Sunday, January 26, 2025
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদক সমীপেষু

বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজোর চাঁদা গ্রহণ অবৈধ হয়েও বৈধ, হিজাব পরিধান বৈধ হয়েও কেন অবৈধ?

রাত ফুরালেই সদ্য তালা খোলা শিক্ষালয় গুলোতে বাজবে বাগ দেবীর আরাধনার ঘণ্টা। বাংলার প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে যুগ যুগ ধরে বিদ্যা দেবীর এহেন আরাধনার আয়োজনের সূচনার ইতিহাস জানা না গেলেও, মনে হয় এই প্রকার আয়োজন করা প্রতিটি শিক্ষাকেন্দ্রে একান্ত বাধ্যতামূলক। ভারত, যে দেশটি সকল ধর্মের সহাবস্থানের প্রয়াস নিয়ে এই বিশ্বের বুকে একটি স্বতন্ত্র মানচিত্রের রুপ নিয়ে নিজেকে দাখিল করেছে, সেই দেশটির সরকারী শিক্ষালয়গুলিতে এই প্রকার একক ধর্মের আধিপত্য বিস্তার দেখে বেশ অবাক লাগে বৈকি।

জাতি ধর্মের উর্ধ্বে উঠে অনেকে বিদ্যার দেবীর আরাধনার এই প্রকার আয়োজনকে সেকুলারের সংজ্ঞাতে এমনভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছেন যে, যার যাঁতাকলে পড়ে বেশ কিছু সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীদের নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেই অতীতকাল থেকে। শিক্ষালয় গুলিতে প্রতি বছরের ন্যায় বাগ দেবীর পূজাতে ভিন্ন ধর্মালম্বীর শিক্ষার্থীদের থেকে অর্থ আদায় করা আসলেই কী বৈধতা পাওয়ার যোগ্যতা রাখে? যদিও এই ধরনের প্রশ্ন তুললে অনেকেই যুদ্ধাংদেহী মানসিকতা নিয়ে প্রশ্নকারীকে ভিন্ন মার্গের কথা দিয়ে বিদ্ধ করবেন তা বলার অন্তঃ রাখে না। তবুও এ প্রশ্ন তোলার প্রয়োজনীয়তা একজন ভারতীয় হিসাবে বারবার অনুধাবন করি।

ভারতীয় সংবিধানের ২৮(৩) নং ধারাতে বর্ণিত “রাজ্য হইতে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বা রাজ্যনিধি হইতে সাহায্যপ্রাপ্ত কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন এরূপ কোন ব্যক্তিকে ঐ প্রতিষ্ঠানে যে ধর্মীয় শিক্ষাদান করা হয় তাহাতে অংশগ্রহণ করিতে, অথবা ঐ প্রতিষ্ঠানে বা ঐ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টকোন গৃহাদিপরিসরে যে ধর্মীয় উপাসনা অনুষ্ঠিত হয় তাহাতে উপস্থিত থাকিতে বাধ্য করা যাইবে না, যদি না তিনি স্বয়ং, বা তিনি নাবালক হইলে তাঁহার অভিভাবক, তাহাতে সম্মতি দেন।” তারপরেও যুগযুগ ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার আয়োজনে সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের থেকে চাঁদা নেওয়ার বাধ্যতার ব্যাপারে কেন কোন প্রকার প্রশ্ন ওঠে না? মেনে নিলাম অনেকে এই অনুষ্ঠানকে কেবলই একটি সামাজিক অনুষ্ঠান তথা শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন হিসাবে গণ্য করে থাকেন, তাঁদের যুক্তি শুনে মনে হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের ভূরিভোজের জন্য দেবী মায়ের আরাধনা একান্ত প্রয়োজন। কিন্তু আমার শৈশবের আধা সরকারী শিক্ষালয় বাণীবন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে তো প্রতি বছরই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমারা সকলেই বনভজন নামক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরস্বতী পূজা ছাড়াই একই আনন্দ উপভোগ করতাম, কই আমাদের বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষতো কখনোই এই ধরনের অনুষ্ঠানে ছাত্রীদের শামিল করতে তখন কোন পূজা-আর্চনা বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেননি? পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ শিক্ষালয়ে পূজার চাঁদা দিতে ছাত্রছাত্রীদের একপ্রকার বাধ্য করা হয়, চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট না দেওয়ার হুমকিও আসতো রীতিমত। আর বর্তমানে তো স্কুল কর্তৃপক্ষ গুলো আরো একধাপ এগিয়ে গেছে, ভিন্ন ধর্মালম্বী ছাত্র-ছাত্রীদের কোন প্রকার অনুমতি ছাড়াই নতুন শ্রেণী ভর্তির সময় একটা অঙ্কের অর্থ আদায় করে। এই নিয়ে কোনপ্রকার উচ্চবাচ্চ না হওয়ার কারণে এই বিষয়টা সাংবিধানিক চির বৈধতার স্মারক লাভ করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের জানা দরকার তাদের কোনপ্রকার অধিকার নেই সংখ্যালঘু ছাত্র-ছাত্রীদের নীতি নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে কোন প্রকার ধর্মীয় অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে বা তাতে অর্থ প্রদান করতে বাধ্য করার। সংবিধান তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আখড়া হওয়ার অনুমতি দেয় না। হিন্দু ধর্মের সংখ্যাধিকত্বের কারণ যদি হয় এই সমস্তের মূলে তাহলে দেশের সংবিধানের কোন প্রকার মূল্যই থাকে না।

দিনের আলোতে সরকারী বা আধাসরকারী কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভিন্ন ধর্মালম্বী শিক্ষার্থীদের থেকে চাঁদা নেওয়া অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও সমাজে কোন প্রকার প্রশ্ন ওঠেনা। কিন্তু সংবিধানের ১৪ এবং ২৫ নং ধারা অনুসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিজাব পরিধানের বৈধতা থাকা সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে হিজাব পরিধানকে দেওয়া হয় নিষিদ্ধতার তকমা। প্রতিক্ষেত্রে ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের কেন এই দ্বিচারিত স্বীকার হতে হবে? তবে কী দেশের নিয়ম নীতির বৈধতা-অবৈধতা বিচারের ক্ষেত্রে কষ্টিপাথর সম সংবিধান কী তার গুরুত্ব হারিয়ে অতি নগন্য পুস্তকে পরিণত হতে চলেছে?

আফরিদা খাতুন আঁখি
পাঁচলা, হাওড়া

Leave a Reply

error: Content is protected !!