Friday, March 29, 2024
গল্পফিচার নিউজশিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৩)

মুহসীন মোসাদ্দেক

 

(পূর্ব প্রকাশের পর)

লাবু বললো, ‘কিসের ফন্দি?’
সুরুজ দাঁত বের করে একটু জোকারি করে বললো, ‘টাইট দেয়ার একেবারে উত্তম ফন্দি।’

লাবু বললো, ‘কিন্তু ফন্দিটা কী?’

সুরুজ আবার তার সবকটা দাঁত বের করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, রুবেল তাকে সুযোগ না দিয়ে বললো, ‘শুনলে মেজাজ একদম খারাপ হয়ে যাবে!’

সুরুজ আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সুযোগ পেলো না। লাবু কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘আরে বাবা, ব্যাপারটা কী আগে বলবি তো!’

সুরুজ এবার কথা বলার কোনো আগ্রহ দেখালো না। রুবেল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘ব্যাপারটা হইলো স্কুল!’

লাবু বললো, ‘স্কুল! স্কুলে কী সমস্যা!’
রুবেল আবার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ‘বিষয়টা হইলো, তুই আসলে অটোমেটিকভাবে আমাদের জন্য স্কুল ছুটি হয়ে যায়। তুই যে কয়দিন থাকিস সে কয়দিন স্কুল না গেলে আমাদের কেউ কিছু কয় না। কিন্তু এইবার সেটা হইতেছে না! এইবার তুইসহ আমাদের সবাইকে স্কুলে যাইতে হবে। কুনো মাফ নাই, বুঝলি?’

লাবু উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘স্কুলে যেতে হবে মানে! পাঁচদিনের জন্য বেড়াতে এসেও আমাকে রোজ স্কুলে যেতে হবে! পড়তে হবে! হোমওয়ার্ক করতে হবে! বললেই হলো নাকি!’

‘কিন্তু কোনো উপায় নাই। আর এই ফন্দির মূল নায়ক কে জানিস?’
‘কে?’

‘আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাইজান মিস্টার জুয়েল।’

‘কি! জুয়েল ভাই!’

‘হুম, জুয়েল ভাই।’

‘দাঁড়া, জুয়েল ভাইকে তো মজা দেখাবোই, আগে আম্মুর সাথে বোঝাপড়া করে নিই।’
‘কারো সাথে বোঝাপড়া কইরা কোনো লাভ নাই। কথা শুধু একটাই, স্কুলে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই!’

লাবু আর কথা বাড়ালো না। এতোক্ষণ লাবু আর রুবেলের কথা সবাই শুনছিল। কেউ কোনো কথা বলে নি। সুরুজ বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে সুযোগ না পেয়ে সেও একেবারে চুপ।

ভেজা কাপড়ে লাবু বাড়ি ফিরে রাগতঃ স্বরে একটু চিৎকার করে বললো, ‘অ্যাই আম্মু, এইগুলো আমি কী শুনছি?’
‘তা কী শুনেছেন আপনি?’

‘আমাকে নাকি এখানেও স্কুলে যেতে হবে!’ রেগে রেগেই বলে লাবু।

‘ঠিকই তো শুনেছিস। কিন্তু এতে এতো মেজাজ দেখানোর কী আছে?’

‘বেড়াতে এসেও আমাকে রোজ রোজ স্কুলে যেতে হবে, পড়তে হবে, হোমওয়ার্ক করতে হবে! এটা হয় নাকি!’

‘হওয়ালেই হয়। বেড়াতে এসে কি খাওয়া, ঘুমানো কিংবা টয়লেট করা বন্ধ থাকে? ওগুলো যদি নিয়মমতো চলতে পারে তবে স্কুল বাদ যাবে কেন!’

‘এইটা কোনো কথা না। মাত্র কয়টা দিনের জন্য বেড়াতে এসেছি, মজা করবো, ঘুরবো-ফিরবো। রোজ স্কুলে যেতে হলে কখন মজা করবো, কখন ঘুরবো-ফিরবো!’

