Friday, March 29, 2024
ফিচার নিউজসম্পাদক সমীপেষুসম্পাদকীয়

ফ্রান্সে আবারও মুহাম্মাদ সাঃ–কে নিয়ে ব্যাঙ্গ-চিত্র, আর্টের স্বাধীনতা না ঘৃণ্য রুচির প্রকাশ

মুহাম্মাদ নূরুদ্দীন

“আর্টের নামে ভন্ডামী করে দিন-রাত বল আর্টের জয়
আর্ট মানে শুধু বাঁদরামো আর মুখ ভ্যাংচানো নয়”

আবারও আর্টের নামে ভণ্ডামি শুরু করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। ৩০ সেপ্টেম্বর ফ্রান্সের ম্যাগাজিন শার্লি এবদো’র সবশেষ সংস্করণের প্রচ্ছদে প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সাঃ)-কে ব্যঙ্গ করে আঁকা ১২টি কার্টুন ছাপা হয়। এর পক্ষকাল পরে ফ্রান্সের একজন স্কুল শিক্ষক ক্লাসে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে মহানবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ কার্টুন প্রদর্শন করেন। সেখানকার মুসলিম কমিউনিটি এর বিরোধিতা করে। একজন ইমাম মসজিদ থেকে এর বিরুদ্ধে অনলাইনে প্রতিবাদের ডাক দেন।

এর মধ্যে ওই শিক্ষক চেচেনের এক যুবকের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়। তারপর থেকে ফ্রান্স জুড়ে চলছে মুসলিম কমিউনিটির বিরুদ্ধে সরকার ও বিভিন্ন উগ্র জাতীয়তাবাদীদের হামলা ও কঠোর পদক্ষেপ। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ওই ইমামের মসজিদ বন্ধ করে দেন, বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়, চারদিকে ধর-পাকড় শুরু হয় এবং প্রকাশ্য জনসভায় তিনি মহানবীর ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ জারি রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এর আগে এ মাসের শুরুতে তিনি ইসলাম ধর্ম সংকটে বলে পশ্চিমা বিশ্বে বিতর্ক তৈরি করেন।

ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো বাক স্বাধীনতার নামে এই নিকৃষ্ট আর্টিস্টদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। প্যারিসে নির্মিত দুটি ব্যাঙ্গ কার্টুনকে পুলিসি নিরাপত্তায় ঘিরে দেওয়া হয়েছে। তারা আর্টের স্বাধীনতার নামে এই জঘন্য কাজ করে যাচ্ছে। অথচ প্রতিটা জিনিসের মত আর্টের স্বাধীনতারও একটা সীমা আছে।

বাকস্বাধীনতা হচ্ছে স্বতন্ত্র ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের; নির্ভয়ে, বিনা প্রহরতায় বা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা, অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার সমর্থিত মুলনীতি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা শব্দপুঞ্জটিকেও কখনও কখনও বাকস্বাধীনতার স্থলে ব্যবহার করা হয়, তবে এক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতার সাথে মাধ্যম নির্বিশেষে তথ্য বা ধারণার অন্বেষণ, গ্রহণ এবং প্রদান সম্পর্কিত যেকোন কার্যের অধিকারকেও বুঝিয়ে থাকে।

বেসামরিক ও রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক চুক্তির (আইসিসিপিয়ার) মানবাধিকার সনদ এর ১৯ নং অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীনচেতায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; পুরো বিশ্বের যে কোনো মাধ্যম থেকে যে কোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দ্বারা জ্ঞাপন করার অধিকার”।

এই ১৯ নং অনুচ্ছেদ পরবর্তীতে সংশোধিত হয়, উদ্ধৃতিতে বলা হয়; এইসব অধিকারের চর্চা বিশেষায়িত নিয়ম এবং দায়িত্বকে ধারণ করে; তবে যদি এই চর্চার দ্বারা কারো সম্মান হানি হয় বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তবে কিছু ক্ষেত্রে এর অবাধ চর্চা রহিত করা হয়। মর্যাদাহানি, কুৎসা রটানো, পর্নোগ্রাফি, অশ্লীলতা, আক্রমণাত্মক শব্দ এবং মেধাসম্পদ, বাণিজ্যিক গোপনীয়তা, জননিরাপত্তা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাকস্বাধীনতা যদি অন্য কারও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বা কারও অপকার করে তবে অপকার নীতির মাধ্যমে বাকস্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে। এই অপকার নীতির ধারণাটি প্রণয়ন করেছিলেন জন স্টুয়ার্ট মিল তার ‘অন লিবার্টি’ নামক গ্রন্থে।

