পারবে না। পাপে লিপ্ত হওয়ার জন্য সুদৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে অগ্রসর হবে না। কিন্তু তার পরও ফিত্না থেকে বাঁচাতে পারবে না। লিপ্ত হয়েই যাবে। যখনই এ ধরনের কিছু ঘটে যাবে অপরাধীর মতো নিজেকে লাঞ্ছনা দেবে, লজ্জিত হবে এবং পাপকাজ থেকে লিপ্ত হওয়ার যাবতীয় উপকরণ থেকে বেঁচে থাকার জন্য অঙ্গীকার করবে। একেই বলা হয় নাফছে লাউয়ামাহ বা প্রশান্তিময় আত্মা।

৩. তিরস্কারি আত্মা, তাওবাহ করে কিছু কাল দৃঢ় থাকবে। অতঃপর হঠাৎ কোনো গোনাহের কাজে প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে লিপ্ত হয়ে পড়বে। অথচ সে নিয়মিতভাবে নেক কাজ করেই চলবে। যাবতীয় অপরাধে জড়াতে মন চাইলে ও এবং হাতের নাগালে পেলেও তা পরিত্যাগ করবে। কিন্তু দু-একটা বিষয়ে প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারবে না। ফলে তাতে লিপ্ত হয়ে পড়বে শেষে লজ্জিত হবে এবং উক্ত পাপকাজসমূহ অচিরেই ছেড়ে দিয়ে তাওবা করার অঙ্গীকার করবে। একেই বলা হয় নাফছে মাছউলা বা জিজ্ঞাসিত আত্মা। এর পরিণাম ভয়াবহ। কেননা সে আজ নয়, কাল নয় বলে তাওবা করতে দেরি করেছে। হতে পারে সে তাওবার সুযোগ না পেয়ে মৃত্যু বরণ করবে। মানুষের শেষ আমলই তার পরিণাম নির্ধারণ করে।

৪. তাওবা করে সে কিছু সময় দৃঢ় থাকবে, কিন্তু পুনরায় আবার পাপ কাজে লিপ্ত হয়ে যাবে। অতঃপর পাপকাজ করে আফসোস ও করবে না এবং তাওবা করার কথাও মনে আনবে না। একেই বলা হয়, নফছে আম্মারা বিছছু অর্থাৎ পাপে উদ্বুদ্ধকারী আত্মা। এর পরিণাম খুবই ভয়ানক। এর শেষ পরিণতি খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে। অর্থাৎ মৃত্যুর আগে তার নছিবে তাওবা নাও জুটতে পারে। ফলে সে ধ্বংস হয়ে যাবে।

অতএব আমরা মানবজাতি কার কখন মৃত্যু আসে সেটা আমরা জানি না। তবে সব সময়ই আল্লাহর কাছে তাওবার হালতে থাকা খুবই জরুরি। মৃত্যুর আগে ঈমান নছিবের অপর নেক আমলের নাম হলো তাওবা।

 

 

Leave a Reply

error: Content is protected !!