Thursday, April 18, 2024
সম্পাদক সমীপেষুসম্পাদকীয়

উঠে আসছে সত্য ইতিহাস! আলো দেখাচ্ছে তুর্কী চলচ্চিত্র ‛দিরিলিস: আর্তুগ্রূল’

নুরুল ইসলাম মাঝারভূইয়া

মুসলিম জাতির পুনর্জাগরণের লক্ষ্যে যতগুলি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এর মধ‍্যে ‛দিরিলিস: আর্তুগ্রূল’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। ওসমানী খিলাফতের প্রতিষ্ঠাতা গাজী পিতা আর্তুগ্রূল।

মাত্র শ’খানেক পরিবার নিয়ে দাঁড়ানো তুরষ্কের এক ছোট যাযাবর কবিলা ‛কাই’ সে যুগের জীবন সংগ্রামের একমাত্র উপায় সশস্ত্র যুদ্ধে দক্ষ ইসলামী নেতৃত্বের যে ধারা প্রতিষ্ঠা করেছিলো, তা তৃতীয় প্রজন্মের হাতেই তিনটি মহাদেশ জুড়ে পৃথিবীর সর্বকালের সর্ববহৎ সাম্রাজ‍্যে পূর্ণতা লাভ ক‍রেছিল।

কাই কবিলার সর্দার সুলেমান শাহ ঘরোয়া অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে করতেই মুসলিম দুনিয়ার প্রতি হুমকি হয়ে উঠা খ্রিস্টান রাজশক্তি ও তাদের তাবেদার মুসলিম শাসকদের প্রতি যে প্রত‍্যাহ্বান ছুড়ে দিয়েছিলেন, আর এর প্রেক্ষিতে একের পর এক যেসব রণাঙ্গন তৈরী হয়েছিলো, সবখানেই আর্তুগ্রূল ছিলেন মুখ‍্য সেনাপতি।

সুলেমান শাহের মৃত‍্যুর পর কাই কবিলা আর্তুগ্রূলকে সর্দার বানিয়ে নেয়। আর্তুগ্রূল চেঙ্গিস খানের পরবর্তী তাতারিদের অবাধ গণহত‍্যা প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে যান। তাতারিদের আক্রমণের মুখে পতনের প্রান্তে চলে আসা সুলতান আলাউদ্দিনের বিনা আমন্ত্রণে তার সাহায‍্যে এগিয়ে যান আর্তাগুল। যুদ্ধের ছবি পাল্টে যায়। এর পর থেকেই তাতারিরা পরাজয় ও পতনের দিকে হাটতে থাকে। শুরু হয় মুসলিম দুনিয়ার ঐক‍্যের মিছিল।

আর্তুগ্রূলের পুত্র ওসমানের সময় নির্মিত হয় আরেক ইতিহাস। ওসমানি সাম্রাজ্য শুধু এক রাজনৈতিক শক্তি না হয়ে মুসলিম দুনিয়ার কেন্দ্রীয় খিলাফতের মর্যাদা লাভ করে। এর পর মুসলিমরা ইতিহাস ভুলতে থাকে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপুল বোঝা ওসমানী খিলাফতের উপর বর্তায়। খিলাফতকে কবর দিয়ে কামাল আতাতুর্ক তুরষ্ককে এক ইসলামবিহীন দেশ রূপে গড়ে তোলেন।

কিন্তু ইতিহাস থেমে থাকেনা। তুরস্কে ইসলামের পুনরপ্রতিষ্ঠার সাধনা চলতে থাকে। হাজার অত‍্যাচার, জেল, ফাঁসির পথ পেরিয়ে তুরস্ক এখন এরদোগানের নেতৃত্বাধীন এক ইসলামের কাছাকাছি আসা দেশ এবং মুসলিম দুনিয়ার সামনে এক আশার আলো।

তুরস্ক এখন শুধু ওসমানী খিলাফতের পুনর প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছেনা। দেখছে মুসলিম দুনিয়ার ঐক‍্য, উন্নয়ন এবং অত‍্যাচারি পরাশক্তিসমূহের সমসারিতে মুসলিম দুনিয়ার প্রতিষ্ঠা। মূলত তুরস্কের নবীন প্রজন্মকে এ স্বপ্ন দেখাতেই আর্তুগ্রূল চলচ্চিত্রের নির্মাণ। কিন্ত আর্তুগ্রূল তুরষ্কের মধ‍্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি।

আশ্চর্যজনকভাবে তা সমগ্র বিশ্বের মুসলিম যুব মানস দখল করে নিয়ে প্রমাণ করছে যে এ স্বপ্ন সমস্ত বিশ্ব মুসলিমের। তুরস্ক এবং ওসমানী খিলাফতের উত্থান পতন প্রমাণ করেছে যে ইসলামের হাত ধরেই উত্থান এবং ইসলামে উদাসীনতাই পতনের মূল।