সেখানে তিনি বলেন, “একটি সভ্য সমাজে কোন ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে তার উপর তখনই ক্ষমতার সঠিক ব্যবহার করা যায়, যখন তা অন্য কোন ব্যক্তির উপর সংঘটিত অপকারকে বাঁধা দেয়ার জন্য করা হয়।” অবমাননা নীতির ধারণাও বাকসীমাবদ্ধতার ন্যায্যতা প্রতিপাদনে ব্যবহৃত হয়, এক্ষেত্রে যেসব কথায় সমাজে অবমাননার সৃষ্টি করে সেগুলোর প্রতি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এক্ষেত্রে বক্তব্যের পরিমাণ, সময়, বক্তার উদ্দেশ্য, কতটা সহজে এড়িয়ে যাওয়া যায় – এসব বিবেচনায় আনা হয়। ডিজিটাল যুগের বিবর্তনের সাথে সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার নতুন উপায় আবিষ্কৃত হওয়ায় বাকস্বাধীনতার প্রয়োগ ও এর বিধিনিষেধ ব্যবস্থার বিতর্ক আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

ফ্রান্স, ডেনমার্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের কু-কীর্তি দিয়ে শুধু মুসলিমদের মনে আঘাত দিচ্ছে তাই নয় বরং তারা আন্তর্জাতিক মানবাকাধিকার সনদ লঙ্ঘন করছে। একবার নয় বারবার। এই ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনগুলো ২০০৫ সালে প্রথম প্রকাশ করেছিল ডেনমার্কের জিল্যান্ড পোস্ট পত্রিকা। এরপর কয়েকবার ফরাসি এই শার্লি এবদো ওই ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনগুলো ছাপায়। ২০১৫ সালে মহানবীকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক কার্টুনগুলো প্রকাশের পর বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। সারা বিশ্বের মুসলমানেরা বিক্ষোভ করেন।

লারস ভিকসের মুহাম্মদ (সাঃ) এর ছবি আঁকা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় ২০০৭ সালের জুলাই মাসে। যেখানে সুইডেনের কার্টুনিস্ট লারস ভিকস ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ)কে চিত্রিত করেন। অনেল সুইডিশ শিল্প গ্যালারী তার আঁকা এসব কার্টুন প্রদর্শন করতে অস্বীকৃতি জানায় নিরাপত্তা ও সহিংশতার আশঙ্কায়।এই বিতর্ক একটা আন্তর্জাতিক রূপ পায় যখন নেরাইকস আল্লেহান্ডো নামের একটি পত্রিকা এসব কার্টুনের একটি ছাপায় ১৮ই আগস্ট একটি সম্পাকদীয়সহ যা ছিল ধর্মীয় মুক্তচিন্তা ও আত্ন-বিধিনিষেধ আরোপের ওপর। যদিও অন্যসব সুইডিশ পত্র-পত্রিকা এইসব কার্টুন ছাপিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু এই কার্টুনটার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা প্রকাশ পায়। ঐ দেশের মুসলমান ছাড়াও বিভিন্ন বিদেশী দেশের সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। বিশেষ করে ইরান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিসর, জর্ডান এবং ওআইসি ।এই বিতর্ক প্রায় দেড় বছর পরে শুরু হয় ২০০৬ সালে ডেনমার্কে জাইল্ল্যান্ডসের আঁকা মুহাম্মদের কার্টুন বিতর্কের পরে।

