মুহসীন মোসাদ্দেক
(পূর্ব প্রকাশের পর)
টিপুর কাছ থেকে দিয়াশলাই নিয়ে লাবু চুলা জ্বালানোর চেষ্টা করতে থাকে। টিপু দুইটা ফড়িং ধরে এনেছে। ফড়িং দুইটাকে একটা পলিথিনে ভরে রাখে। পলিথিনে কয়েকটা ফুটো করে দেয় যাতে বাতাসের অভাবে ফড়িং দুইটা মরে না যায়।
বহু কষ্টে চুলা জ্বালানো হলো। জ্বালানোর এক পর্যায়ে এমন ধোঁয়া তৈরি হয় যে চোখের সামনের সব অন্ধকার হয়ে যায় আর কাশতে কাশতে জান খারাপ হয়ে যায়।
চুলা জ্বালিয়ে একটু স্থির হয়ে বসতেই রুবেল-সুরুজ চলে আসলো। তেল-ডিম-আঁচার নিয়ে এসেছে ওরা, সাথে বেশকিছু লাকড়ি আর কলাপাতাও কেটে নিয়ে এসেছে।
ওরা এসে নামতেই লাবু বলে, ‘কোনো সমস্যা হয় নি তো!’
‘আরে না, সমস্যা হইবো ক্যান!’ সুরুজ বলে।
‘তবে, আঁচার নিতে গিয়া ধরা পইড়া যাইতেছিলাম।’ রুবেল বলে।
‘কোথায় থেকে আঁচার নিয়ে এসেছিস?’
‘শেফালিদের বাড়িত থেইকা।’ সুরুজ দাঁত বের করে চোখ নাচাতে নাচাতে বলে।
শেফালি একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘আর কোরো বাড়িত আঁচার নাই, আমগো বাড়িত থেইকাই আনা লাগলো!’
রুবেল বলে, ‘তোদের বাড়িরগুলাই একটু নাগালের মধ্যে ছিল।’
‘কয়টা পেয়ারাও নিয়া আসছি।’ সুরুজ পকেট থেকে পেয়ারা বের করে। তারপর সবার ভেতরে বণ্টন করে দেয়।
শেফালি আর ঘাঁটায় না। সুরুজ যেভাবে শেফালিদের পেয়ারা গাছটাকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলছে তাতে আর কিছু বলাও সাজে না।
লাবু বললো, ‘সাবধানে যাওয়া-আসা করেছিস তো! কেউ দেখে নি তো আবার!’
‘আরে নাহ, কেউ দেখে নাই। আমরা তুফানের মতো গেছি, আবার তুফানের মতো চইলা আসছি।’ সুরুজ একটা পেয়ারাতে কামড় দিয়ে বলে।
‘দোকানে ৮৫ টাকা বাকি থাকলো। দুইহালি ডিম আর এক পোয়া সয়াবিন তেল। এখন কোনো কারণে আব্বা কিংবা হারুন ভাই দোকানে না গেলেই হইলো!’ রুবেল বললো।
সুরুজ যোগ করে, ‘শেফালির মা-ও আঁচারের বোয়াম খোঁজ না করলেই হইলো।’
লাবু বলে, ‘পুরো বোয়াম আনতে গেলি ক্যান?’
