Saturday, April 20, 2024
সম্পাদক সমীপেষু

আসুন এই মাহে রমজানে সকলেই হয়ে উঠি বিশ্বকে সারিয়ে তোলার একজন দক্ষ কারিগর

আফরিদা খাতুন আঁখি : গতকালের পশ্চিম আকাশের শেষ আলোক গায়ে মেখে সদ্য নীলাম্বরের বুকে সন্ধ্যা তারার আগমনের ঠিক পূর্বে জন্ম লাভ করা হেলাল বয়ে নিয়ে এলো পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা বার্তা। বিশ্বের কোণায় কোণায় অবস্থানরত প্রতিটি বিশ্বাসীর মন আজ উদ্বেলিত, তাদের জীর্ণ হৃদয়েও আজ বয়ে চলেছে প্রশান্তির পরশ। রমজান বিশ্বাসীদের জন্য প্রভু তরফ থেকে আসা এক বিশেষ নেয়ামত, যার ডালি সজ্জিত রহমত, মাগফিরাত আর নাজাত দিয়ে। এই মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে পবিত্র কোরআন, এই মাসের শেষ ভাগেই তো লুক্কায়িত রয়েছে হাজার রাতের চেয়ে উত্তম রাত, লাইলা-তুল-কদর। প্রভুর নৈকট্য লাভের জন্য, পূর্বে উষা কোণে সূর্যোদয় থেকে পশ্চিম দিগন্তে সূর্যের শেষ আলোক রেখা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ ক্ষণের উপবাস বিশ্বাসীদের কাছে পরিণত হয় প্রশান্তিময় উপভোগ্য বিষয়। আর এই কারণেই স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আল আমিন রোজদারদের নিজ হাতে পুরস্কৃত করার সাথেসাথে তাদের ‛রায়হান’ নামক বিশেষ দরজার দ্বারা জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যমে সম্মানিত করার অঙ্গীকার করেছেন।

ইসলামের অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানের সাথে যেমন ভাবে আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিকতা পরস্পরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ঠিক তেমনভাবে মাহে রামজানের সাথেও আধ্যাত্মিকতা ও সামাজিকতার এক অদ্ভুত মেলবন্ধন দেখা যায়। প্রভুর নৈকট্য লাভের জন্য যেমন রাত জেগে ইবদাতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে ঠিক তেমনভাবে এই পবিত্র মাসে দানকেও প্রভুর নৈকট্য লাভের উপায় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে।

কিন্তু এবারের রমজান সমগ্র বিশ্বের কাছে এক ভিন্ন রমজান। এই ভিন্ন রমজানের স্বাদ যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজা, সিরিয়া, কাশ্মীর, অনাহারক্লিষ্ট ইয়েমেন অথবা বিতাড়িত রোহিঙ্গা জাতি বছরের পর বছরের অনুভব করলেও বিশ্বের আর অন্যান্য দেশ এই অনুভূতির বাইরে। প্রতি বছর যেখানে রমজান মাসে ধুম লাগত, সকলে ইফতার মজলিসে মিলিত হবার সেখানে এই বছর আপন গৃহেই ইফতার করা হয়ে উঠেছে বাধ্যতামূলক। এই পবিত্র মাসে যেখানে মসজিদগুলোতে তারাবিহ পাঠ করার জন্য দল দল মুসুল্লিদের সমাহরহ ঘটতো সেখানে এই বছর আপন গৃহেই তারাবিহ পাঠই হয়ে উঠেছে এক জন মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক। কোভিড নাইনটিন প্রকোপে বদলে দিয়েছে আমাদের সাধারণ জীবন ব্যাবস্থা।