‘কেন, স্কুলে কি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা থাকতে হবে? স্কুল থেকে ফিরেও মজা করা, ঘুরে-ফিরে বেড়ানোর অনেক সময় থাকবে।’

‘কয়টা দিন স্কুল না গেলে এমন কী ক্ষতি হয়!’

‘অনেক ক্ষতি হয়। আর ধরে নিতে পারিস এটা তোদের জন্য একটা শাস্তি।’

‘শাস্তি! আমি তো এই মাত্র এলাম। এর মাঝে এমন কী করলাম যে আমাকে শাস্তি পেতে হবে!’

‘শাস্তি তোকে একা দিচ্ছি না। দিচ্ছি তোদেরকে। বছরে যে দুইবার তুই গ্রামে আসিস প্রতিবারই তোর নামে ডজন খানেক নালিশ আসে। আর তোর সাথে জড়িত থাকে রুবেলসহ অন্যরা। একে তো এসব নালিশ সামলানোর ঝামেলা, তার ওপর তোদের পড়াশোনা লাটে উঠে যায়। গ্রাম থেকে ফিরে গিয়ে তুই বেশ কয়েকদিন পড়ায় মন দিতে পারিস না। এ কারণে তুই সাদিবকে টপকে ফার্স্ট তো হতে পারিসই না, উল্টো রুমি তোকে টপকে সেকেন্ড হয়ে যায়। তুই হয়ে যাস থার্ড। রুবেলদেরও একই অবস্থা। তাই এবার তোদের জন্য এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। মজা করো, ঘুরে বেড়াও, যা-ই করো না কেন পড়াশোনা বজায় রেখেই করতে হবে।’

‘তাই বলে হুট করে অচেনা-অজানা নতুন একটা স্কুলে যাওয়া যায়!’

‘কেন যাবে না? গত বছর ক্লাস সিক্সে তোকে যখন নতুন স্কুলে ভর্তি করলাম তখন স্কুলটা কি খুব চেনা-জানা ছিল?’
‘সেটা তো আলাদা ব্যাপার।’
‘তাহলে এটাও আলাদা ব্যাপার।’
‘কিন্তু—’

‘আর কোনো কিন্তু না। স্কুলে যেতে হবে এটাই শেষ কথা।’

বড় আম্মু এর মাঝে কথা বলার সুযোগ পায় নি। এবার একটু সুযোগ পেয়ে বললো, ‘কিন্তু লাবু বাপজানের এই অবস্থা কী করে হলো!’

‘দেখেন না বড় আম্মু, এই বান্দরগুলো আমাকে কী ভেলকি দেখালো! একেবারে পানিতে চুবিয়ে দিলো!’ রুবেল, সুরুজ, টিপু, মিন্টু, ইলিয়াসকে দেখিয়ে অভিযোগের সুরে বললো লাবু।

‘কি! রুবেল এই কাম করছে! দাঁড়া, তোর বাপে আসুক, তোরে আইজ মজা দেখাইতেছি!’

লাবুর আম্মু বললো, ‘ঠিকই করেছে, উচিত শিক্ষা হয়েছে।’

বড় আম্মু বললো, ‘ঠিকই করেছে মানে! অসুখ করবে না!’

লাবু এবার রুবেলের পক্ষ নিয়ে বললো, ‘অসুখ করবে কেন? আমি কি পুকুরে গোসল করি না? এটা তো একরকম গোসলই। তাই না রুবেল?’

রুবেল মাথা নেড়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দিলো।

লাবু এবার একটু আহ্লাদ করে বললো, ‘বড় আব্বুকে বলার দরকার নাই বড় আম্মু। বড় আব্বুকে বললে রুবেলের হাড় একেবারে গুঁড়ো করে দেবে। আর তাতে আমি কষ্ট পাবো। আপনি কি চান আমি কষ্ট পাই?’