‘ইচ্ছা কইরা তো আর আনি নাই। আঁচার নেয়ার জন্য দোকান থেইকা একটা বাড়তি পলিথিন নিয়া রাখছিলাম। শেফালিদের বাড়ির বাইরে একটা মাচায় আঁচারের বোয়াম রোদে দেয়া ছিল। সেইখান থেইকা পলিথিনে ঢালতে যাবো এই সময় দেখি কে জানি আসতিছে। তারপর পুরা বোয়াম নিয়াই দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে নদীর ঘাট।’
শেফালি রাগ রাগ ভাব করে সুরুজের দিকে তাকায়। সুরুজ পাত্তা দেয় না।
মিন্টু টিপুর ফড়িং সংক্রান্ত কাহিনি রুবেল-সুরুজের সামনে উপস্থাপন করে। রুবেল-সুরুজ মাথা ঘামায় না। তরমুজের বিষয়টা বলা হয়। এবার বেশ আগ্রহী হয়। নৌকার পাটাতনের নিচে পানিতে চুবিয়ে রাখা হয় তরমুজ দুইটা। চরে পড়ে থাকলে গরম হয়ে যাবে, খেতে ভালো লাগবে না। পানিতে থাকলে ঠাণ্ডা থাকবে, খেতেও ভালো লাগবে।
রান্নার পর্ব শুরু হয়। হাঁড়িতে সবকিছু একসাথে করাই ছিল। তেল আর পানি দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে তুলে দেয়া হলো চুলায়। রান্নার দায়িত্ব শেফালির হাতে থাকলেও সবাই হাত লাগায়। প্রচণ্ড বাতাসে চুলা জ্বলতে সমস্যা করে। খড়-লাকড়ি ফুরিয়ে আসতে থাকে। আবার লাকড়ি যোগাড় করতে চরে অভিযান শুরু হয়। টিপুকে যেতে দেয়া হয় না। তাকে চুলার পাশে বসিয়ে রাখা হয় জ্বাল ঠেলতে।
খিচুড়ি প্রায় হয়ে আসলে খুব সুন্দর সুবাস ছড়ায়। সে সুবাসে সবার পেটের ভেতরে চোঁ চোঁ করতে থাকে। এই অবস্থায় শেফালির ঘাড়ে রান্নার পুরো দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে সবাই নদীতে গোসল করতে যায়। শেফালির আর যাওয়া হয় না।
নদীতে ইচ্ছেমতো ঝাঁপাঝাঁপি করতে থাকে লাবুরা। নিজেদের জামা দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে মাছ ধরতে চেষ্টা করে। মাছ ধরা পড়ে না, বালি উঠে আসে, আর বালির ভেতর দু-একটা চিংড়ির পোনা দেখা যায়। পোনাগুলো ছেড়ে দেয়। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর মাছ ধরায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পানির নিচে বালিতে অনেক শামুক-ঝিনুক থাকে। ডুব দিয়ে পানির নিচে বালি থেকে শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করতে শুরু করে। ঝিনুকে নাকি মুক্তা থাকে। একটা কোনোরকমে জুটে গেলে আর দেখা লাগবে না—বিরাট হুলুস্থুল কাণ্ড ঘটে যাবে। শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করে নৌকায় জমা করে। পড়ে সেগুলো ফাটিয়ে দেখা হবে।
এভাবে পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করতে করতে সবার চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। চোখ লাল করে ফেলে সবাই। লাবু-টিপুর হাঁচি পড়তে থাকে। এই অবস্থায় গোসলে ইস্তফা দিয়ে উঠে আসে ওরা। ভেজা জামাগুলো দিয়েই মাথা মুছে নৌকায় মেলে দেয় শুকাতে। আর প্যান্ট তো পড়ে থাকা অবস্থায়ই শুকাতে হবে। চরের এক পাশে কিছুক্ষণ সারি হয়ে সবাই দাঁড়িয়ে থাকে প্যান্ট শুকাতে। চরে রোদ যেমন আছে, বাতাসও তেমন আছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার মনে হতে থাকে—প্যান্ট শুকাতে শুরু করেছে। অর্থাৎ, টিপুর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সঠিক আছে!
‘হইছে, হইছে, আর বকবক করা লাগবো না। খাইতে থাক।’ শেফালি লাজুক লাজুক ভাব করে বললেও গলে যায় না। এই ধরনের প্রশংসা সুরুজের একটা চালও হতে পারে! পেয়ারা পাড়ার ফ্রি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য এই ধরনের প্রশংসা সুরুজের যে একটা কৌশল নয়, তা কে বলতে পারে!
