Wednesday, March 12, 2025
গল্পফিচার নিউজশিল্প-সাহিত্য

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৬)

মুহসীন মোসাদ্দেক

 

(পূর্ব প্রকাশের পর)

টিফিন খেতে সবাই মিলে বাড়িতে আসে। সবাই একসাথে রুবেলদের বাড়িতেই আসে। লাবু যে কয়দিন থাকে প্রায় ক্ষেত্রেই সবাই একসাথে থাকে। এমনকি রাতে ঘুমানোর সময়ও কোনো কোনো দিন সবাই একসাথে থাকে, রুবেলের ঘরের মেঝেতে বিছানা করে।

ওরা ছয়জন, বড় আব্বু আর হারুন ভাই একসাথে খেতে বসে। বড় আম্মু ও আর লাবুর আম্মু খাবার বেড়ে দেয়। জুয়েল ভাই দুপুরেও বাড়িতে আসে না। আসলে দুপুরে খাবারের সময়ই জুয়েল ভাইকে এক পর্ব শিক্ষা দেয়া যেত!

অনেক রকম খাবার রান্না করেছে বড় আম্মু। মাছ, মাংস, ডাল, সবজি, ভর্তা—বেশ কয়েক রকম পদ রান্না করা হয়েছে।
লাবু আর বড় আব্বু পাশাপাশি বসেছে। খেতে খেতে বড় আব্বু লাবুকে বললো, ‘স্কুল কী রকম লাগলো বাপজান?’
‘ভালো-মন্দ দুটোই। তবে আপনার সাথে আমি কথা বলবো না!’

‘কেন বাপজান!’

‘বেড়াতে এসেছি, কোথায় ঘুরে বেড়াবো, মজা করবো, তা না—আপনি আমার স্কুলে যাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন!’

‘স্কুলে যেয়েও তো মজা করা যায়। সবচেয়ে বেশি মজা তো স্কুলেই হয়। ক্যান, স্কুলে কোনো মজা হয় নাই?’

‘তা একটু হয়েছে।’

‘তাহলে? স্কুলেই মজা করবা।’

‘জানো আম্মু—’ লাবু উৎসাহী হয়ে বলে, ‘শেফালি নামের একটা মেয়ে আছে, ওর রোলও তিন। আমি ভুল করে তিন রোলের সময় প্রেজেন্ট দিয়ে দিয়েছিলাম। ওদিকে শেফালি প্রেজেন্ট দিয়েছে, এদিকে আমিও দিয়েছি, একই সাথে। তারপর যে কী অবস্থা!’

‘মজা তো!’ আম্মুও উৎসাহী ভাব করে।
‘আর জানো, মেয়েটা না খালি হাসে! কথা নাই বার্তা নাই, খালি পাগলির মতো হাসে! হাসির রোগ আছে মনে হয়!’

কথা শুনে আম্মুও হাসে।

‘আম্মু—’ এবার একটু অনুনয় করে বলে লাবু, ‘টিফিনের পর আর স্কুল না গেলে হয় না?’

‘কেন? যাবি না কেন? মজা হচ্ছে তো।’
‘কিন্তু আজান স্যারের ক্লাস আছে!’ ঠোঁট উল্টিয়ে বলে লাবু।

‘আজান স্যার!’ আম্মু ভ্রু কুঁচকায়।
‘হুম, আজান স্যার। খামচি দেয়!’

‘খামচি দেয়!’ আম্মু আবার ভ্রু কুঁচকায়।
‘তা আর বলছি কি!’

‘স্কুলে যাবি না বলে টালবাহানা করছিস, না?’

‘মোটেই না। তুমি রুবেলকে জিজ্ঞেস করে দেখো।’

রুবেলকে জিজ্ঞেস করা লাগলো না, নিজেই বললো, ‘সত্যিই ছোট আম্মা। স্যার খামচি দেয়!’

ইলিয়াস গোঁ গোঁ করে বলে, ‘তোদের তাতে কি! খামচি তো আইজ আমারে খাইতে হবে!’

সবাই হেসে ফেলে। কিছু না বুঝেও আম্মু-বড় আব্বুরাও হেসে ফেলে।
লাবু ডান হাত চেটে নিয়ে দুই হাত আম্মুর সামনে মেলে দেয়, ‘দেখো আম্মু—’

ডান হাতেরটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না, বাম হাতেরটা কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। আম্মু দেখে বললো, ‘কী হয়েছে?’

‘ইংরেজি স্যার মেরে লাল করে দিয়েছে।’ ঠোঁট ফোলায় লাবু।

‘কি! স্যার মেরেছে! স্যাররে আমি দেখতেছি।’ বড় আব্বু হুংকার ছোড়ে।
আম্মু বলে, ‘কী করেছিলি তুই?’

‘প্যারাগ্রাফ লিখে দুইটা বানান ভুল করেছিলাম।’

আম্মু নির্দয়ের মতো বলে, ‘মার খেলেও স্কুল মাফ নাই। এখন চুপচাপ খা। টিপু-মিন্টুর খাওয়া শেষ। খাওয়াতে তো তুই লাস্ট হবি।’

লাবু গপাগপ খেতে থাকে। স্কুল যাওয়ায় যখন মাফ নেই তখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ কি!

