মুহসীন মোসাদ্দেক
(পূর্ব প্রকাশের পর)
নদীর ঘাটে এসে দেখা যায় ঘাট প্রায় ফাঁকা। শুধু এক বুড়ো লোক গোসল করছে। লাবুদের ব্যাপারে তার বিশেষ কোনো আগ্রহ বা মনোযোগ দেখা গেলো না। দূরের ঘাটগুলোতে কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। দুটো নৌকাও দেখা যাচ্ছে নদীর মাঝখানে।
লাবুরা একে একে নৌকায় চড়ে বসে। নৌকার দুই মাথায় রুবেল আর সুরুজ বসলো, বাকিরা মাঝখানে। রুবেল আর সুরুজ নৌকা চালাবে। প্রথমে কিছুক্ষণ নদীতে ঘুরবে নৌকা নিয়ে। তারপর বেশ দূরে চরের কোনো এক দিকে নামবে।
নৌকা চলতে থাকে হালকা দুলতে দুলতে। তেমন সে্রাত নেই নদীতে। পানি যেহেতু বেশি নেই সে্রাতও তাই বেশি থাকার কথাও নয়। তবে, প্রচণ্ড বাতাস বইছে। নদীর মাঝখান দিয়ে বাতাস সবচেয়ে বেশি। লাবুদের নৌকা আপাতত পাড় থেকে একটু দূর দিয়ে যাচ্ছে। বাতাসে সবারই চুল উড়ছে। শেফালির চুল উড়ছে সবচেয়ে বেশি। মিন্টু নৌকার মাঝখানে উঠে দাঁড়ায়। তারপর দুই হাত দুই পাশে মেলে দেয় সিনেমার নায়কের মতো। আর বলে, ‘নিজেরে রাজার মতোন মনে হইতিছে।’
মিন্টুর দেখাদেখি ইলিয়াস, টিপু এবং লাবুও রাজার মতো ভাব ধরতে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত দুই পাশে মেলে দেয়। নৌকা হঠাৎ একদিকে হেলে যায়, সবাই ধপ করে বসে পড়ে। শেফালি আতঙ্কে একটা চিৎকার দেয়।
নৌকা আবার সামলে নিতেই সুরুজ বলে, ‘আইচ্ছা, আমরা যে আইজ স্কুল গেলাম না, ক্লাস এইটের পোলাপানগুলা আইসা আমাগোরে না দেইখা যদি ভাবে আমরা ভয়ে আসি নাই, তাইলে?’
সবারই বিষয়টা খেয়াল হয়। এরকম তো ভাবতেই পারে!
মিন্টু উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘ভাবলে ভাবুক। এইরকম ফুর্তির সময় এইটা মাথা ঘামানোর মতো কোনো বিষয়ই না।’
বাকিরাও বিষয়টা উড়িয়ে দেয়। এইরকম ফুর্তির সময় এইটা আসলেই মাথা ঘামানোর মতো কোনো বিষয় না!
