Thursday, March 28, 2024
Latest Newsফিচার নিউজসম্পাদক সমীপেষুসম্পাদকীয়

‛দিরিলিস: আরতুগ্রূল’ – তরুণ প্রজন্ম উত্তর খুঁজে পাচ্ছে এই ওয়েব সিরিজের মাধ্যমে

আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ ফলে তারা যেটাকে সাহিত্য মনে করছেন তাই শুধু সাহিত্য বা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে৷ সেখানে মুসলিমরা কেমনভাবে উঠে আসছে, বা আদৌ থাকছে কি না, সেই প্রশ্ন এতদিন কেউ করেনি৷ কিন্তু তথাকথিত মেইনস্ট্রিম কালচারের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতি ভ্রূ কুঁচকে তাকানো শুরু হয়েছে৷ আর তরুণ প্রজন্ম তার উত্তর খুঁজে পেয়েছে আরতুগ্রূল সিরিজের মধ্যে৷ লিখছেন – গোলাম রাশিদ

তারা সবসময় নামাযের টুপি পরে থাকে, কথায় কথায় ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে কিংবা, আরবি-উর্দু শব্দ ছাড়া কথা বলতে অক্ষম। ওরা খুব ঝগড়া-প্রিয়, সবাই দাড়ি রাখে, চোখে সূরমা লাগায়, পাঞ্জাবি পরে থাকে, কোনও মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সমুদ্র খুঁজতে চেষ্টা করে না৷ হাঙ্গামা, খারাপ কাজ, নিষ্ঠুরতা সবই মুসলিমদের কাজ৷ ফিল্মে ওরা শুধু খলনায়ক চরিত্রেই মানানসই৷ ওরা এত খারাপ যে, ‛বিসমিল্লাহ’ বলে মানুষের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়৷ ওরা এমনই, তাই ইতিহাসের তোয়াক্কা না করেই সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ‛পদ্মাবত’ সিনেমায় নিষ্ঠুর, নরমাংসভোজী, অসভ্যতার প্রতীক হয়ে ওঠেন৷ কিংবা, বর্তমানে দুবাই, মুম্বইয়ের মাফিয়া ডন৷ মুসলিমরা ইতিহাসের আয়নায় হয় অসভ্য, নয় নিষ্ঠুর, অত্যাচারী জানোয়ার৷ কিন্তু…সৌভাগ্যক্রমে ও আশ্চর্যজনক ভাবে তুরস্কে নির্মিত ‛দিরিলিস: আরতুগ্রূল’ সিরিজে মুসলিম চরিত্রগুলিকে এই স্টিরিওটাইপের মধ্যে বেঁধে ফেলা হয়নি৷ পরিচালক মেহমেত বোজদাগ তাদের অন্য ভাবে এঁকেছেন৷ আসলে মুসলিমরা যা, যেভাবে তাদের মন একজন প্রকৃত মুসলিমকে দেখতে চায়, ঠিক সেরকম ভাবেই গড়ে উঠেছে এই ধারাবাহিক চিত্রের কাহিনি৷

