মুহসীন মোসাদ্দেক
যদি আর ফিরে যেতে না হতো…
আম্মু সাড়া দেয় না। লাবু আবারো বলে, ‘বলছি তো, সরি!’
‘কী হবে সরি বলে!’
লাবু নিজেই নিজের পক্ষে ঢাল ধরে, ‘আমরা কি খারাপ কিছু করেছি?’
‘কারো যদি কিছু হয়ে যেত, তো!’
‘হয় নি তো!’
‘হতে তো পারতো! অনেক বড় রকমের দুর্ঘটনা হতে পারতো!’ আম্মু যেন একটু ফুঁপিয়ে ওঠে।
‘আসলে এইরকম কিছু ঘটে যাবে বুঝতে পারি নি!’
‘ওই ক্রিমিনালগুলোর কথা না হয় বাদ দিলাম! রাত-বিরেতে ভূতের বাড়িতে যাওয়ার দরকার পড়লো কেন! সেখানেও তো কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারতো!’
‘কিন্তু সেখানে গিয়েছিলাম বলেই না ক্রিমিনালগুলো ধরা পড়লো! বলো তো আম্মু, একেবারে বাড়ির কাছে এত বড় একটা সম্পদ আছে, সেটাকে ব্যবহার করে একটা চক্র ক্রাইম করে বেড়াচ্ছিল, এটা যদি আরো কিছু বছর চলতো তবে কি সেটা ভালো হতো? শেষ পর্যন্ত একটা ভালো কিছু তো হয়েছে, তাই না?’
আম্মু জবাব দেয় না। লাবু জড়িয়ে ধরে আম্মুকে, ‘এখনো রাগ করে থাকবে!’
‘আমি তো রাগ করে নেই! রাগ করে কখনো ছিলামও না। শুধু আফসোস! ছেলে আমার কথা শোনে না!’
‘আচ্ছা, এবার থেকে শুনবো। তোমাকে না বলে কিছু করবো না। ভালো করি মন্দ করি তোমাকে বলেই করবো। এই কানে ধরে বললাম—’ লাবু সত্যি সত্যি কানে ধরে।
আম্মু হেসে ফেলে।
লাবুদের সাতজনকে নিয়ে বড় আব্বু থানায় যায়। পুলিশ অফিসার বলে, ‘এই বাচ্চাগুলো যে কী একটা কাজ করেছে তা বলে বোঝানো যাবে না। এমন দুঃসাহসিক কাজ অনেক পুলিশও করতে পারবে না। ওদের জন্য আমরা এইরকম একটা চক্রকে ধরতে পারলাম। পাঁচ বছর ধরে আমরা ওদের ধরতে চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই ধরতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম আশেপাশেই কোথাও ওদের ঠিকানা। কিন্তু কিছুতেই বের করতে পারছিলাম না। ভূতের বাড়িটা যে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটা কল্পনাও করি নি!’
কেউ কিছু বলে না। পুলিশ অফিসার লাবুদের বাচ্চা বলায় ওদের গায়ে লাগে। পুলিশ এক মুখে বলে দুঃসাহসিক কাজ আরেক মুখে বলে বাচ্চা! কী রকম উদ্ভট ব্যাপার!
পুলিশ অফিসার বলে চলে, ‘যাইহোক, সরকার এরই মধ্যে ওদের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেছে! প্রত্যেককে দশ হাজার টাকার বই পুরস্কার দেয়া হবে। আর সংবর্ধনা দিয়ে সবাইকে গোল্ড মেডেল দেয়া হবে।’
বড় আব্বু বলে, ‘এসবের কী দরকার! ওরা তো দুষ্টুমি করতে গিয়ে একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে! এর জন্য এত কিছুর কী দরকার!’
‘কী বলছেন এসব!’ পুলিশ অফিসার চোখ কপালে তুলে ফেলে, ‘ওরা যা করেছে তার কোনো তুলনা নেই! তা দুষ্টুমি করে করুক আর যাই করে করুক! ওদের প্রাপ্য সম্মান দিতেই হবে।’
বড় আব্বু আর কথা বলে না। পুলিশ অফিসার একাই বলে যায়, ‘আর দুষ্টুমি করে যদি দেশের জন্য ভালো কিছু করা যায় তবে সে দুষ্টুমিও প্রশ্রয়যোগ্য। ওরা শুধু দেশের জন্য ভালো কিছু করে নি, নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য অনেক ভালো কিছু করেছে! এসব সম্পদের অনেক মূল্য। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অর্থাৎ এই বাচ্চাগুলোই এর সুফল ভোগ করবে!’
একটু থেমে আবার বলে, ‘আমার ছেলেমেয়েরা দুষ্টুমি করতে গিয়েও যদি এইরকম কিছু করে বসতো আমি তাদের মাথায় তুলে নাচতাম আর দুষ্টুমিতে আজীবনের জন্য এনওসি, আই মিন “নো অবজেকশন সার্টিফিকেট” দিয়ে দিতাম!’
বলেই পুলিশটা হো হো করে হাসে। লাবুরাও হাসে। কিন্তু তাদের পোড়া কপাল! এত বড় কাণ্ড ঘটিয়েও কেউ তাদের দুষ্টুমিতে আজীবনের জন্য তো দূরের কথা, ঘণ্টা খানেকের জন্যও এনওসি দিলো না!