এবার সবাই নড়েচড়ে ওঠে। লাবু বলে, ‘হ্যাঁ মিন্টু, শুরু কর।’
মিন্টু গান ধরে। নদী নিয়েই গান—‘ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’—এই গানটা ধরে মিন্টু। বাকিরা তাল দিতে থাকে। কেউ নৌকার পাটাতনে থাবা দিয়ে, কেউ হাততালি দিয়ে তাল দেয়। সুরুজ হাঁড়িটাকে তবলা হিসেবে ব্যবহার করে। রুবেল একটা হাল দিয়ে পানিতে খেলিয়ে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ করে। দারুণ জমে ওঠে গান-বাজনা, যেন বড় কোনো গানের দল আসর বসিয়েছে।
গানের আসর অবশ্য থামিয়ে দিতে হয়। দূরের নৌকাটা কাছে এসে গেছে। নৌকাতে তিনজন মানুষ। একজনকে বিদেশির মতো লাগে। যে নৌকার হাল বাইছিল সে বলে, ‘এই যে পোলাপাইন, এই ভরদুপুরে মাঝ নদীতে নৌকা নিয়া কী করো?’
‘কী আজিব পোলাপাইন! এইরকম দুপুর বেলায় কেউ নদীতে ঘুইরা বেড়ায়!’
দ্বিতীয়জন সন্দেহ প্রকাশ করে বলে, ‘শুধুই ঘুইরা বেড়াইতিছো, নাকি অন্য কোনো মতলব আছে!’
লোকগুলো ভ্রু কুঁচকায়। লাবুকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে। তারপর দ্বিতীয়জন বলে, ‘থাকতে পারে না! কত জনের কত রকমই তো মতলব থাকে!’
সুরুজ বলে ওঠে, ‘আপনাদের আবার কোনো মতলব নাই তো!’
‘ক্যান, থাকতে পারে না! কত জনের তো কত রকমের মতলব থাকে!’ সুরুজ কৌতুকের ভঙ্গিতে বলে।
লাবুরা আর কোনো জবাব দেয় না। নৌকা টান দিয়ে প্রথম লোকটা বলে, ‘দুপুর বেলা নদীতে ঘুইরা বেড়ানো ভালো না। বাড়ি চইলা যাও।’
লাবু বলে, ‘তাইতো মনে হলো।’
‘গবেষণা করতে পারে।’ টিপুর বৈজ্ঞানিক উত্তর।
‘আমার মনে হইতিছে ওই লোকগুলারই কোনো মতলব আছে।’ শেফালি বলে।
সুরুজ বলে, ‘আমারও তো তাই মনে হইতিছে।’
‘তাইলে থাক। ওরা ওদের মতো যা খুশি করুক আমাদের আর মাথা ঘামানোর দরকার নাই।’ ডিটেকটিভ প্রস্তাবে সাড়া না পাওয়ায় মিন্টু কিছুটা মলিন স্বরে বলে।
পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০২)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৩)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৪)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৫)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৬)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৭)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৮)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৯)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১০)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১২)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৩)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৪)
জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮; রাজশাহী, বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘন অন্ধকারের খোঁজে’ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘি দেয়া গরম ভাত আর চিতল মাছের পেটি’। মাঝে ২০১৩ সালে কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মগডাল বাহাদুর’ প্রকাশিত হয়। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর এমবিএ করেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষায়। বর্তমানে স্বনামধন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করছেন। বই প্রকাশে দীর্ঘ বিরতি চললেও লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন, বিশেষ করে দুরন্তপনার গল্পগুলো। লেখকের কৈশোর জীবন তুমুল দুরন্তপনায় কেটেছে এমনটা নয়, তবু বেশ রঙিন এক কৈশোর কাটিয়েছেন মফস্বল শহরে। রঙিন সে জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ না থাকায় খুব আফসোস হয়। এ আফসোস ঘোচাতেই লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান কৈশোরে আর দুরন্তপনায় মেতে ওঠেন ইচ্ছেমতো। প্রত্যাশা কেবল এতটুকুই, কিছু উপযুক্ত পাঠক সঙ্গী হোক তার লেখার এ দুরন্ত জীবনে।