খাওয়া শেষে আবার একসাথে স্কুলে যাওয়া। আবার পথে নানা দুষ্টুমি। টিফিনে আসার সময় ব্যাগ নিয়ে আসা লাগে না। যার যেখানে ব্যাগ ছিল সেভাবেই থাকে। ক্লাসে ঢুকেই ইলিয়াস আর সুরুজের মধ্যে আবার ঝামেলা লেগে যায়। এবার ইলিয়াস সুরুজকে টেক্কা দিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত তাদের ঝামেলা মেটাতে লাবুকে গা পেতে দিতে হয়। সুরুজ-ইলিয়াস দুজনকেই ভেতরে চাপিয়ে দিয়ে সে-ই ধারে বসে। সকালের মতো এখন আর তার বিব্রত লাগে না। আজান স্যারের খামচির স্বাদ সে তাই চেখে দেখতে চায়!
ধারে বসা নিয়ে ঝামেলা মিটতেই শেফালি ক্লাসে আসে। এসেই লাবুকে ডাকে, ‘ওই লাবু, একটু শুইনা যাও।’ খিলখিল করে হাসে না, কিন্তু হাসি হাসি মুখে বলে।
লাবু এগিয়ে গিয়ে বলে, ‘কী, বলো।’
‘তুমি কথা কও। তোমার কথা শুনি।’
লাবু হেসে ফেলে, ‘আমার কথা শুনে তুমি কী করবে?’

‘এই যে তুমি কী রকম ঢঙ কইরা কথা বলতিছো, শুনতে ভালো লাগতিছে।’
লাবু খিলখিল করে হেসে ওঠে।

সুরুজ তেড়ে আসে, ‘ওই শেফালি, লাবুর সাথে ফাইজলামি করবি না। খবর কইরা দিবো কইলাম।’

‘আমি ফাইজলামি করলাম কই! ওর কথা শুনতে ভালো লাগতিছে, তাই ওরে কথা কইতে কইলাম।’

‘কথা শুনতে ভালো লাগতিছে তাই কী—কাম নাই কাইজ নাই, ওই এখন সারাদিন খাড়াইয়া খাড়াইয়া তোমারে কথা শুনাইবো! ওই কি রেডিও!’

‘কথা শুনাইবো ওই, তোর লাগতিছে ক্যান?’

সুরুজ আবার তেড়ে-ফুঁড়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল লাবু বাধা দিলো, ‘আরে থাম তো, তুই শেফালির সাথে ওরকম করছিস কেন? ও তো খারাপ কিছু বলে নাই।’

‘ও—’ সুরুজ মুখ বাঁকিয়ে বলে, ‘যার জন্য করি চুরি সেই কয় চোর! ঠিকাছে, তুমি সারাদিন ওরে কথা শুনাও, আমি নাই।’

‘তোরে এইখানে কেউ থাকতে কয় নাই। যা ভাগ—’ শেফালি মুখ ঝামটা দিয়ে বলে।
সুরুজ জবাব দেয়ার সুযোগ পায় না, আজান স্যার চলে আসে। সবাই হুটোপুটি করে নিজ নিজ বেঞ্চে নিজ নিজ জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

স্যার সামনে দাঁড়িয়ে পুরো ক্লাসে একবার চোখ বোলায়। তারপর প্রথম বেঞ্চ থেকে খামচি দেয়া শুরু করে। দুইসারি বেঞ্চের মাঝ দিয়ে ধীরে ধীরে হেঁটে যায় আর দুই হাত দিয়ে দুই পাশের বেঞ্চের ধারে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের পেটে খামচি দিতে থাকে। ‘উহ! আহ!’—করে কঁকিয়ে ওঠে দু-একজন। লাবুর পেটের কাছে স্যারের হাত আসতেই লাবু ঝট করে একটু কুঁজো হয়ে তার পেটটাকে সরিয়ে নেয়। স্যারের হাতও মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। তারপর লাবুকে পাশ কাটিয়ে স্যার পেছনে চলে যায়। লাবুর পেটে আর খামচি পড়ে না।
খামচাখামচি শেষে স্যার একটা পৃষ্ঠা রিডিং পড়তে বলে টেবিলে মাথা রেখে ঝিমায়। লাবুর অবাক লাগে। এ আবার কেমন স্যার!

বাকি ক্লাসগুলোতে আর বিশেষ কিছু বা মজার কিছু কিংবা উদ্ভট কিছু ঘটলো না। স্বাভাবিকভাবেই ক্লাসগুলো শেষ হলো। এবং শেষ হলো এই স্কুলে লাবুর প্রথম দিনের পর্ব।

(চলবে)

পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১)

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০২)

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৩)

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৪)

ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৫)

লেখক পরিচিতি
মুহসীন মোসাদ্দেক
জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮; রাজশাহী, বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘন অন্ধকারের খোঁজে’ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘি দেয়া গরম ভাত আর চিতল মাছের পেটি’। মাঝে ২০১৩ সালে কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মগডাল বাহাদুর’ প্রকাশিত হয়। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর এমবিএ করেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষায়। বর্তমানে স্বনামধন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করছেন। বই প্রকাশে দীর্ঘ বিরতি চললেও লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন, বিশেষ করে দুরন্তপনার গল্পগুলো। লেখকের কৈশোর জীবন তুমুল দুরন্তপনায় কেটেছে এমনটা নয়, তবু বেশ রঙিন এক কৈশোর কাটিয়েছেন মফস্বল শহরে। রঙিন সে জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ না থাকায় খুব আফসোস হয়। এ আফসোস ঘোচাতেই লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান কৈশোরে আর দুরন্তপনায় মেতে ওঠেন ইচ্ছেমতো। প্রত্যাশা কেবল এতটুকুই, কিছু উপযুক্ত পাঠক সঙ্গী হোক তার লেখার এ দুরন্ত জীবনে।

1 Comment

Leave a Reply

error: Content is protected !!