বলাবাহুল্য, তাদের আজ আর স্কুলে যেতে হলো না। কিন্তু গোটা গ্রাম জেনে গেছে লাবুদের ভূতের বাড়ি কাণ্ডের কাহিনি। অনেকেই বাসায় তাদের দেখতে আসছে। স্কুল থেকে স্যারেরা এসেছে। ক্লাসের ছেলেমেয়েরাও এসেছে। ক্লাস এইটের ছেলেগুলোও এসেছিল। সবাইকে তাদের ভূতের বাড়ির কাণ্ড গল্প করে শোনাতে হলো! কী বিব্রতকর অবস্থা!
এর মধ্যে আব্বুও ফোন করেছিল। প্রথমে একটু বকলেও পরে ঠিকই বাহবা দিয়েছে।
এসব সামলাতে সামলাতেই দিনটা পার হয়ে গেলো!
সব টিভি চ্যানেলে লাবুদের কাণ্ড নিয়ে খবর প্রচার হয়েছে। সন্ধ্যার পর সবাই মিলে বসে সে সব দেখলো এবং শুনলো। বিকেলে একটা টিভি চ্যানেল থেকে লাবুদের সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিল। বড় আব্বু দিতে দেয় নি! বেশ কয়েকটা পত্রিকা থেকে লোক এসেছিল লাবুদের ছবি নিতে, সেটাও বড় আব্বু দিতে দেয় নি! সবাইকেই ফেরত পাঠিয়েছে। হয়তো ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা ভেবে! লাবুদের অবশ্য খুব আফসোস হয়—তাদের টেলিভিশনে দেখা যেত, পত্রিকায় বড় বড় ছবি ছাপা হতো! রাতারাতি তারকা বনে যেত! কিন্তু বড় আব্বু নিশ্চয় ভালোর জন্যই এসব করেছে—এই ভেবে সান্ত্বনা খুঁজে নেয়!
পরদিন সব পত্রিকায় বড় বড় শিরোনাম হলো লাবুদের কাণ্ড নিয়ে। বড় আব্বু প্রায় সব পত্রিকাই কিনে এনেছে। একেক পত্রিকা একেক রকমের শিরোনাম করেছে। তার মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ‘একদল কিশোরের ভূতের বাড়ি কাণ্ড!’ শিরোনামটা। লাবুরা সবাই মিলে বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে পত্রিকাগুলো। খুব ভালো ভালো কথা লিখেছে তাদের নিয়ে। সঙ্গে ওদের ছবি থাকলে আরো ভালো হতো। সেটা নিয়ে আর আফসোস করে না কেউ। ওরা ঠিক করেছে পত্রিকাগুলো কেটে বাঁধাই করে রাখবে। এবং প্রতিবছর এই দিনটা উদ্যাপন করবে।
এদিনও স্কুল যেতে হয় না। কিন্তু পত্রিকা পড়ে, ভূতের বাড়ি কাণ্ডের গল্প করে কীভাবে কীভাবে যেন এদিনটাও শেষ হয়ে গেলো! এবং লাবুর মনে পড়লো কাল সকালের ট্রেনেই ফিরে যেতে হবে! প্রতিবারই ফিরে যাবার সময় লাবুর মন খারাপ হয়ে যায়, শূন্য শূন্য ভাব হয়। এবারের মন খারাপের মাত্রাটা একটু ভিন্ন। মন খারাপের শূন্যতায় একটা যেন বাড়তি মাত্রা যোগ হয়! বাড়তিটা কী লাবু বুঝতে পারে না। বোঝার তেমন চেষ্টাও অবশ্য সে করে না! মনে মনে সে শুধু আফসোস করে, ‘ইস! এখান থেকে যদি আর ফিরে যেতে না হতো!’
পূর্ববর্তী পর্বসমূহ:
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০২)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৩)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৪)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৫)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৬)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৭)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৮)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ০৯)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১০)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১২)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৩)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৪)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৫)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৬)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৭)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৮)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ১৯)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ২০)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ২১)
ধারাবাহিক কিশোর উপন্যাস: লাবুদের দস্যিপনা (পর্ব ২২)
জন্ম ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮; রাজশাহী, বাংলাদেশ। ২০১০ সালে প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ঘন অন্ধকারের খোঁজে’ এবং ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘ঘি দেয়া গরম ভাত আর চিতল মাছের পেটি’। মাঝে ২০১৩ সালে কিশোর গল্পগ্রন্থ ‘মগডাল বাহাদুর’ প্রকাশিত হয়। প্রাণিবিদ্যায় স্নাতকোত্তর সম্পন্নের পর এমবিএ করেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষায়। বর্তমানে স্বনামধন্য একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগে কাজ করছেন। বই প্রকাশে দীর্ঘ বিরতি চললেও লিখে যাচ্ছেন নিয়মিত। শিশু-কিশোরদের জন্য লিখতে ভালোবাসেন, বিশেষ করে দুরন্তপনার গল্পগুলো। লেখকের কৈশোর জীবন তুমুল দুরন্তপনায় কেটেছে এমনটা নয়, তবু বেশ রঙিন এক কৈশোর কাটিয়েছেন মফস্বল শহরে। রঙিন সে জীবনে ফিরে যাবার সুযোগ না থাকায় খুব আফসোস হয়। এ আফসোস ঘোচাতেই লেখার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে ফিরিয়ে নিয়ে যান কৈশোরে আর দুরন্তপনায় মেতে ওঠেন ইচ্ছেমতো। প্রত্যাশা কেবল এতটুকুই, কিছু উপযুক্ত পাঠক সঙ্গী হোক তার লেখার এ দুরন্ত জীবনে।