সেকালের ফ্রান্সের তামাম ইতিহাস জুড়ে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও বর্বরতা ছেয়ে আছে। তারা জোরপূর্বক ৯৯ শতাংশ মুসলমানের দেশ আলজেরিয়াকে ১৩২ বছর দখল করে রেখেছিল। এই সময়ে জামা কাংশোয়াসহ প্রধান প্রধান প্রায় সবগুলো মসজিদগুলোকে গীর্জায় পরিণত করেছে। মুসলমানদের ফসলি বাগানগুলোকে ফলের মওসুমে তারা আগুনে পুড়িয়ে দিত। ১৫ লাখেরও অধিক লোককে তারা শহীদ করেছে। মাদ্রাসাগুলোকে বন্ধ করে দিয়েছিল। কোরআন শিক্ষা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। শুধু আলজেরিয়া নয়, মরক্কো, তিউনিসিয়া, সুদান, মালি, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, লেবানন, ইয়ামানে যেই মুসলিম ভূমিতেই ফ্রান্স প্রবেশ করেছে সেখানেই সে মসজিদ, মাদ্রাসা আর ইসলামের উপর আঘাত করেছে।

ফ্রান্সে কেবল গত এক বছরেই ১,০৪৩ টি ইসলামোফোবিক ঘটনা ঘটেছে। যেখানে ২২ টিরও অধিক মসজিদে হামলার ঘটনাও আছে। সম্প্রতি ডেনমার্কের এক নওমুসলিম এমপি মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ (Joram van Klavere) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি ফ্রান্সে বিশ্বনবিকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন প্রকাশের বিষয়ে মুসলিম উম্মাহর প্রতি শান্তির আহ্বান তুলে ধরেন। ফ্রান্সে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যঙ্গ চিত্র প্রকাশ করায় ডাচ নওমুসলিম এমপি মোহাম্মাদ আব্দুল্লাহ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন- ‘বিশ্বনবি ইতিহাসের এমনই একজন মহামানব ছিলেন, যিনি একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান, শিক্ষক, সামরিক প্রশাসক এবং আল্লাহর প্রেরিত দূত তথা রাসুল ছিলেন। তিনি কোটি কোটি মুসলমানের নয়নমনি।
ফ্যান্সের বিতর্কিত ম্যাগাজিন শার্লি হেবদো বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম কার্টুন প্রকাশ করে শুধু বিশ্বনবিকেই অপমান করেনি বরং কোটি কোটি মুমিন মুসলমানের হৃদয়ে ও অনুভূতিতে আঘাত করেছে, অপমান করেছে।

এমপি আব্দুল্লাহ (Joram van Klavere) আরও লেখেন, ‘আমি জানি, তিনি যদি এখন বেঁচে থাকতেন; তবে তিনি অপরাধীকে ক্ষমা করে দিতেন। তিনি তাঁর ক্ষমা করার অসাধারণ গুণ বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিতেন। কেননা আল্লাহ তাআলা তাকে সর্বেোচ্চ জ্ঞান দান করেছেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যঙ্গ চিত্র আঁকা কার্টুনিস্টদের বিরুদ্ধে রাগের মাথায় কোনো ক্ষতিকর কার্যকলাপ না করে ধৈর্যধারণ করা উচিত। আর কার্টুনিস্টদের এ অপরাধমূলক কাজের দায়ভার মহান আল্লাহর উপর ছেড়ে দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন ডেনমার্কের এ নওমুসলিম এমপি। তিনি আহ্বান জানান, বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুমহান আদর্শ ও শিক্ষা মানুষের কাছে আরও বেশি বেশি তুলে ধরতে হবে। তাদের মাঝে বিশ্বনবির আদর্শ ও দাওয়াত ব্যাপকভাবে পৌছে দিতে হবে। আমি যদি অমুসলিম হতাম। যদি আল্লাহ আমাকে ইসলামের জন্য কবুল না করতেন। তাদের বলুন, কে ছিলেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাদের দেখান, কি শিখিয়েছেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর সম্পর্কে জানতে তাদের দাওয়াত দিন। তিনি বিশ্বমানবতার জন্য আর্শীবাদস্বরূপ প্রেরিত হয়েছিলেন।

তিনি আরও বলেন, ‘অবশেষে মনে রাখবেন, ইসলামের আলো দুনিয়ার প্রতিটি কোনায় কোনায় পৌছে যাবে ইনশাআল্লাহ। বিশ্বের কোনো শক্তিই এটাকে থামাতে পারবে না। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের আলোর মশাল দিয়েছেন। যা দিয়ে বিশ্বমানবতাকে আলোকিত করতে হবে।

 

Leave a Reply

error: Content is protected !!