এ বছরের প্রায় শুরু থেকেই বিশ্ব কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই করে চলেছে৷ সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখতে জারি করা হয়েছে লকডাউন৷ তবুও করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না৷ করোনার ঠিক বিপরীত প্রান্তে দিরিলিসের জনপ্রিয়তাও আর্তুলগালির দৌড়ের গতির মতো (আরতুগ্রূলের ঘোড়া) বেড়েই চলেছে৷ ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরাই থেকে শুরু করে (যিনি তুর্কি ‛বে’-এর টুপি পরে ছবিও তুলেছেন) পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, তুরস্কের রাষ্ট্রপতি এরদোগান কিংবা বিশ্বের কোটি কোটি দর্শক আরতুগ্রূলকে গ্রহণ করেছেন৷ ত্রয়োদশ শতকে ওসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে সুলতান ওসমানের পিতা আর্তুরুল বা আরতুগ্রূলের অকুতোভয় লড়াকু জীবনই কি শুধু এতে প্রাণ সঞ্চার করেছে? ভিএফএক্স, এসএফএক্স, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয় দক্ষতা আর কাহিনির অসামান্য বুনোটই কি দর্শককে আটকে রাখছে স্মার্টফোন বা টিভির পর্দায়? নাকি অন্য কিছু, যা মুসলিম তরুণ-তরুণী, যারা বুদ্ধির পরপর শুধু ছি ছি শুনতেই অভ্যস্ত, যারা মুসলিমদের চাকর, খানসামা, বিশ্বাসঘাতক কিংবা খলনায়ক চরিত্রেই দেখে অভ্যস্ত৷ এইসব তাদের মনে যে গ্লানির সৃষ্টি করেছিল, তারই কি উপশম দিচ্ছে এই আরতুগ্রূল? সে একজন মুসলিম বীর যোদ্ধা, যে তরবারি চালিয়ে খ্রিস্টান নাইট বা দুর্ধর্ষ মোঙ্গলদের পর্যদুস্ত করতে পারে, যে অসাধারণ মানবিকতা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে গোষ্ঠীর সংকট নিরসন করে, সে-ই আবার রোমান্টিক ভাবে একজনকে ভালোওবাসতে পারে৷ যে মুসলিম তরুণতরুণীরা রোল মডেল বা নিজস্ব সংস্কৃতির কোনও ছাপ ‛গেম অব থ্রোনস’ বা অন্য কিছুতে দেখতে পাচ্ছিল না, সেই আত্মমর্যাদাটুকুর চিত্রায়ণই কি তাদের এটা দেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করছে? বিশ্বের ৬০ টির বেশি দেশের কোটি কোটি মানুষ আরতুগ্রূল সিরিজজ্বরে আক্রান্ত৷ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলিতেও এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ পাশ্চাত্যের পপ কালচারকে হারিয়ে এরদোগানের দেশে তৈরি হওয়া টিভি সিরিজ ঢুকে পড়েছে সেখানেও৷ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এটি দেখার পর মুগ্ধ হয়ে সেটি উর্দুতে ডাবিং করে পিটিভিতে সম্প্রচারের নির্দেশ দেন৷ এ বছরের ১ রমযান থেকে দিরিলিস: আরতুগ্রূল উর্দুতে সম্প্রচারিত হওয়ার পর থেকে আনাতোলিয়ার ঝড় সারা বিশ্বসহ দক্ষিণ এশিয়ায় আছড়ে পড়েছে যেন৷ জনপ্রিয়তায় বিশ্বের সব সিরিজকে ছাপিয়ে গেছে আরতুগ্রূল৷ মুসলিম ইতিহাসকে উপজীব্য করে বেশকিছু চলচ্চিত্র ও সিরিজ এর আগেও নির্মিত হয়েছে৷ মহানবী সা. (দ্য মেসেজ, মুহাম্মদ: দ্য মেসেঞ্জার অব গড) থেকে শুরু করে খিলাফতে রাশিদিন (ওমর সিরিজ বেশ জনপ্রিয়), সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর উপর সিরিজ রয়েছে। নবী জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত ‛দ্য মেসেজ’ ভালোই জনপ্রিয়৷ তবে দর্শকদের চাহিদার ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী সব সিনেমা ও সিরিজকে ছাড়িয়ে গেছে দিরিলিস: আরতুগ্রূল । কারণ কাহিনির সঙ্গে সঙ্গে প্রোডাকশনও খুবই উন্নতমানের যা যে কোনও বয়সের দর্শককে স্ক্রিনে আটকে রাখতে সমর্থ হয়েছে৷ আর এই সময়টাতে স্ক্রিনে মুসলিমদের উপস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে এনেছে৷

ওসমানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানের পিতা আরতুগরুল গাজীর লড়াকু, সাহসী জীবন নিয়েই এই সিরিজের কাহিনি তৈরি হয়েছে পাঁচটি সিজনে৷ ইতিহাসে যদিও পর্যাপ্ত তথ্য নেই আরতুগ্রূলকে নিয়ে, তবুও মূল ঘটনাকে অবিকৃত রেখেই এটি তৈরি হয়েছে৷ নেতৃত্বশূন্যতা মুসলিমদের মনকে যখন হতাশায় ডুবিয়ে রেখেছিল, ঠিক তখনই এশিয়ার মালভূমিতে যাযাবর জীবনযাপনকারী ছোট্ট কায়ি গোষ্ঠীর নেতা সুলাইমান শাহ ও হাইমে হাতুনের ঘরে করে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে জন্ম নেন আরতুগ্রূল । সাহসিকতার সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার মিশেল তার জীবনকে মহিমান্বিত করে তুলেছে৷ বর্তমান প্রজন্মের যুবকরা দেখছে সর্বক্ষেত্রে মুসলিমরা চাপে পড়ে পর্যদুস্ত৷ করোনা ছড়ানোর ভুয়ো অভিযোগ তুলে সামাজিক ও অনলাইন জীবনে তাদের হেনস্থা করা হচ্ছে৷ তখন সেই পরিস্থিতিতে আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগতে থাকা যুবকরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব খুঁজে পেতে চেষ্টা করছে এই কাহিনিতে৷ এই কাহিনিতেও কুরতুগলু, কোচাবাস, নাসেরদের মতো স্বার্থপর, কুটিল চক্রান্তকারী মুসলিম রয়েছে, কিন্তু জয় সেই ভালো মুসলিমদেরই৷ কোনও ভাবেই বিকৃত করা হয়নি ঈমানদার মুসলিম চরিত্রকে৷ মুসলিমরাও প্রোটাগনিস্ট হতে পারে তা এই সিরিজ প্রমাণ করে দিয়েছে৷ ঐতিহাসিক এই সিরিজে আরতুগরুলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুর্কি অভিনেতা এনজিন আলতান দোজায়তান৷ তার অনবদ্য অভিনয়ও দিরিলিস: আরতুগ্রূলের দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তার সহযোগী বামসি, তারগুত, দোগান চরিত্রগুলি দর্শকদের মন জয় করেছে৷ সমকালীন দার্শনিক ইবনে আরাবির উপস্থিতি এর অনন্য বৈশিষ্ট তুলে ধরেছে৷ তুর্কি মুসলিমদের আত্নপরিচয়ের, হারানো ইতিহাসের স্বরূপ সন্ধানও এতে করা হয়েছে। মেহমেত বোজদাগ অসাধারণ একটি কাজ উপহার দিয়েছেন৷ নারী চরিত্রগুলিকে তিনি অসাধারণ সাহসী ও নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন দেখিয়েছেন৷ বাংলা, হিন্দি সিরিয়ালের মতো তারা খালি কান্না ও কুটিল চক্রান্ত করে সময় কাটায় না৷ তারা প্রয়োজনে তরবারি চালাতে পারে ও গোষ্ঠী পরিচালনাও করতে পারে৷ হাইমে মা, হালিমা সুলতানা চরিত্রগুলি এ জন্যই জনমনে জায়গা করে নিয়েছে৷