বিধ্বস্ত গাজাবাসীদের ইফতারের প্লেটে ইফতার সামগ্রীর বদলে ইসরাইলের বোমা দেখেও যে উম্মাহ আপন ইফতার আর সেহরীর প্লেট সাজাতে মহাব্যাস্ত ছিল তাদের সম্মুখে আজ এক ভিন্ন রমজান উপস্থিত হয়েছে। একমাসের এই দীর্ঘ লকডাউন দিগন্ত থেকে দিগন্তে প্রস্তুত হতে চলেছে ক্ষুধার্ত মানুষের সারি এ শুধু আমার আশঙ্কা না স্বয়ং জাতিসংঘের প্রধানের এই আশঙ্কা। এই দুর্ভিক্ষের ভিড়ে সকলেই প্রায় এক পর্যায়ে পৌঁছাতে চলেছে। তার পরেও যে সমস্ত ধনাঢ্য ব্যাক্তি এই পবিত্র মাসে অন্য দের ক্ষুধা নিবারণের ব্যাপারে গাফিল হয়ে নিজের ইফতারের মেনুতে আড়ম্বরের রুপ দিতে ব্যাস্ত তারা যে প্রভুর কাছে কোনভাবেই একজন উত্তম বান্দা হিসাবে গণ্য হবেনা সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। যেখানে স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (ﷺ) সাধারণ দিনেই প্রতিবেশীর ক্ষুধা নিবারণে বারবার উৎসাহ দিয়েছেন সেখানে এই দুর্দিনে আপন সুখে মত্ত থাকা ব্যাক্তি কখনোই তাঁর প্রকৃত উম্মাহর দলে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না।

কোভিড নাইনটিন প্রকোপে আজ সমগ্র বিশ্ব ক্ষুধা আর মৃত্যু যন্ত্রণাতে জুজছে প্রতিনিয়ত। দিন দিন বিশ্ব যেন ধারণ করছে মৃত্যুর ফ্যাকাশে রঙ, এই ধরণী তার বুকে লাশের পাহাড় জমা করতে করতে আজ বড়ই ক্লান্ত। যে মুসলিম উম্মাহকে দান করা হয়েছে সমস্ত কিছুর শ্রেষ্ঠত্ব সেই উম্মাহর পূর্বের দিন গুলোর রমজানের মত এই রমজানে নিজের সেহরী আর ইফতারের প্লেট হরেকরকমের খাবার দিয়ে সাজাতে ব্যস্ত থাকা কোন দিক থেকেই কাম্য না। বরং এই মূহুর্তে প্রতিটি উম্মাতের দুর্দিনে রাত্রিগুলো ইবদাত বন্দেগী এবং দিন গুলো জাতি ধর্ম নির্বিশেষে নিজ নিজ প্রতিবেশীর ক্ষুধা নিবারণে ব্যাস্ত থাকার মাধ্যমে প্রভুর নৈকট্য লাভ করা উচিত।

আজ এই বিশ্ব মারাত্মকভাবে অসুস্থ, আসুন এই পবিত্র রমজানে আমরা প্রতিটি রোজদার বান্দা হয়ে উঠি তাকে সারিয়ে তোলার এক একজন দক্ষ সেবক অথবা সেবিকা। এই রমজানে উন্মুক্ত করুন নিজের হৃদয়কে, দানকে করে তুলন নিজের হৃদয়ের অলংকার নিজের প্রতিপত্তির অলংকার না। নিজের ক্ষুধার নিবারণের সাথে সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন অন্যের ক্ষুধা নিবারণে কারণ আপনি সেই নবীর উম্মত, একজন রাষ্ট্রনায়ক হওয়ার পরেও যাঁর ঘরে মাঝে মধ্যেই চুলা জ্বলতো না। মহামারীর চলাকালীন সময়ে নবী মুহাম্মদ (ﷺ) আদেশ মান্য করে এই বিশ্বকে সেরে উঠতে সাহায্য করুন। এই রমজান দান, ইবাদত বন্দেগির পবিত্রতাতে স্নাত হোক প্রতিটি বিশ্বাসী হৃদয়। আতঙ্ক, যন্ত্রণা সমস্ত কিছু জয় করে এই বিশ্ব যদি সেরে ওঠে সকলের সাথে সাথে আপনি ও ভালো থাকবেন, আগামী বছর পাবেন আবার সেই হাসিখুশি রমজান।

লেখিকা : রিসার্চার, সোসিও এডুকেশানাল রিসার্চ সেন্টার (সার্ক)

Leave a Reply

error: Content is protected !!