নৌকা চলতে থাকলো। কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখতে ব্যাগ থেকে একে একে সব বের করা হলো। চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, লবণ, হলুদ—সবই আছে পর্যাপ্ত। কিন্তু তেল নেই। খিচুড়ি রান্না করা হবে। তেল ছাড়া খিচুড়ি ভালো হবে না। কিছু সবজি হলে ভালো হতো। দু-তিনটা ডিম আর আঁচার হলে আরো ভালো হতো।
সবজি নিয়ে বেশি ভাবতে হলো না। চরে পটল-বেগুনের ক্ষেত আছে। সেখান থেকে কিছু পটল-বেগুন সংগ্রহ করে সবজির ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু তেল আর ডিমের ব্যবস্থা করতে একটু ঝুঁকি নিতে হবে। তেল-ডিম নিতে আবার গ্রামে ফিরে আসতে হবে, দোকান থেকে নিতে হবে। কারো কাছে টাকা নেই। বাসায় বলে এসেছে টিফিনে স্কুলের আশেপাশের দোকান থেকে কিছু কিনে খেয়ে নিবে। কিন্তু টাকা নিয়ে আসার কথা কারো মনে নেই। লাবুর মাথায়ও আসে নি বিষয়টা। আম্মুও মনে করে দেয় নি। তাতেও কিছু আটকে যাবে না। কাউকে সাথে নিয়ে দোকানে যাবে রুবেল। তারপর তার আব্বুর নাম করে বাকিতে তেল আর ডিম কিনে আনবে। বাসায় ফিরে টিফিনে খাওয়ার কথা বলে লাবু আম্মুর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিকেলেই বাকি শোধ করে দিয়ে আসবে। বড় আব্বু জানতেও পারবে না। টিফিনে খাওয়ার কথা বলে কিছু টাকা নিয়ে আসলে অবশ্য এই ঝুঁকি নিতে হতো না।
এখন সব বাড়িতেই আঁচার করা হচ্ছে। কাঁচা আমের আচার নেই এমন কোনো বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আগে মাথায় থাকলে আসার সময়ই নিয়ে আসা যেত। স্কুলে যেতে যেতে খাওয়ার জন্য আঁচার নিতে চাইলে কোরো বাড়িতেই কেউ আপত্তি করতো না। এখন, রুবেল যখন তেল-ডিম কিনতে যাবে তখন যদি সম্ভব হয় তবে নিয়ে আসবে।
চাল-ডালগুলো হাঁড়ি-কড়াইতে তুলে রাখা হলো। খাওয়ার জন্য কেউ থালা-বাসন নিয়ে আসে নি। সুতরাং কলাপাতার ব্যবস্থা করতে হবে। ধু ধু মরুভূমির মতো চরে ভরদুপুরে কলাপাতায় করে নিজেদের রান্না করা খিচুড়ি খাবে—বিষয়টা ভাবতেই কেমন জানি লাগে লাবুর। অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হবে। কেমন যেন একটা উৎসব উৎসব ভাব এসে যায়।
পেঁয়াজ-রসুনও ছেলা শুরু করা হলো। এবং তা করতে গিয়ে সবার চোখের জল নাকের জল এক হয়ে একাকার হয়ে গেলো। রুবেল আর সুরুজকে এ ঝামেলা পোহাতে হলো না। অবশ্য ঝাঁজ তাদের নাক পর্যন্তও বিস্তৃত হলো, সে ঝাঁজ তাদের চোখ কিংবা নাক থেকে জল ঝরাতে সমর্থ হলো না।
নৌকা একটা বাঁক পেরুলো। নৌকা বেশ ধীর গতিতে এগুচ্ছে। খুব জোরে এগুনোর তো দরকারও নেই। তাদের নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। কোনো প্রকার তাড়াও নেই। নদীর বুকে ভেসে থেকে সময়টাকে সুন্দর করে তোলাই উদ্দেশ্য। এরই মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করা হয়ে গেছে। আপাতত নিরাপদ অবস্থান বলা যায়। এদিকে বিশেষ একটা বসতি নেই। নৌকা এখন মাঝ নদী দিয়ে বয়ে চলছে। দুপাশের প্রকৃতি এখন উপভোগ করার মতো।
একপাশে শুধু চর। চরজুড়ে নানা ফসলের ক্ষেত। আরেক পাশে দূরের গ্রাম। দূরে গাছগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন। দু-একটি বসতি দেখা যাচ্ছে। কিছু লোকও দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে গরু-ছাগল চরতেও। কোনো কোনো ঘাটে মহিলারা কাপড় ধোয়ার কাজ করছে। কিছু বাচ্চাকাচ্চা ইচ্ছেমতো জলের ভেতর ঝাঁপাঝাঁপি করছে। এসবের মাঝ দিয়ে নৌকা বয়ে যাচ্ছে মৃদু দুলতে দুলতে। চারপাশে এসব দেখতে দেখতে লাবুরা কিছুটা উদাস হয়ে যায়।
সুরুজ আবার উত্তেজনা ফিরিয়ে আনে, দূরে ঝাঁপাঝাঁপিতে ব্যস্ত বাচ্চাগুলোকে দেখিয়ে বলে, ‘ওই পুলাপাইনগুলার মতো আইজ আমরাও নদীতে গোসল করবো।’
মনে মনে যেন সবাই এটাই ভাবছিল, লাবু বললো, ‘অবশ্যই করবো। অন্যরকম মজা হবে।’
মিন্টু সন্দেহ প্রকাশ করে বলে, ‘কিন্তু, বাড়ি যাওয়ার আগে যদি কাপড় না শুকায়!’