এই উদাসীনতাও এক স্বাভাবিক ব‍্যাপার । ব‍্যক্তি যখন যৌবন পেরিয়ে বার্ধক‍্যের দিকে এগোতে থাকে মৃত‍্যু দিয়ে তার শেষ হয়। তার যৌবন আর ফিরে আসেনা। যৌবন দেখতে হলে দেখতে হবে তার রেখে যাওয়া নতুন প্রজন্মে। কোন জাতিও এভাবে ক্রমশঃ বয়সের ভারে নুয়ে পড়তে পারে। সে জাতির মধ‍্যে যৌবন দেখতে হলে জাগাতে হয় নতুন প্রজন্মকে। এ বার্তা নিয়েই আর্তুগ্রূলের বিচরণ।

এবার আর্তুগ্রূল প্রেমীদেরকে ভাবতে হবে। এখন ঘোড়া তলোয়ারের যুগ নয়। এখন মানবতার শত্রুগণ কোন কিল্লায় বসে শাসন শোষন চালাচ্ছে না। এখন আপনাদের উপর আক্রমনের অপেক্ষায় কোন তলোয়ারধারী কোন জংলী ডেরায় ওৎ পেতে নেই। এখন আক্রমণ, প্রতি আক্রমণ, আত্মরক্ষার ধরণ বদলেছে। তা বুঝতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কর্তব‍্য নির্ণয় করতে হবে।

ওসমানী খিলাফতের প্রাণশক্তি ছিলো ইসলাম। আজকের দিনেও ইসলাম থেকেই প্রাণশক্তি অর্জন করতে হবে। সেই চরিত্র, সেই উদ‍্যম, সেই যোগ‍্যতা আহরণ করতে হবে। কোন বড় সাম্রাজ‍্য প্রতিষ্ঠা করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু জুলুমের অবসান, জালিমের পথরোধ করতে করতে যদি দেশ ও দুনিয়াবাসী ইসলামের আঙ্গিনায় জড়ো হয়ে যায়, তাদের জন‍্য কল‍্যাণকর ব‍্যবস্থা উপহার দিতে পিছিয়ে যাওয়া চলবেনা।

নিজের জন‍্য আরাম আয়েশের মহল গঢ়া কোন ঈমানদারের জীবনের স্বপ্ন হতে পারেনা। ‛কুনতুম খাইরা উম্মতিন উখরিজাত লিন নাস, তা’মুরুনা বিল মা’রূফ, ওয়া তান হাউনা আনিল মুনকার – তোমরা মানবজাতির জন‍্য উত্থিত উৎকৃষ্ট সম্প্রদায়, তোমরা কল‍্যাণের আদেশদাতা এবং অকল‍্যানের অবসানকারী হবে’।

এটা হচ্ছে মুসলিমদের সামগ্রিক কর্তব‍্যের ধারণা। আর উদ্দেশ্য হবে আল্লার সন্তুষ্টি। পার্থিব নাম যশ ইত‍্যাদির প্রলোভন এ উদ্দেশ্যকে কলুষিত করবেনা। ‛ইন্নাস সালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহ ইয়ায়া ওয়া মামাতি লিল্লাহি রাব্বিল আ’লামীন –আমার নামাজ ,আমার ত‍্যাগ তিতিক্ষা, আমার জীবন ,আমার মৃত‍্যু সব কিছুই আল্লার জন‍্য।’

সুতরাং আর্তুগ্রূল দেখে দেখে উদ্দীপ্ত হে যুবক! যদি আপনি দেশ-দুনিয়া-মানবতার জন‍্য কিছু করতে চান, তাহলে আপনার লেখাপঢ়ায়, আপনার ব‍্যবসায়, আপনার সামাজিক, রাজনৈতিক কাজে, সর্বত্র আপনি নিষ্ঠাবান হয়ে যান। সময় সুযোগের এবং আপনার যোগ‍্যতার অপব‍্যবহার করে আপনার উদ‍্যমকে ব‍্যর্থ করে ফেলবেন না। আপনি নিজেকে যুগসৃষ্টির এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উপলব্ধি করুন। ইনশাল্লাহ আপনার উদ‍্যম কোথাও না কোথাও সুফল হয়ে ফুটবে।

আর যারা আর্তুগ্রূলদের নির্দয় তরবারি চালনা আর রক্তপাত দেখে ভীতি অনুভব করছেন, তারা একবার ভেবে দেখুন সে যুগের বাস্তবতা, – মংগোলিয়া থেকে বেরিয়ে চেংগিস খানেরা শুধুমাত্র দিগ্বিজয়ের নেশায় লক্ষ কোটি মানুষ হত‍্যা করে চলছে, তাদেরকে রুখে দিতে কি তুর্কী তলোয়ার জরুরী ছিলোনা?

লেখক : অসমের বিশিষ্ট লেখক

Leave a Reply

error: Content is protected !!