কোভিড-১৯ এর প্রেক্ষাপটেও দেশে মুসলিম বিরোধী প্রপাগান্ডা জারি থেকেছে৷ করোনা ভাইরাস ছড়ানোর ভুয়ো অপবাদ দিয়ে মুসলিম ও ইসলামকে কলুষিত করার অপচেষ্টা হয়েছে৷ এর ফলে নড়েচড়ে বসেছে আরব দেশগুলিও৷ বিশ্বজুড়ে ইসলামোফোবিয়ার মোকাবিলা করতে আধুনিক প্রজন্ম আগ্রহী৷ তুরস্ক, পাকিস্তান ও মালয়শিয়ায় তিন রাষ্ট্রপ্রধান কয়েক মাস আগে এক আলোচনায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পশ্চিমা টেলিভিশন ও মিডিয়ায় যেভাবে ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে ও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে তারা একজোট হয়ে লড়বে৷ একটি আন্তর্জাতিক ইংরেজি মাধ্যম চ্যানেলের কথাও তারা চিন্তা করেন৷ আরতুগরুল অনেকটা সেই প্রচেষ্টারই আগাম একটি উদাহরণ৷ পশ্চিমা মিডিয়া ও ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মুসলিমদের বরাবরই অসভ্য, সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে৷ অন্যদিকে, মুসলিম দেশগুলোর চিত্রনির্মাতারাও ইতিহাস, ঐতিহ্যের উপর তেমন একটা গুরুত্ব দিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন না তথাকথিত সেকুলারিজম রক্ষা করতে গিয়ে৷ ফলে মুসলিমরা ‛আদার’ হিসেবেই রয়ে যেতে থাকে৷ অথচ তাদেরও জীবন সংকট, আনন্দ, হাসি, কান্না রয়েছে৷ সেগুলোর কোনও উপস্থাপনা নেই মূলধারার মিডিয়ায়৷ আমেরিকার র‍্যামি ইউসেফের ‛র‍্যামি’ ওয়েব সিরিজ বা আরতুগরুল সেই অভাবকেই পূরণ করার চেষ্টা করেছে৷ আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ ফলে তারা যেটাকে সাহিত্য মনে করছেন তাই শুধু সাহিত্য বা চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে৷ সেখানে মুসলিমরা কেমনভাবে উঠে আসছে, বা আদৌ থাকছে কি না, সেই প্রশ্ন এতদিন কেউ করেনি৷ কিন্তু তথাকথিত মেইনস্ট্রিম কালচারের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার প্রতি ভ্রূ কুঁচকে তাকানো শুরু হয়েছে এবার৷ আর তরুণ প্রজন্ম তার উত্তর খুঁজে পেয়েছে আরতুগরুল সিরিজের মধ্যে৷ পাশ্চাত্য ভাবধারার বাইরে গিয়ে শালীনতা ও নৈতিকতার মানদণ্ড বজায় রেখে কোটি কোটি মানুষের মনজয় করে বিশাল আর্থিক সাফল্যও যে পাওয়া যায়, তারও প্রমাণ এই ঐতিহাসিক ড্রামা সিরিজ৷ ভালো প্রোডাকশন, স্টোরিলাইন মন কাড়তে পারে দর্শকের৷ মুসলিমদের কাহিনি বা চরিত্র নিয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র বা সিরিয়াল নির্মাণ করা যায় না, এমন পূর্বধারণাকেও ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে দিরিলিস: আরতুগ্রূল৷

 

আরও খবরাখবর পেতে যোগ দিন আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রূপে

Leave a Reply

error: Content is protected !!