টিপু বলে, ‘শুকাইবো না ক্যান! যে রোদ আর বাতাস, তাতে পাঁচবার গোসল করলেও কাপড় শুকায় যাইবো!’
টিপু যেহেতু বিজ্ঞানী, সে যখন বলেছে পাঁচবার গোসল করলেও এই রোদে এই বাতাসে কাপড় শুকিয়ে যাবে, তখন অন্তত একবার গোসল করে কাপড় শুকানো নিয়ে না ভাবলেও চলবে!
এদিকে চুলা তৈরি। চাল-ডাল-আলু-পটল-বেগুন-পেঁয়াজ-
মিন্টু ঝাঁজ মেশানো কণ্ঠে বলে, ‘নির্ঘাত ওরা ফড়িং ধইরা বেড়াইতিছে!’
লাবু কিছু বলে না। বিন্দুর মতো টিপু-ইলিয়াসের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘চল, আমাদেরকেই খড়ি-লাকড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।’
শেফালিকে সবকিছু দেখে রাখতে বলে মিন্টুকে নিয়ে লাবু খড়ি-লাকড়ি কুড়াতে গেলো। আশেপাশেই পেয়ে গেলো বেশকিছু। তবে, সেগুলো পর্যাপ্ত হবে না। তারপরও চুলা জ্বালাতে প্রস্তুতি নিতে লাগলো। এবং এই মুহূর্তে তারা টের পেলো—চুলা জ্বালাতে হলে আসলে টিপুকেই লাগবে। টিপু না আসা পর্যন্ত কিংবা টিপুকে ধরে না আনা পর্যন্ত চুলা জ্বালানোর উপায় তাদের হাতে নেই! দিয়াশলাই তো টিপুর কাছেই!
মিন্টু দাঁত কিড়মিড় করে বললো, ‘ওর কিন্তু আইজ খরব আছে! ওরে কিন্তু খাইতে দিবো না!’
কিছুক্ষণ পর ইলিয়াস একা একা ফিরে আসে। কিছু লাকড়ি আর খড় সাথে করে নিয়ে আসে। এবং বেশ হাঁপাতে হাঁপাতে আসে। এসে হাতের সব ফেলে দিয়ে বসে পড়ে বললো, ‘আমি আর টিপুর সাথে নাই! আমার জান শ্যাষ কইরা ফেলাইলো!’
কেউ আর কিছু বলে না। টিপু তো এইরকমই। ওকে কিছু বলে কোনো লাভ নেই। খানিক বাদেই সব ভুলে গিয়ে নিজের ধান্দায় ছুটে বেড়াবে আবার।
পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০২)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৩)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৪)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৫)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৬)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৭)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৮)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৯)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১০)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১২)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৩)
জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮; রাজশাহী, বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘন অন্ধকারের খোঁজে’ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘি দেয়া গরম ভাত আর চিতল মাছের পেটি’। মাঝে ২০১৩ সালে কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মগডাল বাহাদুর’ প্রকাশিত হয়। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর এমবিএ করেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষায়। বর্তমানে স্বনামধন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করছেন। বই প্রকাশে দীর্ঘ বিরতি চললেও লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন, বিশেষ করে দুরন্তপনার গল্পগুলো। লেখকের কৈশোর জীবন তুমুল দুরন্তপনায় কেটেছে এমনটা নয়, তবু বেশ রঙিন এক কৈশোর কাটিয়েছেন মফস্বল শহরে। রঙিন সে জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ না থাকায় খুব আফসোস হয়। এ আফসোস ঘোচাতেই লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান কৈশোরে আর দুরন্তপনায় মেতে ওঠেন ইচ্ছেমতো। প্রত্যাশা কেবল এতটুকুই, কিছু উপযুক্ত পাঠক সঙ্গী হোক তার লেখার এ দুরন্ত জীবনে।
1 Comment