বড় আম্মু এবার একটু টেনে টেনে বললো, ‘ও-ও-ও, আমি তো ভুলেই গেছিলাম যে চোরে চোরে মাস্তুতো ভাই! ঠিকাছে তোমার বড় আব্বারে বলবো না। এখন তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় বদলায় নাও।’
লাবু বললো, ‘ঠিক আছে।’

তারপর আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিন্তু স্কুল—’

হাত নেড়ে লাবুকে থামিয়ে দিয়ে আম্মু বললো, ‘এ বিষয়ে আর কোনো কথা না। কাপড় বদলে স্কুলে যাবার প্রস্তুতি নে।’
লাবু তবুও জোর করে বলে, ‘অন্তত আজকে না গেলে হয় না!’

‘না, আজকে থেকেই শুরু করতে হবে।’
‘কিন্তু, মাত্র পাঁচটা দিনের জন্য তো আমি এখানকার স্কুলে ভর্তি হচ্ছি না, তাই না?’
‘ভর্তি হতে হবে কেন? এমনিই গিয়ে ক্লাস করবি।’

‘স্কুলে যদি আমাকে ঢুকতে না দেয়, যদি বের করে দেয়?’

‘ঠিক আছে, সত্যিই যদি এমন হয় তাহলে তোকে আর স্কুলে যেতে হবে না।’
লাবু আর কথা বাড়ায় না। শেষ একটা আশা তো তবু রইলো।

স্কুলের বিষয়ে কোনো সুরাহা হয় কিনা এটা দেখার জন্যই এতোক্ষণ ভেজা কাপড়ে এখানে দাঁড়িয়ে ছিল সুরুজ, টিপু, মিন্টু আর ইলিয়াস। কোনো সুরাহা হলো না দেখে তারা ফিরে গেলো নিজ নিজ বাড়িতে। লাবু রুবেলের সাথে তার ঘরে চলে গেলো। লাবু আর রুবেল একঘরেই থাকে সবসময়।

ঘরে গিয়ে কাপড় বদলাতে বদলাতে রুবেলকে লাবু বললো, ‘আচ্ছা, তোদের স্কুলে কি আমাকে ঢুকতে দেবে?’
‘দেবে না মানে! আব্বা হেডস্যাররে বইলা রাখছে না!’

‘হেডস্যারকে বলে রেখেছে! তার মানে—’
শেষ আশাটুকুও শেষ হয়ে গেলো! লাবুর ধারণা ছিল এভাবে বিনা ভর্তিতে কোনো স্কুলে কাউকে অ্যালাউ করা হয় না।

রুবেলদের স্কুলে তাই তাকে অ্যালাউ করা হবে না, বের করে দেবে। কিন্তু বড় আব্বু যদি হেডস্যারকে বলে রাখে তাহলে আর সেটা ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। স্কুল থেকে তাই রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না!
রাগে গজরাতে থাকে লাবু। জুয়েল ভাইয়ের কপালে কী আছে কে জানে!

(চলবে)

পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১)

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০২)

লেখক পরিচিতি
মুহসীন মোসাদ্দেক
জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮; রাজশাহী, বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘন অন্ধকারের খোঁজে’ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘি দেয়া গরম ভাত আর চিতল মাছের পেটি’। মাঝে ২০১৩ সালে কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মগডাল বাহাদুর’ প্রকাশিত হয়। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর এমবিএ করেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষায়। বর্তমানে স্বনামধন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করছেন। বই প্রকাশে দীর্ঘ বিরতি চললেও লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন, বিশেষ করে দুরন্তপনার গল্পগুলো। লেখকের কৈশোর জীবন তুমুল দুরন্তপনায় কেটেছে এমনটা নয়, তবু বেশ রঙিন এক কৈশোর কাটিয়েছেন মফস্বল শহরে। রঙিন সে জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ না থাকায় খুব আফসোস হয়। এ আফসোস ঘোচাতেই লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান কৈশোরে আর দুরন্তপনায় মেতে ওঠেন ইচ্ছেমতো। প্রত্যাশা কেবল এতটুকুই, কিছু উপযুক্ত পাঠক সঙ্গী হোক তার লেখার এ দুরন্ত জীবনে।

3 Comments

Leave a Reply

error: Content is protected !!